মনিরা নাজমী জাহান: বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির ফলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। মানুষের জীবনে এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে তথ্য প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগেনি। পৃথিবীর এমন কোন প্রান্ত পাওয়া যাবে না যেখানে এই তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন চোখে পড়বে না। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজেও রয়েছে তথ্য প্রযুক্তির ছোঁয়া। মানুষের জীবনের কাজের গতি এবং খরচ দুই-ই কমে গেছে এই তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের কারনে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে বাংলাদেশ। তথ্য প্রযুক্তির এই উন্নয়নের মিছিলে বাংলাদেশ ও শামিল হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ নামক বাস্তবতার উপর ভর করে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের সিঁড়ি বেয়ে।
তবে এই প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনকে ভাল কাজের পাশাপাশি কিছু দুষ্ট চক্র ব্যবহার করছে তাদের অসাধু উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য। আর এই অসাধু চক্রের হাতে পড়ে কিছু মানুষের জীবনে নেমে আসছে ভয়াবহ বিপর্যয়। দুষ্ট চক্র দ্বারা কৃত এমনই এক মরণ ফাদের নাম ‘সেক্সটরশন’। ‘সেক্সটরশন’ নামের মরণ ফাঁদের কবলে পরে পৃথিবীজুড়ে বহু মানুষের জীবনে নেমে এসেছে বিপর্যয়। ‘সেক্সটরশন’ নামের এই মরণ ফাঁদের থাবায় বাংলাদেশের বহু মানুষও আক্রান্ত হয়েছে।
সবার আগে আমরা বুঝার চেষ্টা করি ‘সেক্সটরশন’ বলতে আসলে কি বুঝায়? একটি সময় পর্যন্ত ‘সেক্সটরশন’ বলতে বুঝানো হত কোন সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে যৌন লিপ্সা চরিতার্থ করাকে। কোন উচ্চপদস্থ বা প্রভাবশালী কেউ যদি তার নিম্নপদস্থ বা তার কাছে সাহায্য প্রার্থী কাউকে বিশেষ কোন সুবিধা বা সাহায্য করার বিনিময়ে তার যৌন লিপ্সা চরিতার্থ করতো তাকে ‘সেক্সটরশন’ বুঝানো হত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে নরওয়ের সাবেক মন্ত্রী Svein Ludvigsen সেক্সটরশনের দায়ে ৫ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। একই অপরাধে কানাডায় দণ্ডিত হন কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন আদালতের বিচারক Stevan Ellis।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধের ব্যপকতার বিষয়টি মাথায় রেখে এই ‘সেক্সটরশন’ নামক অপরাধের সংজ্ঞার ব্যপকতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ‘সেক্সটরশন’ নামক ভয়াবহ মরণ ফাঁদটি সাইবার ক্রাইমের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এই ব্যবহার হবার অন্যতম কারণ হচ্ছে বর্তমানে ‘সেক্সটরশনের’ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহত হচ্ছে যৌনতার সাথে সম্পৃক্ত ছবি এবং ভিডিও। এমনকি এই অপরাধের উদ্দেশ্যেও এসেছে ব্যাপকতা। আগে যেখানে শুধু যৌন লিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য এই অপরাধ করা হত কিন্তু বর্তমানে যৌন লিপ্সা চরিতার্থ করা ছাড়াও যোগ হয়েছে ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে ভিকটিমের কাছ থেকে অর্থ আদায় এবং ছবি বা ভিডিও দেখিয়ে ভিকটিমের উপর মানসিক চাপ প্রয়োগ করে ভিকটিমকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। বিভিন্ন ধরণের সামাজিক মাধ্যমের সহজ লভ্যতার কারণে এই ধরণের সাইবার ক্রাইম খুব সহজেই সংগঠিত হচ্ছে। তবে সব চেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে বর্তমানে এই অপরাধ এক দেশে বসে সংগঠিত করে আরেক দেশের জনগণকে ভিকটিম করা হচ্ছে।
ইন্টেলিজেন্স কোম্পানি সেনসিটির এক প্রতিবেদনে জানা যায়, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এক লাখের বেশি নারীর ছবি সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে ভুয়া নগ্ন ছবি তৈরি করা হচ্ছে এবং অনলাইনে তা শেয়ার করা হচ্ছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ব্যবহার করে এসব ছবি থেকে নারী দেহের পোশাক সরিয়ে ফেলা হচ্ছে এবং ম্যাসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের মাধ্যমে নগ্ন ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ সব বিবস্ত্র নারীর অধিকাংশই অল্পবয়সী। কিন্তু যারা এ সব করছে তাদের বেশিরভাগ একে শুধুমাত্র ‘বিনোদন’ হিসেবে বর্ণনা করে থাকে।
“Cyber Sextortion: An Exploratory Analysis of Different Perpetrators Engaging in a Similar Crime,” নামক প্রবন্ধে Roberta Liggett O’Malley and Karen M. Holt ১৫২টি সাইবার সেক্সটরশনের সাথে সম্পৃক্ত ঘটনা নিয়ে গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, সাইবার সেক্সটরশনের সাথে জড়িত মূলত ৪ ধরণের অপরাধী রয়েছে।
এদের মধ্যে প্রথম যে ধরণের অপরাধীর বিষয়ে তারা যা বলেছেন তা হল, এই ধরণের অপরাধীদের মূল টার্গেট হয় সাধারণত ১৮ বছরের নিচের অপ্রাপ্ত বয়স্করা। এই প্রকৃতির অপরাধীরা সাধারণত পেডোফাইল প্রকৃতির হয়ে থাকে এবং এদের যৌন বিকৃতির মূলে থাকে অপ্রাপ্ত বয়স্করা। এরা সাধারণত এই ধরনের অপরাধ করে অপ্রাপ্তবয়স্ক দের সাথে যৌন লিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য অথবা তাদের থেকে অর্থ আদায়ের জন্য।
দ্বিতীয় আরেক ধরনের অপরাধী রয়েছে যারা হ্যাকিং সহ অন্যান্য অনৈতিক উপায়ে ছবি সহ অন্যান্য গোপনীয় তথ্যাদি চুরি করে থাকে। তবে এদের কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে প্রাধান্য দেয় না। এদের ভিকটিম প্রাপ্ত বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক যে কেউ হতে পারে। এদের উদ্দেশ্যও তাদের যৌন লিপ্সা চরিতার্থ করা অথবা তাদের থেকে অর্থ আদায় করা।
তৃতীয় যে অপরাধী থাকে তারা মূলত ভিকটিমের সাথে কোন একটি সময়ে অন্তরঙ্গ বা ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকে। সেই সম্পর্কের জের ধরে তারা সেই ব্যক্তিগত বা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তুলে রাখে এবং পরবর্তীতে সেই ছবি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে ভিকটিমের ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
সর্বশেষ যে ধরণটি তারা দেখিয়েছেন সেই ধরণের অপরাধীদের উদ্দেশ্য থাকে শুধু মাত্র ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় এবং এ ক্ষেত্রে তাদের মূল টার্গেট হয় অর্থশালী ব্যক্তিরা। এই ধরনের অপরাধীরা একটি চক্রের মাধ্যমে অপরাধ সংগঠিত করে এবং অনেক সময় এক দেশে অবস্থান করে আরেক দেশে অপরাধ সংগঠিত করে।
তবে এই ৪ ধরণের অপরাধীর মধ্যে একটি বিষয়ে সাদৃশ্য রয়েছে। এই ধরণের অপরাধীরা সাইবার সেক্সটরশনের মত অপরাধ সংগঠিত করতে গিয়ে আরও বিভিন্ন ধরণের অপরাধ যেমন হ্যাকিং, চাঁদাবাজি, ব্ল্যাকমেইলিং জাতীয় অপরাধও সংগঠিত করে ফেলে।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী পরিষদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর গড়ে ১১ জন নারী সাইবার ক্রাইমের কারণে আত্মহত্যা করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে অনেক ক্ষেত্রে একজন নারী সাইবার সেক্সটরশনের স্বীকার হন তার খুব কাছের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারো দ্বারা। ইদানীং ধর্ষণের ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেবার যে বিকৃত চর্চা শুরু হয়েছে তা সত্যিই ভয়াবহ।
তবে এখানে আরেকটি উল্লেখ করার মত বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে যারা সাইবার সেক্সটরশনের ভিকটিম হয় তারা শুধু ব্ল্যাক মেইলিং বা পূর্ব শত্রুতার কারণে হয় না। একটা বড় অংশ স্ক্যামিং এর শিকার হয়। এই স্ক্যামিংটা হয় মূলত ফিশিং লিংক এর মাধ্যমে! ভিকটিম বয়স বেশীরভাগ ক্ষেত্রে থাকে ১৬-২৫ বছরের মধ্যে এবং তারা জানেই না কিভাবে আইডি হ্যাক হল।
এইবার আলোচনা করা যাক এই সাইবার সেক্সটরশন মোকাবেলার সক্ষমতা নিয়ে। সাইবার সেক্সটরশনের ক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে পেনাল কোড, ১৮৬০ প্রভৃতি আইনের মাধ্যমে আমাদের দেশে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হয়।তবে সাইবার সেক্সটরশনের মোকাবেলায় যে বিষয়টি ভাবিয়ে তুলে তা হচ্ছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা। কারণ যেহেতু অপরাধগুলো অনেক সময় এক দেশ থেকে বসে আরেক দেশে সংগঠিত হয় তাই একটি উন্নত দেশের বাহিনীর সক্ষমতা আরেকটি অনুন্নত দেশের বাহিনীর সক্ষমতা এক নাও হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে বেশ বেগ পেতে হয়।
সম্প্রতি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের একটি কাজ সকল মহলে বেশ প্রশংশিত হয়। তা হল ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি মার্কিন ১৬ বছরের এক কিশোরীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ প্রায় ৮ মাস অনুসন্ধান চালিয়ে ভয়ঙ্কর এক চাইল্ড পর্নোগ্রাফি চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে তারা ৩ জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
এ কথা সত্য যে অনেক ক্ষেত্রে ভিকটিম লোক লজ্জা অথবা মান সম্মানের ভয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট অভিযোগ দায়ের না করে অপরাধীর অনৈতিক দাবির কাছে মাথা নত করে। কিন্তু এতে করে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং অপরাধী প্রশ্রয় পেয়ে দ্বিগুণ গতিতে অপরাধে লিপ্ত হয়। তাই ভিকটিমের উচিৎ অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নেয়া এবং সমাজের উচিৎ ভিকটিমের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িতে তার ন্যায় বিচার নিশ্চিতে সাহায্য করা। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই অপরাধ নিয়ন্ত্রন একেবারেই অসম্ভব।
মনিরা নাজমী জাহান: শিক্ষক, আইন বিভাগ , ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়