মোহাম্মদ শিশির মনির : দুনিয়ার নিয়ম অনুযায়ী মানুষই মানুষের বিচার করে। জেল-জরিমানা-ফাঁসি আরোপ করে। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই এই সাজা আরোপ করা হয়। সাক্ষ্য-প্রমাণের বাইরে গিয়ে কিছু করার সুযোগ থাকে না। মানুষের বিচার আর আল্লাহর বিচারের মধ্যে এটাই তফাৎ। আল্লাহ গায়েব জানেন। মানুষ গায়েব জানে না। সুতরাং সাক্ষ্য-প্রমাণই একমাত্র অবলম্বন। বিচার করতে গিয়ে কখনও কখনও মানুষ অবিচারও করে। জন্ম নেয় ক্ষোভ-জিদ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রতিশোধ স্পৃহা চলতে থাকে। জন্ম হয় নতুন অপরাধের। অনেকটা A-B, B-C, C-A এর মত। বস্তুতঃ ঘুরে ফিরে A, B, C.
সাম্প্রতিক সময়ে বহুল আলোচিত কিছু ঘটনার বিচার হয়েছে বা হচ্ছে। যেমন : নুসরাত হত্যা, আবরার হত্যা, নারায়ণগঞ্জ সাত খুন, আমিন বাজারে শব-ই-বরাতের রাতে হত্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা, রমনার বটমূলে হামলা, ২১ আগস্টের বোমা হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, সিপিবি’র সমাবেশে হামলা, বনানি হোটেলে ধর্ষণ মামলা, ডেসটিনি-হলমার্ক অর্থ কেলেঙ্কারীর বিচার, বঙ্গবন্ধুকে স-পরিবারে হত্যা, জেল হত্যা, ৫ম সংশোধনী মামলা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলা, যুদ্ধপরাধের বিচার, উত্তরায় গার্ডার পরে নিহত (আলোচনা চলছে), ডাক্তারদের বিরুদ্ধে মার্ডার (নথি দেখেছি) মামলা, সারা দেশে মন্দিরে হামলা, রাজনৈতিক কর্মসূচীতে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ ইত্যাদি। বিষয়গুলো গণমাধ্যমে সর্বাধিক আলোচিত।
নিষ্পত্তিকৃত মামলাগুলোর সাক্ষ্য-প্রমাণ দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। এছাড়াও চলমান ঘটনাগুলো গভীরভাবে আইনি পর্যবেক্ষণ/বিশ্লেষণ করার ব্যবস্থাপনা আমাদের চেম্বারে আছে। আমার মনেকরি নিরপেক্ষ ও নির্মোহ দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করার সক্ষমতা ল’ ল্যাব টিম ধারণ করে।
সাক্ষ্য-প্রমাণ পড়ে মনে হয় বিচারের ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও inconsistency and uncertainty রয়েছে। কোন কোন মামলার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত আইনের নীতি মানা হয় নাই। কোন কোন ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ-উদ্দীপনা চোখে পড়ে। কোন কোন ক্ষেত্রে গণহারে ফাঁসির আদেশ দৃশ্যমান। কখনও কখনও আইনের প্রতিষ্ঠিত নীতির আলোকে সাহসী সিদ্ধান্তের ঘাটতি বিরাজমান। কদাচিৎ সাহসিকতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। নিশ্চয়ই মানব জীবনের একটি ঘটনার সাথে আরেকটি ঘটনার শত ভাগ মিল হয় না। বিচার করার ক্ষেত্রে অবশ্যই কিছুটা তফাৎ থাকবে। তাই বলে শত বছর ধরে চলে আশা বিচারিক রীতি বিনষ্ট করে কোন সিদ্ধান্তে আসা উচিত না। এতে আস্থার সংকট তৈরি হয়। সন্দেহ বহুগুণ বেড়ে যায়। আর বিচারের ক্ষেত্রে আস্থা সবচেয়ে বড় বিষয়।
জনমত বিচারের কোন ভিত্তি নয়। বিচারের একমাত্র ভিত্তি হবে আইন ও নজির। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ কারও নেই। যদি কেউ যায় সেটা হবে স্বেচ্ছাচারিতা, খাম-খেয়ালিপনা বা চেয়ারের অপব্যবহার। একজন বিচারক নিজেকে কী হিসেবে পরিচিত করাতে চান সেটা নির্ভর করে তার বিচারিক কর্ম পরিচালনার উপর। অন্যান্য বিচারক-আইনজীবী-নাগরিকগণ তাঁদের সেভাবেই চিহ্নিত করে থাকে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পরে। কোন কোন আদালত মামলার ভিড়ে মুহ্যমান হয়ে যায়। আবার কোন কোন আদালতের কার্যতালিকা ফাঁকা থাকে। এটাই জনগণের তাৎক্ষনিক বিচার।
এ কথা সত্য যে, বিচারকরাও সমাজেরই মানুষ। জনমত তাদেরকে প্রভাবিত করতে পারে। তারাঁও কোন না কোন বিশ্বাস লালন করতে পারেন। এতে দোষের কিছু নাই। তবে বিচার কার্য পরিচালনা করার সময় নিজস্ব বিশ্বাসের প্রাধান্য দেয়া যাবে না। সাক্ষ্য-প্রমাণই প্রাধান্য পাবে। এমনকি ব্যক্তিগতভাবে জানা তথ্যও বিবেচ্য বিষয় নয়। এই নীতির বাইরে যাওয়ার কোন ফুরসত নেই। এই নীতি অমান্য করলে দুনিয়ায় সাময়িক বাহবা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে মহাবিচারের দিন জবাব দেয়ার কোন রাস্তা থাকবে না। একজন বিচারকের এই অনুভূতি তাঁকে মহান করে তোলে। ক্ষণস্থায়ী এই জীবনের মূল্যায়ন সাথে সাথে পাওয়ার আশা করা সঠিক নয়। কালের আবর্তে অনেক কিছুই নতুনভাবে ফুটে উঠে। নায়ক হয়ে যায় ভিলেন আর ভিলেন হয়ে যায় নায়ক।
বিচার করতে গিয়ে অবিচার করলে সমাজে ভয়ঙ্কর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। শুধু বিচারের অভাবেই সামাজিক সংকট তৈরি হয় এমনটি নয়। অনেক সময় অবিচার থেকেও সামাজিক সংকট তৈরি হতে পারে। যেমন ধরুন যাকে ফাঁসি দেয়ার কথা নয় তাকে যদি ফাঁসি দেয়া হয় নিশ্চয়ই তা অবিচার। এক জনের বিচার করতে গিয়ে যদি অন্যজন ফেঁসে যায় সেটিও অবিচার। যার অপরাধ কম তাকে যদি বেশি সাজা দেয়া হয় সেটিও অবিচার। যিনি অপরাধ করেছেন তাকে যদি ছেড়ে দেয়া হয় সেটিও অবিচার। এই ধরনের বিচার/অবিচার থেকে সমাজে গভীর ক্ষতের জন্ম হতে পারে। এর রেশ চলতে থাকে যুগের পর যুগ ধরে। অনেকটা ক্যান্সারের মত সমাজে ছড়িয়ে পরে।
প্রয়োজন ন্যায় বিচারক; সাহসী মানুষের; বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের; শিষ্টাচার সম্পন্ন খোলা মনের মানুষের। পূর্ব ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে বিচার করা এবং উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ন্যায় বিচারের অনিবার্য অনুষঙ্গ। অন্যথায় আপাত অর্থে বিচার করা হলেও দীর্ঘ মেয়াদে ন্যায় বিচার ব্যাহত হবে।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।