খাদ্য দূষণ : দুর্বলতা আইনে নাকি প্রয়োগে?
কাজী মাহমুদুর রহমান

খাদ্য দূষণ : দুর্বলতা আইনে নাকি প্রয়োগে?

কাজী মাহমুদুর রহমান : ভেজাল নিয়ে রোকন ভাইয়ের (সাবেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রোকন উদ-দৌলা) প্রচারণার পর সচেতন নাগরিকরা নানা ধরণের লিখা-লিখি, প্রচার-প্রচারণা করেছেন। তবুও খাদ্য দূষণ বা ভেজালের দৌরাত্ম্য দিনদিন বেড়েই চলেছে। কেন এই দৌরাত্ম্য? কী আছে এর পেছনের শক্তি? শহরবাসীদের পাশাপাশি গ্রামবাসীরাও ভেজাল দিয়ে গ্রাসিত। গ্রাসিত গ্যাস্ট্রিক, আলসার ও কিডনির জটিল সব রোগে। একদিকে নামিদামি হাসপাতাল অপরদিকে অভিনব খাদ্য দূষণে বা ভেজালে আচ্ছাদিত।কেউ দেখার নেই । এ যেন হবু চন্দ্রের দেশ। যে যেভাবে পারে ভেজাল দিয়ে খাদ্য দূষণ করে পয়সা বানানোর চেষ্টা করছে।ভেজাল মেশানো হচ্ছে খাবারের কাঁচামালেও। ফলে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে তৈরি খাবার।

তৈরি ভেজাল খাবার হলো সেই সমস্ত খাবার যা তৈরি করা হয় রাসায়নিক উপাদান দিয়ে যা মানুষের শরীরের জন্য স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি সৃস্টি করে। ভেজাল খাবার নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উদ্বিগ্নতার কারণ শুরু হয়েছে বহু বছর আগে। বিংশ শতাব্দির গোড়ায় বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন স্থানে পরোক্ষভাবে ভেজাল খাবার নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

মূলত: পাকিস্তান আমল থেকে এদেশে মারোয়ারী ব্যবসায়ীদের পণ্যে ভেজাল দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ বা দক্ষিণ অঞ্চল যতটা না ভেজাল খাবার নিয়ে বিব্রত তার থেকে সিলেট-কুমিল্লা–চট্টগ্রামের অধিবাসীরা ভেজাল খাবার নিয়ে অধিক বিব্রত।এই কারণে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ঐ সকল অঞ্চলে বেশি ব্যবহৃত হয়। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও আইন প্রয়োগে দুর্বলতার কারণে দিনদিন বেড়েই চলেছে ভেজাল খাবারের দৌরাত্ম্য।

ভেজালের  স্তর

কাঁচামাল তৈরি, পাকামাল তৈরি, প্রস্তুতকৃত খাবার, বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন, বিক্রেতা। ভেজাল বা খাদ্য দূষণ শুরু হয় খাবারের  কাঁচামাল তৈরি থেকে। কৃষকের চাষের সময় রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হলো এর শুরু। এরপর সেই কাঁচামাল সংরক্ষণ করার জন্য রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে বাজারজাত করা হয়। এরপর হোটেল গুলো যখন খাবার তৈরি করে তখন ৩য় স্তরের খাদ্য দূষণ হয় ও মানুষ তা দাম দিয়ে ক্রয় করে। 

ভেজাল প্রতিরোধে সরকারি পদক্ষেপ

সরকার ভেজাল প্রতিরোধের জন্য এযাবৎ বেশ কয়েকটি আইন তৈরি করেছে যথা: দন্ডবিধি-১৮৬০, বিশেষ ক্ষমতা আইন- ১৯৭৪, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন- ২০০৯, খাদ্য নিরাপত্তা আইন-২০১৩, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৫। এবার আসুন দেখে নেয়া যাক এ সব আইনে কি বলা হয়েছে-

দন্ডবিধি-১৮৬০

দন্ডবিধি ২৭২নং ধারায় বলা হয়েছে যে ক্ষতিকর কোনও খাবার বা পানীয়ের কোনও বিক্রি বা বিক্রি করার  ইচ্ছা পোষণ করলে ছয় মাসের কারাদন্ড বা একহাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।

১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন

এই আইনের ২৫ (গ) এর ১(ঙ) ধারায় খাদ্য ভেজাল, ওষুধে ভেজাল মেশালে বা ভেজাল খাদ্য বা ঔষধ বিক্রি করলে বা বিক্রির জন্য প্রর্দশন করার অপরাধ প্রমাণ হলে মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন বা ১৪ বছরের কারাদন্ডের বিধান আছে। (যদিও এই আইনের আওতায় কারো শাস্তির নজির নাই)।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন –২০০৯

এই আইনটির ৪১ নং ধারাতে বলা হয়েছে “কোন ব্যক্তি জ্ঞাতসারে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় করিলে বা বিক্রয় করিতে প্রস্তাব করিলে তিনি অনুর্ধ্ব তিন বৎসরের কারাদন্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদন্ড, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন”।

আবার ভোক্তারা যেন কোন প্রকার মামলা না করে সেজন্য একই আইনের ৫৪ নং ধারাতে বলা হয়েছে, “কোন ব্যক্তি কোন ব্যবসায়ী বা সেবাপ্রদানকারীকে হয়রানি বা জনসমক্ষে হেয় করা বা তাহার ব্যবসায়িক ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করিলে, উক্ত ব্যক্তি অনূর্ধ্ব তিন বৎসরের কারাদন্ড  বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদন্ড, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।”

নিরাপদ খাদ্য আইন-  ২০১৩

এই আইনের তফসিলে (ধারা ৫৮ মতে) বলা হয়েছে – মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অথবা বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী রাসায়নিক দ্রব্য বা উহার উপাদান বা বস্তু, কীটনাশক বা বালাইনাশক, খাদ্যের রঞ্জক বা সুগন্ধি বা অন্যকোন বিষাক্ত সংযোজন দ্রব্য বা প্রক্রিয়া সহায়ক কোন খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণে ব্যবহার বা অন্তর্ভুক্তি অথবা উক্তরূপ দ্রব্য মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ মজুদ, বিপণন বা বিক্রয় এর ক্ষেত্রে প্রথমবার অপরাধ সংঘটনের জন্য আরোপযোগ্য দন্ড – অনূর্ধ্ব পাঁচ বৎসর কিন্তু অন্যূন চার বৎসর কারাদন্ড বা অনূর্ধ্ব দশ লক্ষ টাকা কিন্তু অন্যূন পাঁচ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড। পুনরায় একই অপরাধ সংঘটনের জন্য আরোপযোগ্য দন্ড – পাঁচ বৎসর কারাদন্ড বা বিশ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড।

এছাড়া ছোঁয়াচে ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তির দ্বারা কোন খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ প্রস্তুত, পরিবেশন বা বিক্রয় এর জন্য অনূর্ধ্ব দুই বৎসর কিন্তু অন্যূন এক বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক চার লক্ষ টাকা কিন্তু অন্যূন দুই লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড। পুনরায় একই অপরাধ সংঘটনের জন্য দুই বৎসর কারাদন্ড বা আট লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড।

ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৫

কোন ব্যক্তি যদি এই আইনের অধীন প্রদত্ত লাইসেন্সের কোন শর্ত ভঙ্গ করেন (মানবদেহের ক্ষতি হয় এমন খাবারে ফরমালিন ব্যবহার করে), তাহলে উক্ত ব্যক্তির অপরাধমূলক কাজের জন্য ৭ (সাত) বৎসরের কারাদন্ড ও দুইলক্ষ টাকা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।

সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য

খাদ্যে ভেজাল রোধে আইন পর্যাপ্ত আইন নেই এ কথা বলা যাচ্ছে না। তবে যথাযথ প্রয়োগের ঘাটতি রয়েছে। বছর কয়েক আগে, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ভেজাল প্রতিরোধে প্রয়োজনে নিরাপদ খাদ্য আইন সংশোধন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হবে৷ সে সময় তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও খাদ্যে ভজোলকারী অসাধু ব্যবসায়ীদের  মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার দাবি জানান৷ তিনি বলেন, ‘ভেজালকারীদের অপরাধ একাত্তরের ঘাতকদের চেয়েও কম নয়।’

বিগত ১১.০৬.২০১৯ তারিখে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘খাদ্যে ভেজালের অপরাধে  যারা মৃত্যুদণ্ড চান তারা এখনো আমাদের কাছে কোনো প্রস্তাব দেননি৷ তারা আগে প্রস্তাব দিক তারপর আমরা দেখবো’৷

তিনি বলেন,‘ তবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করলে কোনো আসামি যদি বিদেশে পালিয়ে যায় এবং তার মৃত্যুদণ্ড হয় তাহলে তাকে সারাজীবন আর দেশে ফিরিয়ে আনা যাবেনা৷ কারণ সারাবিশ্বে দণ্ড হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হচ্ছে৷ কোনো কোনো দেশ এরই মধ্যে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রহিত করেছে৷ নতুন আইন করলে এটা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে’৷

তিনি আরো বলেন, ‘দেশে প্রচলিত আইনেই খাদ্যে ভেজালের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে৷ বিশেষ ক্ষমতা আইন দেখেন সেখানে মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা আছে৷ কিন্তু কেউ এই আইনে মামলা করেনা৷ ফলে আইনেরও প্রয়োগ হয়না ।’

ইসলাম ধর্মের বক্তব্য

খাদ্যে ভেজাল দিলে তা বিক্রির ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। সত্যের সাথে মিথ্যার সংমিশ্রণ ঘটাতে হয়। অথচ আল্লাহ তায়ালা কোরআনেকারিমে ইরশাদ করেছেন, তোমরা সত্যের সঙ্গে অসত্যের মিশ্রণ ঘটিয়োনা এবং জেনেশুনে সত্য গোপন করোনা।’ -সূরা বাকারা: ৪২

একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) বাজারে এক খাদ্যস্তুপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন।এমন সময় তিনি খাদ্যস্তুপের ভেতরে হাত প্রবেশ করিয়ে দেখেন স্তুপের ভেতরে ভেজা। খাদ্য বিক্রেতার কাছে তিনি এর কারণ জানতে চাইলেন- এটি কেমন কথা? সে বলল- হে আল্লাহর রাসূল, এগুলো বৃষ্টিতে ভিজে গেছে।

রাসূল (সা.) বললেন- তাহলে ভেজা খাদ্যগুলো উপরে রাখোনি কেন, যাতে মানুষ দেখতে পেত। অত:পর রাসূল (সা.) বললেন- যে ব্যক্তি প্রতারণা করবে সে আমার উম্মাত নয় (সহিহ মুসলিম শরীফ: ১০২)।

খাদ্যে ভেজাল দিয়ে উপার্জিত অর্থ অবৈধ, রিবা এবং হারাম। আর ইসলামে রিবা – অবৈধ ও হারাম অর্থ উপার্জনকে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

মন্তব্য

খাদ্যে ভেজাল হলো নিরব বিষ। ভেজালকারী হলো নিরব ঘাতক। সরকার যদি বাংলাদেশের ভাল চায়, যদি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশের সোনার মানুষদের মঙ্গল চায় তাহলে তাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। জনগণকে ভেজাল খাবার থেকে রক্ষা করতে হবে।

তবে জনগণ  যদি কোন অপরাধকে অপরাধ না মনে করে, তারা যদি ক্রাইমকে সাদরে গ্রহণ করে তাহলে সরকারের কিছুই করার থাকেনা। অধিকাংশ জনগণ মনে করছে না ভেজাল খাবার বা খাদ্যদূষণ একটি অপরাধ। তারা বুঝতেই পারে না যে, ভেজাল খাদ্য নিরবে জনগণকে হত্যা করছে। খাদ্যে যতই ভেজাল দিক যতক্ষণ পর্যন্ত জনগণ অপরাধ মনে না করবে ততক্ষণ এটা বন্ধের সম্ভাবনা কম। তাই গণসচেতনতা প্রয়োজন। অনেকে মনে করেন গণ-সচেতনতা তৈরী হলে হয়তো খাদ্যে ভেজাল হবে না। একটা শক্ত আইন তৈরি ও যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে হবে।

যদিও সরকার নানা ধরনের চেষ্টা চালায় ভেজাল থেকে জনগনকে রক্ষা করতে । কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না । কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন, ভেজালের অপরাধে অপরাধীকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত না করার কারনে খাদ্যে ভেজাল থামছে না। একটা/ দুটো ফাঁসি হলেই দেশ ভেজাল মুক্ত হবে- বলে অনেকে মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশে প্রচলিত ভেজাল প্রতিরোধ আইনগুলো অনেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। আইনগুলোর সংশোধন আনতে হবে। ভেজাল প্রদানের অপরাধে ভেজালকারীকে শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ দন্ড কি দেয়া যেতে পারে তা নিয়ে জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং সেই সর্বোচ্চ দন্ড কি যাবজ্জীবন জেল, অঙ্গচ্ছেদ নাকি মৃতুদন্ড? কোনটি হবে তারও জনমত নিতে হবে।

লেখক : কাজী মাহমুদুর রহমান; আইন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন। ই-মেইল : qazi.mahmudur@gmail.com