দীপজয় বড়ুয়া: সাধারণত মামলার পক্ষগণ তাদের নিজ বক্তব্যের সমর্থনে সাক্ষী উপস্থাপন করেন। স্বাভাবিক ভাবেই যে পক্ষ কোন সাক্ষীকে উপস্থাপন করেন, সাক্ষী সেই পক্ষকে সমর্থন করে সাক্ষ্য দিবে, এটাই হচ্ছে প্রত্যাশা। কিন্তু, যখন কোন সাক্ষী তাকে তলব করা পক্ষের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়, তখন তাকে বলা হয়ে থাকে Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী বা প্রতিকূল সাক্ষী। এই ধরণের পরিস্থিতিতে আহ্বানকারী পক্ষ সেই সাক্ষীকে বৈরী বলে ঘোষণা করতে পারেন এবং তাকে জেরা করার অনুমতি চাইতে পারেন।
প্রখ্যাত আইনবিদ বেন্থামের মতে, ‘witnesses are the eyes and ears of justice’ যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘সাক্ষীরা হচ্ছে চোখ ও কান, যার মাধ্যমে বিচারক তথা আদালত দেখতে পায় যে কে অপরাধ করেছে (guilty) আর কে নির্দোষ (innocent)। এখন এই সাক্ষীদের মধ্যে একটি ক্যাটাগরি আছে যাদের বলা হয়ে থাকে Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী। আজকের পর্বে আমরা জানার চেষ্টা করবো, কারা Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী আর কেনই বা তাদেরকে Hostile witness / বৈরী সাক্ষী বলা হয়ে থাকে।
সাক্ষ্য আইনে বৈরী সাক্ষীর কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। তবে সাক্ষ্য আইনের ১৫৪ ধারার বিধান মতে স্বীয় সাক্ষীকে বিরুদ্ধ পক্ষের মত জেরা করার বিধান আছে। আদালতের প্রচলিত ভাষায় স্বীয় সাক্ষীকে জেরা করার পুর্বে শত্রু বা বৈরী সাক্ষী বলা হয়। বৈরী সাক্ষীকে জেরা করতে হলে আদালতের অনুমতি নিতে হয়। আদালত যদি মনে করেন যে আহ্বানকারী পক্ষের প্রতি সাক্ষীর মেজাজ বিগড়ে গেছে বা আচরণ বৈরী হয়ে গেছে বা কথাবার্তা শত্রু পক্ষের মত হয়ে গেছে, তাহলে আদালত আহ্বানকারী পক্ষকে বিরুদ্ধ পক্ষের ন্যায় তার নিজ সাক্ষীকে জেরা করার অনুমতি দিতে পারেন। সাক্ষীকে জেরা করতে দেওয়ার অধিকার আদলতের বিবেচনার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী সম্পর্কে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলার সিদ্ধান্ত নিম্নরূপ
39 DLR(AD)166 The State Vs. Fazal মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ The prosecution failed to re-examine the witness to get over this damaging statement. Discovery of body of person murdered not absolutely necessary.
50 DLR 490 Bulbul Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ Court may in its discretion permit a party to put questions to its witness which are usually put it in cross-examination by the adverse party.
44 DLR(AD)10 Babor Ali Molla & Others Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ Evidence by eye-witness-Vital omission in FIR and statement to the Investigation Officer make their substantive evidence unreliable.
5 BCR(AD)315 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ বৈরী ঘোষিত সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা সম্বন্ধে আদালত সন্তুষ্ট হইলে তাহার সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করা যাইবে”।
11 DLR 316 Fazlul Haque Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “কোন সাক্ষীকে তাহার আহবানকারীপক্ষ কর্তৃক জেরা করা হইলে তাহার সাক্ষ্য সমুদয় বা আংশিক অগ্রাহ্য হইতে পারে না বরং তাহার সমুদয় সাক্ষ্য যাহা উভয় পক্ষের সমর্থনে বা বিরুদ্ধে যাক না কেন এবং তাহার মূল্য যাচাই হোক না কেন তাহা অন্যান্য সাক্ষীদের সাক্ষ্যের ন্যায় মূল্যায়ন করিতে হইবে”।
Sir JP. wailed coals Vs. kalls & bro(1866) LRP& D 71 মামলার রায়ে বলা হয় যে, একজন Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী/প্রতিকূল সাক্ষী হচ্ছেন এমন একজন সাক্ষী, যিনি তার সাক্ষ্য দেওয়ার পদ্ধতি থেকে দেখান যে, তিনি আদালতে সত্য বলতে চান না। অর্থাৎ, Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী /প্রতিকূল সাক্ষী আদালতকে দেখাতে চান যে, আদালতে যে কারণে বা যে সাক্ষ্য দিতে আনয়ন করা হয়েছে তিনি সেই বিষয়ে আদালতকে সত্য বলতে ইচ্ছুক নন।
JS Boxi Vs. The State মামলার রায়ে বলা হয় যে, Hostile বা বৈরী বা প্রতিকূলতার অনুমানটি সাক্ষীর দেওয়া উত্তর থেকে এবং কিছুটা তার আচার-আচরণ থেকে অনুমান করা হয়। সুতরাং, একজন সাক্ষী যখন তাকে সাক্ষী দেওয়ার জন্য আহ্বানকারী পক্ষের প্রতি তার মনোভাবের বিরোধী হয় বা যখন সে তা আড়াল করে, তখন তাকে Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী / প্রতিকূল সাক্ষী হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
আবার ব্যতিক্রমধর্মী নজিরও রয়েছে। সাক্ষী আনয়নকারী পক্ষের স্বার্থে সাক্ষ্য না দিলেই যে একজন সাক্ষী Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী বা প্রতিকূল সাক্ষী হয়ে যাবে, তা কিন্তু নয়।
RK Dey Vs. The Odissa State- মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “একজন সাক্ষী যদি সত্য কথা বলেন এবং তার সাক্ষ্য তাকে আহ্বানকারী পক্ষের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, তবে তা একজন সাক্ষীর Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী বা প্রতিকূল সাক্ষী হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। একজন সাক্ষীর প্রাথমিক আনুগত্য হচ্ছে, সত্যের প্রতি, তাকে আহ্বানকারী পক্ষের প্রতি নয়। তাই, শুধুমাত্র Hostile বা বৈরী বা প্রতিকূল সাক্ষ্য একজন সাক্ষীকে Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী বা প্রতিকূল সাক্ষী ঘোষণা করে না”।
28 DLR 192 Faruk Vs. The State- মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ফরিয়াদী পক্ষ নিজ সাক্ষীকে বৈরী ঘোষণাক্রমে জেরা করিতে পারে এবং সেই কারণে উক্ত সাক্ষীর সাক্ষ্য অসত্য বা মূল্যহীন বলে আদালত গণ্য করিতে পারেন না। আদালতকে সাক্ষ্যের গুরুত্ব বিবেচনা করিতে হইবে”।
6 BCR 1986(AD) 212 Maahiruddin Vs.The State- মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ ঘটনার একমাত্র সাক্ষী যিনি নিজেও আক্রান্ত হইয়াছেন।তিনি জবানবন্দীকালীন সম্পূর্ণ বিপরীত বক্তব্য রাখায় তাহাকে বৈরী ঘোষণা জেরা করা হয় যে, তিনি অপরাধীপক্ষ কর্তৃক লাভবান হইয়া মিথ্যা বলছেন, এই উক্তি স্বীকার করেন তথাপি ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারা অনুসারে প্রদত্ত বিবৃতি বিবেচনাযোগ্য”।
সুতরাং বলা যায় যে, Hostile witness বা বৈরী সাক্ষী বা প্রতিকূল সাক্ষী অর্থ হল যে পক্ষ কোন সাক্ষীকে উপস্থাপন করেন, সাক্ষী সেই পক্ষকে সমর্থন করে সাক্ষ্য দিবে, এটাই হচ্ছে প্রত্যাশা। কিন্তু, যখন কোন সাক্ষী তাকে তলব করা পক্ষের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়, তখন তাকে বলা হয়ে থাকে বৈরূ সাক্ষী বলে।
তথ্যসূত্র
আইন শব্দসমূহ-এডভোকেট মোঃ নাসির উদ্দিন, সাক্ষ্য আইনের ভাষ্য- গাজী মোঃ শামসুর রহমান, উইকিপিডিয়া,jjdn, দন্ডবিধি- বাসুদেব গাংগুলি, উকিপিডিয়া, সাক্ষ্য আইন- বাসুদেব গাংগুলি, সাক্ষ্য আইন- মোঃ জহিরুল হক, ফৌজদারী কার্যবিধি-জহিরুল হক, Section Wise 100 years Reference on Crpc, Section Wise 100 years Reference on Penal Code- Md. Abul Kalam Azad। Section Wise 100 years Reference Evidence Act- Mohammed Safiqur Rahman.
লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।