ঢাকার একটি আদালতে দেওয়ানি মামলার বিচারকাজ চলছিল। সেখানেই বাদী সেজে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করতে গিয়ে ধরা পড়েন পরিমল মন্ডল নামের এক ব্যক্তি। মামলার প্রকৃত বাদী লালচান আলীর রূপ ধারণ করে আদালতের চোখে ধুলো দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় দুই বছরের কারাদণ্ড হয় পরিমলের। তবে এ মামলায় খালাস পান অন্য দুই আসামি নাসির উদ্দিন মল্লিক ও লিয়াকত আলী।
ঘটনার সূত্রপাত ২০১৭ সালের ২৬ নভেম্বর। ওইদিন আদালতে জবানবন্দিতে পরিমল জানান, গাড়িভাড়া ও খাবারের টাকার বিনিময়ে তাকে ও নাসিরকে যথাক্রমে মিথ্যা বাদী ও সাক্ষী সাজতে প্ররোচিত করেন লিয়াকত।
এ ঘটনায় পরিমলসহ তিনজনের বিরুদ্ধে রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় মামলা করা হয়। মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পরিমলের দুই বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন। কারাদণ্ডের পাশাপাশি দুই হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও দুই মাসের কারাভোগের আদেশ দেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৬ নভেম্বর ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ প্রথম আদালতের একটি দেওয়ানি মামলার বাদী হিসেবে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন পরিমল। মামলাটির প্রকৃত বাদী ছিলেন লালচান আলী। আদালতে লালচানের ভোটার আইডিও দাখিল করেন পরিমল।
জবানবন্দি নেওয়ার সময় ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ আদালতের বিচারক উৎপল ভট্টাচার্যের কাছে বাদী ও সাক্ষীর কথাবার্তা অসংলগ্ন এবং সন্দেহজনক মনে হয়। এসময় আদালত পরিমলকে তার নাম ও বাবার নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়েন।
একপর্যায়ে আদালত পরিমলকে জোরালোভাবে তার পরিচয় প্রকাশের জন্য চাপ দিলে তিনি আদালতের কাছে স্বীকার করেন যে, গাড়িভাড়া ও খাবারের টাকার বিনিময়ে বাদী লালচানের রূপ ধারণ করেছেন তিনি।
এ ঘটনায় আদালতের সেরেস্তাদার জাহাঙ্গীর হোসেন পরিমলসহ তিনজনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। মামলার অন্য দুই আসামি হলেন নাসির উদ্দিন মল্লিক ও লিয়াকত আলী।
মামলাটি দীর্ঘ তদন্ত শেষে তিনজনের বিরুদ্ধে ঘটনার সত্যতা পেয়ে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। তিনজনের মধ্যে লিয়াকত আলীকে অব্যাহতি দেন আদালত। অন্য দুই আসামি পরিমল ও নাসিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেওয়া হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন আসামি পরিমলের দুই বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেন। নাসিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দেওয়া হয়।
পাঁচ বিবাদী মারা গেছেন, ভবিষ্যতে ফলের আশা নেই
মামলা প্রত্যাহারের আবেদনে লালচানের রূপ নেওয়া পরিমল আদালতে বিবাদীদের বিরুদ্ধে উল্লেখিত মোকদ্দমা দায়ের করে স্বত্ব ঘোষণা ডিক্রির প্রার্থনা করেন। মামলা দায়েরের পর ১-৩ নম্বর বিবাদীরা তাদের মালিকানার বিষয়ে উল্লেখ করে জবাব দাখিল করেন।
মামলায় যাদের বিবাদী করা হয়েছে তাদের মধ্যে খন্দকার আব্দুল রশিদ, আব্দুর রহিম, খন্দকার আব্দুল রাজ্জাক, খন্দকার ফজলুর রহমান ও রহিমা খাতুন মামলা দায়েরের আগেই মারা গেছেন। বাদীপক্ষ মামলা পরিচালনা করলেও ভবিষ্যতে কোনো ভালো ফল লাভের আশা নেই।
মামলার এজাহারে বর্ণিত সম্পত্তিতে বাদীপক্ষের কোনো প্রকার মালিকানা স্বত্ব ও দাবি-দাওয়া নেই। ভবিষ্যতে কোনো দাবি-দাওয়া করাও হবে না। যদি করা হয় তবে তা সব আদালতে অগ্রাহ্য ও বাতিল বলে গণ্য হবে।
মিথ্যাভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে অন্যের রূপ ধারণ
২০১৮ সালের ১৪ মে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তিনজনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন পরিমল মন্ডল, নাসির উদ্দিন ও লিয়াকত আলী।
মামলার চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার এসআই হাফিজুর রহমান উল্লেখ করেন, বিবাদী পরিমল মন্ডল ও নাসির উদ্দিন মল্লিক অন্য বিবাদী লিয়াকত আলীর প্ররোচনায় যুগ্ম জেলা জজ প্রথম আদালতে হাজির হন। এসময় বিবাদী পরিমল নিজেকে লালচান দাবি করেন এবং বিবাদী নাসির সাক্ষী হিসেবে আদালতে সশরীরে উপস্থিত হয়ে নিজেকে উপস্থাপন করেন।
শুনানিতে বিবাদী পরিমল ও সাক্ষী নাসিরের কথাবার্তা আদালতের কাছে সন্দেহজনক মনে হয়। তখন আদালত বিবাদী পরিমলকে তার নাম ও বাবার নাম জিজ্ঞাসা করেন। এতে পরিমল কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন। প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিতে না পারায় আদালতের চোখে পরিমল সম্পর্কে কিছুটা সন্দেহের উদ্রেক ঘটে।
তখন আদালত কথিত বাদীকে জোরালোভাবে তার পরিচয় প্রকাশ করতে চাপ দিলে একপর্যায়ে পরিমল আদালতের কাছে মূল রহস্য ফাঁস করেন। জানান, টাকা, গাড়িভাড়া ও খাবারের বিনিময়ে তারা এই নকল রূপ ধারণ করেছেন।
ওই মামলায় মিথ্যাভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতেই তারা ভুয়া বাদী ও ভুয়া সাক্ষী সেজেছেন। পরিমল ও নাসির এ-ও জানান, ছদ্মবেশে স্বীকারোক্তি দিতে অর্থের বিনিময়ে তিন নম্বর বিবাদী লিয়াকত আলীর প্ররোচনায় তারা আদালতে উপস্থিত হয়েছেন।
বিবাদী পরিমল ও নাসির অন্যের রূপ ধারণ করে ভুয়া পরিচয়ে আদালতে উপস্থিত হয়ে বাদী ও সাক্ষী সেজে সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়ে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। দেওয়ানি মামলায় মিথ্যাভাবে প্রকৃত বাদী লালচানের রূপ নিয়ে এবং অনুরূপ স্বীকারোক্তি দিতে আসামি লিয়াকত অর্থের বিনিময়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করেন। তাই আসামি পরিমল, নাসির ও লিয়াকতের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪১৭/৪১৯/১০৯ ধারার অপরাধ প্রাথমিকভাবে সত্য বলে প্রমাণ হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধ চার্জশিট দাখিল করা হয়।
সাক্ষীর বয়সের ব্যবধান ধরা পড়ে আদালতের চোখে
মামলার বাদী না হয়েও মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করার অভিযোগে ২০১৭ সালের ২৬ নভেম্বর রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ প্রথম আদালতের সেরেস্তাদার জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলার আসামি করা হয় তিনজনকে। আসামিরা হলেন পরিমল মন্ডল (৪৮), নাসির উদ্দিন মল্লিক (৬২) ও লিয়াকত আলী।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, আদালতে দেওয়ানি (৬২৭/১৫) মামলাটি বিচারাধীন হওয়ায় শুনানি চলাকালে বাদীপক্ষের আইনজীবী এস এস রহিম উদ্দিনের (মঙ্গল চৌধুরী) মাধ্যমে প্রত্যাহারের দরখাস্ত আসে। পি/ডব্লিউ-১(মামলার বাদী) হিসেবে লালচান জবানবন্দি প্রদান শুরু করলে বাবার নাম সঠিকভাবে বলতে না পারায় এবং দাখিল করা ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপির সঙ্গে সাক্ষীর বয়সের ব্যবধান পরিলক্ষিত হওয়ায় সাক্ষ্যগ্রহণ বন্ধ করে দেন আদালত।
আদালত পরিমলকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি তার নাম লালচান অর্থাৎ মামলার বাদী নয় বলে স্বীকার করেন। পরে আদালতের কার্যক্রম মুলতবি করে লালচান আলী (কথিত লালচান আলী) এবং অন্য সাক্ষী নাসির উদ্দিনকে আদালত পুলিশের সহায়তায় খাস কামড়ায় জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা উভয়েই বিবাদী লিয়াকতের প্ররোচনায় নিজেদের ‘ভুয়া’ বলে স্বীকার করেন। এসময় তারা এ স্বীকারোক্তির সমর্থনে আদালতে জবানবন্দি দেন।
জবানবন্দিতে মামলা প্রত্যাহারে স্বাক্ষরকারী লালচান আলী স্বীকার করেন, তার প্রকৃত নাম পরিমল মন্ডল, পিতা-গঙ্গা চরণ মন্ডল। সাক্ষী নাসির উদ্দিন মল্লিক স্বীকার করেন, বিবাদী লিয়াকত তাদের টাকার বিনিময়ে মিথ্যা সাক্ষী ও বাদী সাজিয়ে আদালতে হাজির করেছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল বলেন, অন্যের রূপ ধারণ করে মামলা প্রত্যাহার করতে গিয়ে গ্রেফতার হন পরিমল। তার বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়। এ মামলায় তার দুই বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত।
মামলার বাদী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আদালতে দেওয়ানি (৬২৭/১৫) মামলাটি বিচারাধীন হওয়ায় শুনানি চলাকালে আইনজীবীর মাধ্যমে মামলা প্রত্যাহারের দরখাস্ত আসে। মামলার বাদী হিসেবে লালচান জবানবন্দি দেওয়া শুরু করলে আদালতের জিজ্ঞাসাবাদে নিজের বাবার নাম সঠিকভাবে বলতে না পারায় এবং দাখিল করা ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপির সঙ্গে সাক্ষী নাসিরের বয়সের ব্যবধান পরিলক্ষিত হওয়ায় সাক্ষ্যগ্রহণ বন্ধ করে দেন আদালত।
পরে আদালত পুলিশের সহায়তায় খাস কামড়ায় তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে উভয়ই টাকার বিনিময়ে ভুয়া বাদী ও সাক্ষীর রূপ নিয়েছেন বলে আদালতে স্বীকার করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে তাদের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করা হয়।