অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

শত্রু সম্পত্তি, অর্পিত সম্পত্তি ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি কী, কেন, কখন কিভাবে?

সিরাজ প্রামাণিক : ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় যেসকল ব্যক্তি পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়, তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি পাকিস্তান সরকার শত্রু সম্পত্তি (এনিমি প্রোপার্টি) হিসেবে ঘোষণা করে। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের নাগরিকদের বা ভারতপন্থী ব্যক্তিদের সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত আয় যাতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত না হয়।

এরপর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৪ সাল থেকে শত্রু সম্পত্তির নতুন নাম দেয়া হয় অর্পিত সম্পত্তি। সরকার এই সম্পত্তির কাস্টডিয়ান হিসেবে কাজ করে, সম্পত্তিগুলো সরকারের কাছে অর্পিত থাকে এবং সরকার এগুলোর প্রশাসন পরিচালনা করে। যদিও মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২৩-০৩-৭৪-এর পরে অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণা বেআইনি মর্মে রায় প্রদান করেছেন, যা ৫৮ ডিএলআর (আপিল্যাট বিভাগ) এ ১৭৭ পৃষ্ঠাসহ অপরাপর প্রকাশনায় নজির হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।

আর পরিত্যক্ত সম্পত্তি হচ্ছে যেসব ব্যক্তি ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর পরে বাংলাদেশে ছিলেন না, অথবা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর পরে আর ফিরে আসেননি, বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেননি তাদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তিকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি বলা হয়। এসব সম্পত্তির মালিকানা সরাসরি বাংলাদেশের সরকারের কাছে চলে যায় এবং সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়।

অনেকে অর্পিত সম্পত্তি ও পরিত্যক্ত সম্পত্তিকে একই ধরনের মনে করেন, যা প্রকৃতপক্ষে ভুল। অর্পিত সম্পত্তি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়, আর পরিত্যক্ত সম্পত্তি সাধারণত কোর্ট অফ সেটেলমেন্ট বা অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। অর্পিত সম্পত্তির মূল মালিক বা তাদের বৈধ উত্তরাধিকারীর কাছে ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন তৈরী হয়। এর মধ্যে ‘ক’ তফসিলে বর্ণিত অর্পিত সম্পত্তি হচ্ছে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা অর্পিত সম্পত্তি। প্রকৃত মালিকেরা চাইলে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলা করে এগুলো ফেরত পাওয়ার আবেদন করতে পারেন।

আরও পড়ুন : অর্পিত সম্পত্তির ধারণা, ইতিহাস ও অবমুক্তকরণ প্রক্রিয়ার বাস্তবিক প্রেক্ষাপট

‘খ’ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত সম্পত্তিগুলো যেগুলো কাগজে অর্পিত হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেও বাস্তবে বহু বছর ধরে সাধারণ মানুষের দখলে ও মালিকানায় ছিল। সরকার এই তালিকা বাতিল করেছে, ফলে বর্তমানে ‘খ’ তফসিলভুক্ত সম্পত্তি সাধারণ জমির মতোই নামজারি ও হস্তান্তরযোগ্য। এতে আইনগত কোনো বাঁধা নেই।

অর্পিত সম্পত্তি বিষয়ক এক রায়ে মহামান্য হাইকোর্ট বলেছেন যেসব অর্পিত সম্পত্তির আইনগত দাবিদার নেই, সে সম্পদ শুধু মানবিক উন্নয়নকাজে ব্যবহার করতে হবে। ল্যান্ড সাভে ট্রাইবুন্যালে নির্ধারিত সময়ের পর প্রার্থীর বাদী হিসেবে এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে ঘোষণামূলক মামলা আনয়ন করতে কোনো আইনগত বাঁধা নেই। সেক্ষেত্রে বিজ্ঞ বিচারিক আদালত কিছু আইন, নির্বাহী আদেশ ও উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে উক্ত মামলা নিষ্পত্তি করতে পারবেন।

আর শত্রু সম্পত্তি আইন সম্পর্কে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য আপিল বিভাগ ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট তারিখে সাজু হোসেন বনাম বাংলাদেশ (৫৮ ডিএলআর, পেজ ১৭৭) মামলায় বলেছেন ‘শত্রু সম্পত্তি একটি মৃত আইন, এর ভিত্তিতে নতুন করে কোনও সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণা করাও বেআইনি।

বর্তমান প্রত্যর্পণযোগ্য বা হস্তান্তরযোগ্য সরকারের দখলে থাকা ‘ক’ তালিকাভুক্ত সম্পত্তির পরিমাণ এখনও এক লাখ ৮৯ হাজার ৬৬২ একর। এ জমির দাবীদারগণ জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করে লীজ নিয়ে ব্যবহার করতে পারেন।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইনগবেষক। ইমেইল : seraj.pramanik@gmail.com