পুরান ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী সাইফুদ্দিন মোহাম্মদ এমদাদকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ—অভিনেতা, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, অধ্যাপকসহ মোট ২০১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলাটি তদন্তের জন্য গত বুধবার (৩০ এপ্রিল) শাহবাগ থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত।
১৪ জন অভিনেতা আসামির তালিকায়
এই মামলায় চলচ্চিত্র ও নাট্যাঙ্গনের ১৪ জন তারকা অভিনেতা আসামি হয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন:
-
মামুনুর রশীদ
-
চঞ্চল চৌধুরী
-
রিয়াজ
-
ফেরদৌস
-
আশনা হাবীব ভাবনা
-
সাজু খাদেম
-
জায়েদ খান
-
রোকেয়া প্রাচী
-
মেহের আফরোজ শাওন
-
অরুনা বিশ্বাস
-
জ্যোতিকা জ্যোতি
-
শামীমা তুষ্টি
-
শমী কায়সার
-
সোহানা সাবা
মামলার প্রেক্ষাপট
গত ২০ মার্চ ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলার আবেদন করেন এম এ হাশেম রাজু। তিনি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনের বাংলাদেশ বিষয়ে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে রয়েছেন। পাশাপাশি তিনি ফ্যাসিবাদ উৎখাত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট, রাজধানীর শহীদ মিনার থেকে একটি “অসহযোগ আন্দোলন” কর্মসূচির মিছিল পরীবাগ এলাকায় গেলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের হামলায় আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র সাইফুদ্দিন মোহাম্মদ এমদাদ চোখে গুলিবিদ্ধ হন। মামলার বাদী এম এ হাশেম রাজু দাবি করেন, তিনি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন।
মামলায় বলা হয়, এই হামলার পেছনে শুধু হামলাকারীরা নয়, বরং রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাবিদ মহলের পরিকল্পিত মদদ ছিল। মামলায় বলা হয়, অভিযুক্তরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন বক্তব্য দিয়েছেন, যা হামলা ও সহিংসতাকে উসকে দেয়।
শেখ হাসিনা, মেয়েসহ আওয়ামী শীর্ষ নেতারাও আসামি
এ মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, বাহাউদ্দীন নাসিম-সহ অনেক নেতাকেও আসামি করা হয়েছে।
সাংবাদিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
১৫ জন সাংবাদিক নেতা ও সম্পাদক মামলার আসামির তালিকায় রয়েছেন, তাদের মধ্যে আছেন:
-
ইকবাল সোবহান চৌধুরী
-
আবেদ খান
-
আলমগীর হোসেন (সমকালের সাবেক সম্পাদক)
-
সন্তোষ শর্মা (কালবেলার সম্পাদক)
-
নঈম নিজাম (বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাবেক সম্পাদক)
-
শ্যামল দত্ত (ভোরের কাগজ)
-
মোজাম্মেল হক (৭১ টিভি)
-
মুন্নি সাহা
-
ফরিদা ইয়াসমিন (প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি)
-
মিথিলা ফারজানা
-
মাসুদা ভাট্টি
-
ফারজানা রুপা
সাবেক উপাচার্য ও শিক্ষাবিদদের নামও এজহারে
মামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আক্তারুজ্জামান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য হারুন অর রশীদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ার হোসেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মীজানুর রহমান, চট্টগ্রাম বিশ্ববদ্যিালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুল মান্নান, নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম ওয়াহিদুজ্জামান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও নগরবিদ নজরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, অধ্যাপক আবু জাফর মো. শফিউল আলম, অধ্যাপক মিহির লাল সাহা এবং অধ্যাপক ও লেখক জাফর ইকবালকে আসামি করা হয়েছে।
“আলো আসবে” গ্রুপের বিরুদ্ধে উসকানির অভিযোগ
অভিনেতা রোকেয়া প্রাচী, মেহের আফরোজ শাওনসহ যাদের নাম মামলায় উল্লেখ রয়েছে, তারা আওয়ামী সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের যোদ্ধা। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ ‘আলো আসবে’ গ্রুপে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর হত্যা ও নির্যাতন ‘গ্লোরিফাই’ করতে বিষোদ্গার ছড়ায়।
আরও উল্লেখযোগ্য আসামিরা
-
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
-
ঢাকা ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিম এ খান
-
পিএইচপি গ্রুপ চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমান
-
গণজাগরণ মঞ্চের সাবেক মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার
-
সাবেক জেলা জজ হেলাল চৌধুরী
-
ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি লাকী আক্তার
ভাটারা থানায় আরেকটি মামলা
একই ইস্যুতে গত ২৮ এপ্রিল ভাটারা থানায় আরেকটি হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের হয়, যেখানে সাবেক অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা, চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস, নিপুণ আক্তারসহ ১৭ জন অভিনয়শিল্পীকে আসামি করা হয়।
আদালতের নির্দেশ
ঢাকার সিএমএম আদালত শাহবাগ থানার ওসিকে মামলাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর জখমসংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বাদীর বক্তব্য: “খুনি ও ফ্যাসিস্টমুক্ত বাংলাদেশ চাই”
বাদী এম এ হাশেম রাজু, যিনি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রেসিডেন্ট, জানান:
গত সতেরো বছর শেখ হাসিনার নির্দেশে আমাদের ওপর হামলা মামলা চালানো হয়েছে। আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন করছি। খুনি হাসিনার বিরুদ্ধে আমাদের এই সংগ্রাম চলবে। খুনিরা এখন রাতে ও সকাল ভোরে মিছিল করার চেষ্টা করছে। এদের বিচারের মধ্য দিয়ে আমরা দেশকে খুনি ও ফ্যাসিস্টমুক্ত করবো।
আইনজীবীর বক্তব্য
বাদীপক্ষের আইনজীবী এ বি এম জোবায়ের বলেন,
শেখ হাসিনার আমনে ছাত্রদের আন্দোলনে স্বৈরাচারীর পক্ষে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক ন্যারেটিভ দাড় করিয়েছে সেসকল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষকদের আসামি করা হয়েছে। এছাড়া যেসব চিত্রনাট্যের ব্যক্তিবর্গ যেমন আলো আসবে গ্রুপে শিক্ষার্থীদের ওপর গরম পানি ঢেলে দাও এধরনের প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে হত্যা প্ররোচনা মামলা দেওয়া হয়েছে।