বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া

রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নয়, আইনি লড়াইই বেছে নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া: শেষ পর্যন্ত বেকসুর খালাস

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা বহুল আলোচিত ‘জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’ মামলার সাত বছরের দণ্ড এবং ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট’ মামলার ১০ বছরের দণ্ড রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতায় মওকুফ করা হয়েছিল। তবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্ত থাকতে রাজি হননি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবেন।

দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া ও সর্বোচ্চ আদালতে ধারাবাহিক শুনানির পর শেষ পর্যন্ত দুটি মামলাতেই নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে বেকসুর খালাস পান বিএনপি চেয়ারপার্সন।

খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ও ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জানান, রাষ্ট্রপতির দণ্ড মওকুফের পরও কেন আপিল শুনানি চালানো হয়েছে—এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ছিল। তারা বলেন, বেগম খালেদা জিয়া আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। রাষ্ট্রপতির মওকুফে ‘ক্ষমা’র বিষয়টি যুক্ত থাকে, কিন্তু তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে তিনি কোনো অপরাধ করেননি। সে কারণেই তিনি ক্ষমা গ্রহণ না করে আইনজীবীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন আইনি পথেই বিষয়টি মোকাবিলা করতে।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা

২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাটি দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগ আনা হয়। তদন্ত শেষে ২০১২ সালে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে দুদক।

২০১৪ সালের ১৯ মার্চ মামলাটিতে অভিযোগ গঠন করা হয়। এরপর ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক মো. আখতারুজ্জামান রায়ে খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন।

একই সাজা দেওয়া হয় মামলার অপর তিন আসামি—প্রয়াত হারিছ চৌধুরী, জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খানকে। দণ্ডের বিরুদ্ধে তারা হাইকোর্টে আপিল করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০২৪ সালের ২৭ নভেম্বর বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ খালেদা জিয়াসহ সবাইকে খালাস দেন।

পরবর্তীতে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদক আপিল বিভাগের কাছে লিভ টু আপিল দায়ের করলে ২০২৫ সালের ৩ মার্চ আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেন। এর মধ্য দিয়ে চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার আইনি প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ঘটে।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক মো. আখতারুজ্জামান জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন। একই সঙ্গে তারেক রহমানসহ অপর পাঁচ আসামিকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এই রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া হাইকোর্টে আপিল করেন। অপরদিকে দুদক সাজা বাড়ানোর আবেদন জানায়। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্ট খালেদা জিয়ার সাজা পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর করেন।

দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের একপর্যায়ে ২০২৪ সালের ১১ নভেম্বর আপিল বিভাগ হাইকোর্টের সাজার কার্যকারিতা স্থগিত করেন। সর্বশেষ ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে খালেদা জিয়াকে খালাস প্রদান করেন।

রায়ের পর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, পুরো মামলাটিই ছিল একটি ‘ম্যালিসাস প্রসিকিউশন’ বা বিদ্বেষমূলক বিচার প্রক্রিয়া। আপিল বিভাগ বিচারিক আদালত ও হাইকোর্ট বিভাগের আগের রায় বাতিল করেছেন। যারা আপিল করতে পারেননি, যেমন তারেক রহমান ও কামাল সিদ্দিকী—আদালত তাদেরও খালাস দিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, যে মামলায় কোনো সারবত্তাই ছিল না, সেই মামলায় হাইকোর্ট সাজা পাঁচ বছর থেকে ১০ বছর করেছিলেন, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তার ভাষায়, ফ্যাসিস্ট সরকার যেভাবে চাইত সেভাবেই তখন রায় হতো। এই রায়ে মনে হয়েছে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করেছে।

দুদকের আইনজীবী আসিফ হাসানও আদালতের রায় নিশ্চিত করে বলেন, মামলাটি প্রতিহিংসামূলক হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে খালাস দেওয়া হয়েছে।