মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী : কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীতে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলনের সাথে কারা জড়িত, কত ঘনফুট বালু উত্তোলন করেছে, সরকার ও পরিবেশের কি পরিমাণ ক্ষতি করেছে, তা নিরূপণ করে তদন্ত পূর্বক বিস্তারিত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য কক্সবাজারের পিলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
‘দৈনিক কক্সবাজার’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় গত রোববার (১ অক্টোবর) “বাঁকখালীর ডজন পয়েন্টে ড্রেজার মেশিনের থাবা” শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে কক্সবাজারের ১ নম্বর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গাঁ সোমবার (২ অক্টোবর) এ নির্দেশ দেন।
কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশেক ইলাহী শাহজাহান নুরী ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি আরো জানান, দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকায় উল্লেখিত শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি বিজ্ঞ আদালতের নজরে আসে। বিজ্ঞ আদালত ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০(১)(সি) ধারা অনুযায়ী প্রতিবেদনটি আমলে নেন।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাঁকখালী নদীর ২ পাড়ে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে ১০/১২ টি সংঘবদ্ধ শক্তিশালী চক্র দেদারসে বালু উত্তোলন করে আসছে। এজন্য নদীর তীরে ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে।
বিশেষ করে চলতি বছর বর্ষা মওসুমে বাঁকখালী নদীর দুই তীরের বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়ে জন বসতিতে বন্যার পানি আঘাত হানে। বালু উত্তোলনের কারণে স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতেও নদীর দুই তীরের জনবসতি প্লাবিত হয়।
দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এভাবে বাঁকখালী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। স্থানীয় সংসদ সদস্যের নাম ব্যবহার করে শক্তিশালী সিন্ডিকেট প্রতি ডাম্পার (মিনি ট্রাক) বালু ২ হাজার টাকা থেকে আড়াইহাজার টাকায় বিক্রি করে আসছে। অকাতরে বালু উত্তোলনের ফলে বাঁকখালী নদীর দুই তীর অরক্ষিত ও সেখানকার ৫ টি গ্রামের অর্ধলক্ষ মানুষ হুমকির মুখে রয়েছে।
বাঁকখালী নদীর দুই তীরের মুহুরীপাড়া, মুক্তারকুল, পূর্ব খরুলিয়া, ঘাটপাড়া ও চাকমারকুলের বিস্তীর্ণ এলাকায় ভয়াবহ ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্লক বসিয়ে ভাঙ্গন ঠেকাতে চেষ্টা করলেও বালি উত্তোলনের কারণে ব্লকগুলো নদীতে তলিয়ে যাওয়ায় বর্ষা মওসুমে এসব এলাকায় বন্যা দেখা দেয়। বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ে। বালু খেকোরা অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়ায় স্থানীয় লোকজন তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতেও সাহস পায়না।
সরকার ২০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁকখালী নদী খনন করে নাব্যতা কাটিয়ে নদীর তীর ও তীরের বসতি রক্ষা করার চেষ্টা করলেও ড্রেজার মেশিন দিয়ে যত্রতত্র বালি উত্তোলনের কারণে কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছেনা, এ খনন কাজ। ফলে ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ, ভেঙে যাচ্ছে নদী রক্ষা বাঁধ, হুমকিতে রয়েছে নদীর দুই তীরের বাসিন্দারা।
দৈনিক কক্সবাজার এর প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন অভিযান চালালেও অজ্ঞাত কারণে বালু খেকোদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে চলে আসেন। সেজন্য বালু খেকোরা দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গাঁ দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকার এ গুরুত্বপূর্ণ সংবাদটি পর্যালোচনা করে একটি মিস মামলা রজু করেন। যার নম্বর : ০১/২০২৩।
বিচারক তাঁর আদেশে বলেন, বাঁকখালী নদীর দুই পাড়ে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলনের কারণে এলাকাবাসী হুমকিতে রয়েছে এবং পরিবেশগত চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। যা ২০১০ সালের বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনের ৪ ধারার অপরাধ সংগঠিত হয়েছে মর্মে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে। যা তদন্ত হওয়া খুবই প্রয়োজন।
কিন্তু অপরাধ সমূহ সুনির্দিষ্টভাবে আরো কাদের দ্বারা সংগঠিত হচ্ছে, তাদের বিস্তারিত নাম ঠিকানা, সাক্ষীদের নাম, ঠিকানা দৈনিক কক্সবাজার এর প্রতিবেদনে উল্লেখ নাই।
আদালতের বিচারক শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গাঁ তাঁর আদেশে আরো বলেন, অপরাধটি কাদের দ্বারা সংগঠিত হচ্ছে, তা প্রাথমিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে নিরূপণ ও তদন্তের মাধ্যমে আসামীদের সনাক্ত করা প্রয়োজন। এজন্য সার্বিক পর্যালোচনা করে বিষয়টি তদন্তপূর্বক আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) কক্সবাজারের পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেন।
তদন্তকালে দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকার প্রতিবেদক এম. বেদারুল আলম সহ প্রয়োজনীয় আরো সাক্ষীদের জবানবন্দি গ্রহণ, আসামীদের সনাক্তকরণ, ঘটনাস্থলের খসড়া মানচিত্র প্রস্তুত ও আলামত নেওয়া, ড্রেজার মেশিন, পাইপ, ভলগেট, ড্রাম ট্রাক, বালু উত্তোলন কাজে ব্যবহৃত অন্যান্য যন্ত্রপাতি তাৎক্ষণিক জব্দ করতে, কত ঘনফুট বালু উত্তোলন করেছে, সরকার ও পরিবেশের কি পরিমাণ ক্ষতি করেছে, তা নিরূপণ করে তদন্ত পূর্বক বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্তকাজে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে রামু’র ইউএনও-কে একই আদেশে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১ নম্বর আদালতের বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ রায়হান উদ্দিন জানান, বিজ্ঞ বিচারকের উক্ত আদেশের কপি সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে পৌঁছানোর বিষয়টি এখন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকায় বালু খেকোদের বিরুদ্ধে প্রকাশিত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গাঁ’র স্ব প্রণোদিত আদেশকে একটি যুগান্তকারী আদেশ বলে আখ্যায়িত করেছেন কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তারেক।
তিনি বলেন, এ আদেশের ফলে বাঁকখালী নদী থেকে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীরা সহ কক্সবাজারে পরিবেশ ধ্বংসকারীরা আইনের আওতায় আসবে। সংশ্লিষ্ট সকলে এ বিষয়ে তাঁদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে আরো সচেতন হবেন বলে তিনি মনে করেন।
আদালতের এ আদেশ সম্পর্কে বালু খেকোদের থাবায় ক্ষতিগ্রস্ত রামু’র চাকমারকুল ইউনিয়নের বাসিন্দা ও কক্সবাজার জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য নুরুল হক বলেন, বাঁকখালী নদী থেকে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করা হলে চাকমারকুল ইউনিয়ন সহ নদীর পাড়ের বাসিন্দারা নিরাপদে থাকবেন। নদী ভাঙ্গন ও বন্যা থেকে তাঁরা রেহায় পাবেন।
হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট দীপংকর বড়ুয়া পিন্টু বলেন, পরিবেশ ধ্বংসকারীদের হিংস্র থাবায় কক্সবাজার ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা বিষিয়ে উঠছে। কক্সবাজার পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংকটাপন্ন হয়ে উঠছে।
কক্সবাজার ১ নম্বর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গাঁ’র এ আদেশ একটি মাইলফলক হিসাবে উল্লেখ করে অ্যাডভোকেট দীপংকর বড়ুয়া পিন্টু বলেন, এ আদেশের মাধ্যমে বাঁকখালী নদীর বালু খেকোদের দাপট কমে আসবে, সমাজে একটা ইতিবাচক ম্যাসেজ যাবে। যা খুবই জরুরি ছিলো।
একইসাথে তিনি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সাহসী ও অনুসন্ধানী রিপোর্ট করায় কক্সবাজারের বহুল প্রচারিত পত্রিকা দৈনিক কক্সবাজার কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান।
কক্সবাজারের একজন পরিবেশবাদী বলেন, দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন ও আদালতের আদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়োপযোগী আদেশ যথাযথ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসা উচিত বলে উক্ত পরিবেশবাদী মন্তব্য করেন।