ট্যাক্সের ৩০ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১৯৮৭ সালে মামলা হয় তৎকালীন ফরিদপুরের মধুখালীর এক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। চার বছর পর বিচার শেষে দুই ধারায় ৭ ও ৫ বছরের দণ্ড এবং ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা হয় তার।
রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন আসামি। আর এই আপিল নিষ্পত্তি হতে লেগে গেছে ৩২ বছর। আর আপিলের ফলাফল জানার ১৪ বছর আগে মারা যান ওই চেয়ারম্যান।
চেয়ারম্যানের সেই আপিল নিষ্পত্তি হয়েছে ২০২২ সালের ২৫ মে। সম্প্রতি ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে।
কিন্তু দীর্ঘ ৩২ বছরেও আপিল নিষ্পত্তি না হওয়ায় আইনজীবীরা রাষ্ট্রের পদ্ধতিগত দুর্বলতাকে দায়ী করছেন।
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী শাহীন আহমেদ বলেন, মামলাটি করেছে দুর্নীতি দমন ব্যুরো। বিচারিক আদালতে রায়ের পর আসামিপক্ষ আপিল করে। এরপর এই আপিলের খোঁজ আর কেউ রাখেনি। না রাষ্ট্রপক্ষ না দুর্নীতি দমন ব্যুরো। আসামিপক্ষও না। এর মধ্যে ২০০৪ সালের আইনে দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হয়। তখন হয়ত পুরোনো মামলার আর খোঁজ রাখতে পারেনি দুদক।
তিনি বলেন, ২০১৯ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন পুরোনো মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেন। এরপর এই ধরনের মামলাগুলো শুনানির জন্য কার্যতালিকাভুক্ত হয়। দুদক জানতে পারে ওই চেয়ারম্যান মারা গেছেন ২০০৮ সালে। পরে জরিমানা মওকুফ করে আপিলটি অ্যাবেট করে দেওয়া হয়।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণী
৩৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার গাজনা ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান শাহ আলী আকবরের বিরুদ্ধে ১৯৮৭ সালের ৩০ জুন মধুখালী থানায় মামলা করে ফরিদপুরের দুর্নীতি দমন সংস্থার তৎকালীন সহকারী পরিদর্শক মো. হারুনুর রশিদ।
অভিযোগে বলা হয়, চেয়ারম্যান শাহ আলী আকবর ইউনিয়নের জন্য ১৯৮৬-৮৭ সনের ফরিদুপর চিনিকল থেকে ট্যাক্সের ৩৫ হাজার টাকার মধ্যে দুই হাজার টাকা চিনিকলের গোরস্থানের উন্নয়নের জন্য দিয়ে বাকি টাকার চেক নেন। ১৯৮৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সেই চেক ইউনিয়ন পরিষদের সোনালী ব্যাংকের হিসাব নম্বরে জমা দেন।
জমা দেওয়ার দিন আট হাজার, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৫ হাজার এবং ১৭ ফেব্রুয়ারি ১০ হাজার টাকা উত্তোলন করেন চেয়ারম্যান। ইউনিয়নের ক্যাশ বইতে ৩৫ হাজার টাকার মধ্যে খরচের খাতে চিনি কলের গোরস্থানের উন্নয়নের জন্য দুই হাজার টাকা বাদে বাকি ৩৩ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা আছে বলে এন্ট্রি দেখানো হয়।
কিন্তু এ বিষয়ে ইউনিয়ন সেক্রেটারি ও ১১ জন সদস্যের কেউ কিছুই জানেন না। ইউনিয়ন পরিষদের ক্যাশ বইতে ৩৩ হাজার টাকা খরচের কোনো হিসাব নেই আবার টাকা ব্যাংকেও নাই। চেয়ারম্যান এ বিষয়ে কোনো সন্তোষজনক জবাব দেননি। তাই এ টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন।
বিচার ও রায়
পরে এ মামলার বিচার শেষে ১৯৯১ সালের ৪ জুন রায় দেন ফরিদপুরের বিশেষ জজ। রায়ে তাকে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় সাত বছরের সাজা দেন। পাশাপাশি ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন অনাদায়ে তিন বছরের সাজা দেন।
এছাড়া ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় ৫ বছরের দণ্ড দেন। তবে সব সাজা একই সঙ্গে চলবে। এ রায়ের বিরুদ্ধে একই বছর তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন।
কিন্তু আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে আসামিকে জামিন দেওয়ার পর ওই আপিলের আর শুনানি হয়নি।
২০১৯ সালে পুরোনো মামলার শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতির উদ্যোগের পর এ ধরনের মামলাগুলো পর্যায়ক্রমে কার্যতালিকাভুক্ত হয়। মামলাটি ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের কার্যতালিকাভুক্ত হয়।
আপিলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০২২ সালের ২৫ মে এ রায় দেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. মাহমুদ হাসান তালুকদারের বেঞ্চ।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সামিরা তারান্নুম রাবেয়া মিতি, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আনুজমান আরা বেগম ও কাজী শামসুন নাহার কণা। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শাহীন আহমেদ। তবে আপিলের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।
সম্প্রতি রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়। আদালত রায়ে বলেন, এ আপিলটি যখন শুনানির জন্য আসে তখন দুদক আইনজীবী একটি হলফনামা দেন। যাতে দেখা যায়, শাহ আলী আকবর ২০০৮ সালের ৭ জুলাই মারা যান। তাই ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৩১ ধারা অনুযায়ী ফৌজদারি আপিলটি বাদ (অ্যাবেট) দেওয়া হলো এবং জরিমানা মওকুফ করা হলো।