বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের ইতিহাস, স্বাধীনতা ও বাস্তবতা
মো. তাওহিদ হোসেন

সংবিধানের ৫১ বছর: আমাদের প্রাপ্তি, বাস্তবতা ও স্বপ্ন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট, বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও আইনজ্ঞ থমাস জেফারসন বলেছেন-

আমাদের সংবিধান হলো আমাদের দেশের সমস্ত জ্ঞানের এক সম্মিলিত ফলাফল

বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমরা থমাস জেফারসনের উপরিউক্ত উক্তিটির সঙ্গে যুক্ত করে বলতে পারি আমাদের সংবিধান হলো দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ এবং দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমহানীর সমষ্টির ফলাফল কারণ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত আর ২ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম বির্সজন দেওয়ার মাধ্যমে অর্জন করা আজকের সংবিধান।

আজ ৪ঠা নভেম্বর ১৯৭২ সালের আজকের এই দিনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়। আজকের এই দিনটিকে সংবিধান দিবস হিসেবেও অভিহিত করা হয়। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে এবং আইনের একজন ছাত্র হিসেবে তাই সংবিধান নিয়ে কিছু না লেখার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।

সংবিধান নিয়ে কিছু বলা বা লেখার আগে আমাদের সংবিধান সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা অত্যাবশ্যক। ছোট বেলা থেকেই আমরা কমবেশি সবাই জেনে এসেছি সংবিধান হলো রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক দলিল। সংবিধানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সি এফ স্ট্রং বলেছেন-

সংবিধান হলো এমন কতগুলো নীতির সমষ্টি যার মাধ্যমে সরকারের ক্ষমতা, শাসিতের অধিকার ও উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক নির্দিষ্ট হয়।

সি এফ স্ট্রংয়ের এর সংজ্ঞার মধ্যেই আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে সংবিধানের তাৎপর্য বিদ্যমান রয়েছে। কেননা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছরের অপশাসন এবং বঞ্চনার অধ্যায় শেষে আমরা আমাদের সংবিধান পেয়েছি। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের জাতীয় জীবনে বড় প্রাপ্তি আমাদের সংবিধান। ১৯৭২ সালের ২৩ শে মার্চ সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ আদেশ জারি করা হয়। গণপরিষদ আদেশ জারির পর ১৯৭২ সালের ১৭ই এপ্রিল খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন খসড়া সংবিধান সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করে প্রারম্ভিক আলোচনা শুরু করেন এবং ১৯৭২ সালের ১৮ই এপ্রিল সংবিধানের মুখবন্ধ বা প্রস্তাবনা প্রস্তুত করেন। খসড়া সংবিধান প্রণয়নকল্পে কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন ভারত, ব্রিটেনসহ বেশ কয়েকটি দেশে সফর করে ৭৪টি বৈঠকে মোট ৩০০ ঘণ্টা ব্যয় করে ১২ই অক্টোবর ১৯৭২ সালে গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে ড. কামাল হোসেন গণপরিষদে খসড়া সংবিধান বিল আকারে উত্থাপন করেন।

গণপরিষদের একমাত্র বিরোধী দলীয় সদস্য সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের বিরোধিতা নিয়ে ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর, ১৮ই কার্তিক ১৩৭৯ বঙ্গাব্দে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে সংবিধান কার্যকর হয়।

বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে জাতীয় জীবনে বড় প্রাপ্তির বিষয় হচ্ছে আমাদের সংবিধান। কেননা এই সংবিধান দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছরের নির্মম নিদারুণ অপেক্ষা এবং দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়েছে। গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে খসড়া সংবিধান সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন-

এই সংবিধান লিখিত হয়েছে শহীদদের রক্তে।

পৃথিবীতে একমাত্র বাংলাদেশই সদ্য স্বাধীন যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ হয়েও মাত্র ৯ মাসের মধ্যে একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে পেরেছে,একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার রূপরেখা বিশ্ববাসীর উপস্থাপন করতে পেরেছে। স্বাধীনতার ৫২ বছরে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে?

প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তি শব্দ দুটি একটির অপরটির পরিপূরক। যেখানে প্রাপ্তি নিহিত হয়েছে সেখানে অপ্রাপ্তিও বিদ্যমান আছে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সংবিধান যেমন আমাদের বড় প্রাপ্তি ঠিক তেমনী এই সংবিধানেই বিদ্যমান কিছু বিধি, নিয়ম-নীতি আমাদেরকে অপ্রাপ্তির কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। কার্যত এ অপ্রাপ্তিগুলোই আমাদের সংবিধানের বাস্তবতাকে তুলে ধরে। বাংলাদেশকে তার সংবিধান অর্জন করতে হয়েছে লাখো শহীদদের রক্তের বিনিময়ে আর সেই রক্তের দাবি ছিল একটি ন্যায় এবং সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেখানে জনগণই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী থাকবে।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচারের সমষ্টি আমাদের কাগজে লেখা সংবিধানে স্থান পেলেও বাস্তবিক অর্থে সংবিধানের ৫১ বছরেও আমরা তার সঠিক বাস্তবায়ন দেখতে পাই না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদে “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের ক্ষেত্রে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে” মর্মে লিখিত দিলেও আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনের লেশ মাত্র দেখা যায় না।

স্বাধীনতার ৫২ বছর ধরে আমাদের দেশে সবসময় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীগুলো তাদের ক্ষমতার কাছে প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণকেই তাদের প্রজা বানিয়ে রেখেছে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য এতই প্রকট যে ওয়েনডেল উইলকি’র সেই বিখ্যাত উক্তি-“যে সংবিধান রাষ্ট্রপরিচালনার দলিল, সেখানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বলে কিছু নেই। অথচ দুঃখের বিষয় আমাদের রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থায় এর অস্তিত্ব রয়েছে ” কে স্মরণ করিয়ে দেয়।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১০ অনুচ্ছেদে সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার কথা থাকলেও বাস্তবে এর ছিঁটেফোঁটাও আমাদের দেশে বিদ্যমান নাই। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য এতোই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে দেশের অর্ধেকেরও বেশি সম্পদ কুক্ষিগত অবস্থায় আছে। আর এ কুক্ষিগত সম্পদ আমাদের সংবিধানের ১০ অনুচ্ছেদের জন্য একেকটা পাহাড়সম বোঝা।

স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসেও আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারেনি যার খেসারত আমাদের সংবিধানকে দিতে হচ্ছে। মাত্র ৫১ বছর বয়সের সংবিধানকে ১৭ বার কাঁটাছেড়া করে আহত করার নজির পৃথিবীর অন্য কোন দেশের নাই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো (যখন যে দল ক্ষমতায় থেকেছে) নিজেদের প্রয়োজনে সংবিধানকে বারবার সংশোধন করেছে।

মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে আত্মদানকারী প্রত্যকে বীর যোদ্ধার স্বপ্ন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁদের উত্তরসূরিরা প্রাণ খুলে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারবে, পাকিস্তান আমলের কালো আইন, অন্যায় শোষণের হাত থেকে মুক্ত হয়ে তাঁদের রেখে যাওয়া স্বপ্নকে সার্থক করবে কিন্তু দুঃখের বিষয় সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ৩৩ এর উপ-অনুচ্ছেদ ৩,৪,৫ যুক্ত করে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান করা হয় যা ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩৩ এর উপ-অনুচ্ছেদ ১ এবং ২ এর সাথে সাংঘর্ষিক।

এছাড়াও দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে পাকিস্তান আমলের সামরিক শাসকদের তৈরি করা জরুরি অবস্থা জারি করার বিধান করে মৌলিক অধিকার স্থগিকরণের বিধান যুক্ত করা হয় স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের জনগণের সংবিধানে।

চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ১১ এর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনার কাঠামোকে এমন আমূল পরিবর্তন করা হয় যেখানে কাগজে লেখা সংবিধান বারবার আত্মহত্যা করার জন্য কাকুতি মিনতি করে।

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রকর্তৃক হত্যাকে বৈধতা দিয়ে এদেশের স্বাধীনতার প্রতিটি স্বচ্ছ পৃষ্ঠাকে কলুষিত করে। সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে অবৈধ শাসনকে বৈধতা দেওয়া।

অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সাংবিধানিকতার (কন্সটিটিউশন্যালিটির) দোহায় দিয়ে সাংবিধানিক নৈতিকতা (কন্সটিটিউশনাল মোরালিটিকে) অগ্রাহ্য করা হয়। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা আবার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্ববধায়ক সরকার বাতিল করা, ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সাংবিধানিক প্রাধান্যকে (কন্সটিটিউশনাল সুপ্রিমেসী) পরিহার করার চেষ্টা মূলত আমাদের কাগজে সংবিধান আর বাস্তবতার পার্থক্য বুঝিয়ে দেয়।

সংবিধান সংশোধন নিয়ে বাংলাদেশের বিখ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক প্রায় সময়ই বলেন সংবিধানের বেশিরভাগ সংশোধনী আনা হয়েছে ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তি এবং দলের রাজনৈতিক স্বার্থে।

আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা তাদের প্রয়োজনে সংবিধানের ৭০(খ) (নিজ দলের বিপক্ষে ভোট প্রদান করলে আসন শূন্য হবে) অনুচ্ছেদ যুক্ত করে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অনুচ্ছেদ ১১ কে কার্যত অস্বীকার করেছে। আমাদের সংবিধানের ৩য় ভাগের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ৩২ এ জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকাররক্ষণ সংক্রান্ত বিধিতে জীবনের অধিকার বলতে অসুস্থ হলে সুচিকিৎসা পাওয়া সাপেক্ষে সুস্থ থাকা বুঝালেও আমাদের রাজনীতিবিদরা খুবই চতুরতার সহিত সেটিকে সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে প্রোগ্রাম রাইটস হিসেবে রেখে দিয়েছে।

আমাদের সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে ন্যায় পাল নিয়োগের বিষয়ে বলা থাকলেও স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসেও আমাদের দেশের কোন রাজনৈতিক দল সাংবিধানিক এই পদে কাউকে নিয়োগ দেয় নি কারণ তাদের হরিলুটের মহাযজ্ঞে রাবণের দর্শন চান না। তারা প্রতিজ্ঞা করেই নিয়েছে শহর জুড়ে মিছিল নামবে, আকাশ ভেঙ্গে বর্ষা, দুর্নীতির বাতাস বয়বে, সংবিধান কে করবে ঝাপসা।

ব্রিটিশদের হাতে ১৯০ আর পাকিস্তানিদের কাছে প্রায় ২৪ বছর নির্মমভাবে শাসিত হওয়ার পরও আমরা স্বাধীন নাগরিক হিসেবে স্বাধীন দেশে বাস করার স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমাদের লালিত স্বপ্নকে আমরা বাস্তবিক রূপ দান করেছি। বিশ্ব ইতিহাসে আমরা কম সময়ে আমাদের সংবিধান প্রণয়ন করতে পেরেছি।

আমরা এখনো নিত্য স্বপ্ন দেখি আমাদের সংবিধান থেকে অনুচ্ছেদ ৩৩ এর উপ-অনুচ্ছেদ ৩,৪,৫ কে বাতিল করা হবে, ৭০(খ) কে চিরতরে সংবিধান থেকে মুক্তি দেওয়া হবে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম হবে, ন্যায়পাল নিয়োগের মাধ্যমে সকল দুর্নীতির অবসান ঘটবে, প্রজাতন্ত্রের নাগরিক হিসেবে প্রকৃত অর্থেই রাষ্ট্রের নাগরিকরা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবে, বিচার বিভাগ তার প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করবে, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করে এ সবুজ শ্যামল স্বাধীন বাংলাদেশের জঠরে দেশের প্রকৃত মালিক হিসেবে জনগণকে সবসময় নিরাপদ আশ্রয় দিবে।

লেখক: এম. তাওহিদ হোসেন; শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়।