স্বামীর করা যৌতুকের মামলায় স্ত্রী, শ্বশুর শাশুড়ি ও শ্যালকের বিচার শুরু
আদালত ভবন, চট্টগ্রাম

জামিন না দেওয়ায় হট্টগোল, বিচারককে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য

চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে এক নাশকতা মামলার জামিন শুনানিকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার  ঘটে গেল নজিরবিহীন এক ঘটনা। আসামিপক্ষের আইনজীবীদের উত্তপ্ত আচরণ, বিচারকের প্রতি অশালীন মন্তব্য এবং একপর্যায়ে ফাইল ছুড়ে মারা হয় বিচারকের দিকে। পরিস্থিতির চাপে বিচারক অন্তত দুইবার এজলাস ত্যাগে বাধ্য হন।

এই ঘটনার পর আদালত কক্ষজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি সামাল দিতে হস্তক্ষেপ করেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দ ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রসিকিউশন শাখার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

🔹 মামলা ও আসামির পরিচয়

ঘটনাটি ঘটে চট্টগ্রামের সদরঘাট থানায় দায়ের হওয়া একটি নাশকতা মামলার শুনানিতে। মামলায় অভিযুক্ত ছয়জন হলেন:

  • মো. আয়ুব (সভাপতি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম শ্রমিক ইউনিয়ন)

  • হামিদুর রহমান (সাধারণ সম্পাদক)

  • জহির উদ্দিন ওরফে আকবর (সহ-সাধারণ সম্পাদক)

  • ইউসুফ আলী (অর্থ সম্পাদক)

  • বাবু রনি কর (দপ্তর সম্পাদক)

  • রাজীব ধর (সদস্য)

আসামিরা সবাই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী এবং আগে হাইকোর্ট থেকে অন্তর্বর্তী জামিন নিয়েছিলেন। জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় তারা নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।

🔹 কী ঘটেছিল আদালতে?

মামলাটির এজাহারে উল্লেখ করা হয়, জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় চট্টগ্রাম সিটি কলেজ এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার অভিযোগে ভুক্তভোগী মাশফিকুর রহমান শান্ত নামের এক শিক্ষার্থী সদরঘাট থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় অভিযুক্তরা ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে ৮ সপ্তাহের জামিন নেন। গত ১০ এপ্রিল মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিনের আবেদন করেন।

শুনানি শেষে ২৭ এপ্রিল জামিন শুনানির জন্য দিন ধার্য থাকলেও ওইদিন শুনানি হয়নি। পরে আদালতে ৫ মে জামিন শুনানির জন্য দিন ছিল ধার্য ছিল। ৮ মে পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছিলেন আদালত।

নির্ধারিত তারিখ বৃহস্পতিবার আসামিদের পক্ষে জামিন আবেদনের শুনানি করেন অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম, কামরুল হাসান সাজ্জাদ, সফিউল মোর্শেদ, জহুরুল আলম, আবুল কালাম আজাদ, রফিক আহমেদ, সেলিম উদ্দিন শাহীন, ফয়জুল আমিন, দেলোয়ার হোসেন, নেজাম উদ্দিন, ইকবাল হোসেন, রশিদ বিন জাহেদ ও বেলাল হোসেনসহ অনেকেই। তাদের বেশিরভাগই সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবী। এছাড়া বাদীপক্ষের আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট শামসুল আলম ও জিয়াউর রহমান জিয়াসহ জামায়াতপন্থী কয়েকজন।

জামিন আবেদন নামঞ্জুর করার পরপরই আদালত কক্ষে উত্তেজনার সূত্রপাত ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবীরা জানান, আসামিপক্ষের কয়েকজন আইনজীবী বিচারকের প্রতি আপত্তিকর ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন এবং একপর্যায়ে বিচারকের দিকে ফাইল ছুড়ে দেন।

বিচারক মো. হাসানুল ইসলাম পরিস্থিতিতে চরম বিব্রত হয়ে প্রথমবার এজলাস ত্যাগ করেন। এরপর আইনজীবী সমিতির নেতারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। পরে বিচারক দ্বিতীয়বার এজলাসে ফিরলে ফের উত্তেজনা শুরু হয় এবং তাকে আবারও উঠে যেতে হয়।

🔹 আইনজীবীদের বক্তব্য

বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামসুল আলম বলেন,

“আমার দীর্ঘ ওকালতি জীবনে এমন ঘটনা আর দেখিনি। জামিন দেওয়া না দেওয়ার বিষয়ে আদালতের এখতিয়ার রয়েছে। কিন্তু আজকে বিএনপিপন্থি কয়েকজন আইনজীবী বৈষম্যবিরোধী মামলার আসামিদের পক্ষ নিয়ে আদালতে জামিন শুনানি করেন। তাদের আবার বেশিরভাগই সরকারি আইনজীবী। অথচ রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষে সরকারি আইনজীবীরা শুনানি করতে পারেন না। এটির বিধান রয়েছে। আদালতে জামিন নামঞ্জুর করলে বিচারককে ভুয়া এবং উল্টো ফ্যাসিস্টদের দোসর আখ্যা দেয়।”

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সহ-সাধারণ সম্পাদক মো. ফজলুল বারী জানান,

“প্রথম দফা হট্টগোলের খবর পেয়ে আমরা সেক্রেটারির ফোন দেখে মহানগর দায়রা জজ আদালতে যাই। সেখানে আমি বিচারকের খাস কামরায় ঢুকে কথা বলতে চেয়েছিলাম। পরে ভেতরে কে ঢুকবে এটা নিয়েও একটু সমস্যা হওয়ায় আমরা আর ঢুকিনি। পরবর্তীতে আবার বিচারক এজলাসে উঠলে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন।”

🔹 মামলার পেছনের প্রেক্ষাপট

২০২৩ সালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় চট্টগ্রাম সিটি কলেজ এলাকায় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন শিক্ষার্থী মাশফিকুর রহমান শান্ত। এ মামলায় আসামিরা গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে ৮ সপ্তাহের জামিন পান। জামিনের মেয়াদ শেষ হলে তারা নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।

এই মামলার অন্যতম আসামি হামিদুর রহমান গত ১৭ ডিসেম্বর ডিবির হাতে আটক হন। পরে যুবদলের কয়েকজন নেতা তাকে ডিবি কার্যালয় থেকে মুক্ত করে নিয়ে যান বলে অভিযোগ ওঠে। সেই সময় ‘কার নির্দেশে ডিবি থেকে ছাড়া পেলেন হামিদুর?’—শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ঢাকা পোস্ট।