প্রবেশন : অপরাধীর শাস্তি নয়, সংশোধন যার লক্ষ্য
সাঈদ আহসান খালিদ; সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বিচারকের বিচার ও সমালোচনা এবং আদালত প্রতিবেদকের দায়

সাঈদ আহসান খালিদ : বিচারকার্যের সমালোচনা কিংবা ভুল ও বেআইনি বিচারের জন্য বিচারকের বিচার করা যাবে কি না- এটি একটি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এটি ঠিক যে, বিচারকার্য সরাসরি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। বিচারিক আদেশের সমালোচনার আইনগত সুযোগের সঙ্গে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও আদালত অবমাননার প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আদালতের সমালোচনা ও অবমাননার মধ্যে “ফাইন লাইন” আঁকা তাই চ্যালেঞ্জিং বটে।

‘মিডিয়া ট্রায়াল’ এদেশে জুডিসিয়াল ট্রায়ালের সমান্তরাল চলে, বিশেষত ‘আলোচিত’ ও ‘চাঞ্চল্যকর’ মামলার ক্ষেত্রে বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপ যখন আদালত প্রতিবেদকদের মাধ্যমে ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় আলোচিত হতে থাকে। অনেক আইনজীবী রয়েছেন যারা টিভি ক্যামেরার পরিবেষ্টনে দাঁড়িয়ে বিচারিক প্রক্রিয়ার এই মিডিয়া ব্রিফিং করা পছন্দ করেন। ফলাফলস্বরূপ, অনেক ক্ষেত্রে মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে জুডিসিয়াল ট্রায়ালের আগেই জনপরিসরে দোষ-নির্দোষ নির্ধারিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে, জনগণ যখন দুই ট্রায়ালের ফলাফলের মধ্যে কন্ট্রাডিকশন দেখতে পায়, তারা হতাশ হয়, ক্ষুদ্ধ হয় এবং বিচারিক প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যা আদালত অবমাননার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

প্রথমত, বিচার কোন নাটক বা সিনেমা নয়। পপুলিস্ট ভিউ বা মিডিয়া ভিউ দিয়ে লিগ্যাল ভিউ-কে পর্যবেক্ষণ করার প্রক্রিয়াটিই একটি গুরুতর গলদ এবং এটি বিপদজনক।

দ্বিতীয়ত, আইন ও বিচার কোন একক ব্যক্তির কাজ নয়, এটি একটি সামষ্টিক প্রক্রিয়ার ফলাফল যেখানে অনেকগুলো পক্ষ যেমন- বাদি, বিবাদী, উভয়পক্ষের আইনজীবী, তদন্তকারী পুলিশ, সাক্ষী, মেডিকেল এভিডেন্স প্রদানকারী চিকিৎসক, বিচার প্রশাসন ও স্বয়ং বিচারক গভীরভাবে বিজড়িত থাকে। এই প্রক্রিয়া বিনি সুতোর মালার মতো এবং পারষ্পরিক নির্ভরশীল। কোন একটি পক্ষের অবহেলায় বা অতি প্রতিক্রিয়ায় পুরো বিচার প্রক্রিয়াটি খারাপভাবে প্রভাবিত হতে পারে।

তৃতীয়ত, আইনের দৃষ্টিতে ‘আলোচিত’, ‘সেনসেশনাল’ বা ‘চাঞ্চল্যকর’ মামলা বলে কিছু নেই। বিচার প্রক্রিয়ায় সব মামলাই সমান যদি না আইন বিশেষভাবে কোন নির্দিষ্ট অপরাধকে বিশেষ আইনে বিচারের অন্তর্ভুক্ত করে থাকে। যেমন, স্পেশাল ল’জ এন্ড ট্রাইব্যুনালস। কিন্তু, সেটিও একটি জেনেরিক বিষয় যেমন, নির্দিষ্টভাবে নারী ও শিশুর ওপর সংঘটিত অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত সব মামলাই আবার আইনের চোখে সমান, একজন যৌনকর্মী আর সমাজের অভিজাত নারীর ন্যায়বিচারের সুযোগ পাওয়ার সেখানে সমান অধিকার।

চতুর্থত, বিচার প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সমস্ত পক্ষই মানুষ; রোবট নয়। মিডিয়া ট্রায়ালের সেনসেশন থেকে অনেকেই যে নিজেদের বিযুক্ত করতে পারে না, আইনগত বিষয়ে নৈর্ব্যক্তিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয় না- এই সীমাবদ্ধতা অস্বীকারের জো নেই। এটি আমাদের কাঙ্ক্ষিত নয় কিন্তু এটি ঘটে। একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা, পাবলিক প্রসিকিউশন বা মেডিকেল এভিডেন্স সরবরাহকারী চিকিৎসক বায়াসড হতে পারেন, কম্প্রোমাইজড হতে পারেন এবং পেশাগত দায়িত্বে অবহেলা করতে পারেন। আইনে সেসবের শাস্তি ও প্রতিকারবিধানের ব্যবস্থা আছে।

পঞ্চমত, কোন বিচারকও ‘বিচারিক বিচ্যুতি’র ঊর্ধ্বে নন। বিচারিক প্রক্রিয়ায় আইনগত ত্রুটি ঘটতে পারে, বিচারক ব্যক্তিগতভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারেন, দুর্নীতিবাজ হতে পারেন, পেশাগত দায়িত্বে অবহেলা করার দোষে দোষীও হতে পারেন। এমনকি, মিডিয়া ট্রায়ালের চাঞ্চল্যে বিচারক নিজেও চঞ্চল হয়ে ওঠে ‘অতি-বিচারিক সক্রিয়তা’ কিংবা ‘অস্বাভাবিক নিষ্ক্রিয়তা’ প্রদর্শন করতে পারেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, এমন বিচারক-কে বিচারের মুখোমুখি করার আইনগত সুযোগ আছে কি না? এটির উত্তর আদালতের স্তর ও বিচারকার্যের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করবে। এটি বৈশ্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, সাধারণত আদালতের বিচারকার্যের জন্য সব স্তরের বিচারক ব্যক্তিগতভাবে দায়মুক্তি লাভের অধিকারী। অর্থাৎ, রায় বা আদেশ দেওয়ার কারণে কোন বিচারকের বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি কার্যধারা গ্রহণ করা যাবে না।

উদাহরণস্বরূপ, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইটালি, ও পোল্যান্ড এর আইন অনুযায়ী বিচারক যদি ইচ্ছেকৃত বেআইনি রায়ও দেন, তিনি সাধারণভাবে ব্যক্তিগত দায়মুক্তি লাভের অধিকারী। তবে স্পেন ও মলডোভা-র আইনানুযায়ী ইচ্ছেকৃত বেআইনি আদেশের কারণে বিচারকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা যায়।

বাংলাদেশের নিম্ন আদালতের বিচারকের ক্ষেত্রে, ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ১৮৫০ সালের The Judicial Officers Protection Act এর ধারা-১ অনুযায়ী, দাপ্তরিক ও বিচারিক কার্যের জন্য কোন বিচারকের বিরুদ্ধে দেওয়ানি আদালতে মামলা করা যাবে না। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি-র ধারা ১৯৭(১) অনুসারে, দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনকালীন কাজের জন্য কোন বিচারকের বিরুদ্ধে সরকারের পূর্বানুমতি ব্যতীত আদালতে মামলা করা যাবে না। এসব বিধানের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে বিচারবিভাগের স্বাধীনতার সুরক্ষাবিধান ও বিচারক যাতে নিশঙ্ক চিত্তে রায় বা আদেশ দিতে পারেন সেটি নিশ্চিত করা।

তবে, বিচারকার্যে আইনগত ত্রুটি ঘটলে বা এখতিয়ার বহির্ভূত ক্ষমতা চর্চা হয়ে থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের উচ্চতর আদালতে আপিল, রিভিউ, রিভিশনের মাধ্যমে সেই রায় বা আদেশ সংশোধনের আইনগত সুযোগ আছে এবং বিচারিক ত্রুটির প্রতিকার বিধানে এটিই সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ও চর্চিত বিধান।

বিচারক নিজে আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন। অফিসিয়াল বিচারকার্যের বাইরে সংঘটিত কোন দেওয়ানি বা ফৌজদারি আইন লংঘনের কারণে বিচারকের বিচার চেয়ে মামলা করার সুযোগ আইনে অবরুদ্ধ নয়। বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা, ২০১৭ অনুযায়ী অসদাচরণ ও দুর্নীতির কারণে নিম্ন আদালতের বিচারকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় অনুসন্ধান এবং বিভাগীয় মামলা রুজু ও সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে দণ্ড আরোপের বিধান রয়েছে, কয়েকটি দৃষ্টান্তও ইতোমধ্যে স্থাপিত হয়েছে।

অধস্তন আদালত কর্তৃক আইনগত এখতিয়ার বহির্ভূত আদেশের কারণে উচ্চ আদালত কর্তৃক সেই বিচারক-কে তলব ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে। তবে, উপরোক্ত আইনি বিধান বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের বিচারকদের জন্য প্রযোজ্য নয়। অধস্তন আদালতের তুলনায় উচ্চ আদালতের বিচারকগণ অধিকতর উন্মুক্ত বিচারিক ডিসিক্রিশান এর অধিকারী। সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য উচ্চ আদালত যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

বিচারিক আদেশ/রায় এর বিরুদ্ধে সমালোচনা করা যাবে কি না?  এটির উত্তর নির্ভর করবে সমালোচনা কে করছে এবং কীভাবে করছে সেটির ওপর। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত “চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্-স্বাধীনতা”-র অধিকার অসীম ও অবাধ নয় বরং যুক্তি-সঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষ যার মধ্যে আদালত-অবমাননাও একটি গ্রাউন্ড। অর্থাৎ, মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে আদালত অবমাননা করা যাবে না।

বিচারকের রায়ে কোন আইনগত ত্রুটি থাকলে, বা ক্ষমতা বহির্ভূত চর্চা হলে সেই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে প্রতিকার চাওয়া যেতে পারে যেখানে আইনজীবীরা উক্ত রায় বা আদেশের ত্রুটি/সমালোচনা তুলে ধরবে ও প্রতিকার চাইবে। কিন্তু আইনজীবী বা অন্য কেউ রায় বা আদেশের কারণে ব্যক্তি বিচারকের সমালোচনা করার অধিকারী নন।

২০১৩ সালের আদালত অবমাননা আইন এর ধারা-২ অনুযায়ী, এমন যে কোন কাজ বা প্রকাশ যা দ্বারা আদালতের কর্তৃত্বকে হেয় করা হয়, কর্তৃত্ব সম্পর্কে অপপ্রচারে করা হয়, জুডিসিয়াল প্রসেস ক্ষুন্ন করা হয় অথবা বিচারাধীন কোন বিষয়ে (sub-judice) হস্তক্ষেপ করা হয়- তা আদালত অবমাননা হিসেবে গণ্য হবে।

তবে এক্ষেত্রে, উক্ত আইনের ধারা-৪ ও ৫ অনুসারে যথাক্রমে নির্দোষ প্রকাশনা বা বিতরণ এবং পক্ষপাতহীন ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ আদালত অবমাননা নয়।

আদালত রায়ে নানা মন্তব্য, পর্যবেক্ষণ দিয়ে থাকেন যা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে আদালতের রিজনিং প্রকাশ করে থাকে, আইনের ভাষায় এটির নাম- Obiter Dictum। এটি রায়ের অংশ কিন্তু বাধ্যকরী নয়। মামলা চলাকালীনও বিচারক বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন ও মন্তব্য করেন যা বিচার প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক অংশ। এসব মন্তব্য বা পর্যবেক্ষণ আদালতের বাইরে প্রকাশ করা অসমীচীন এবং সেটি নিয়ে জনপরিসরে আলোচনা ও সমালোচনা অনাকাঙ্ক্ষিত। রায় ও আদেশের বাধ্যকরী অংশই শুধু প্রকাশ ও আলোচনার বিবেচ্য হতে পারে। আদালতের মন্তব্য ও পর্যবেক্ষণ মামলার সংশ্লিষ্ট পক্ষ, পরবর্তী কোন মামলায় উক্ত সিদ্ধান্ত নজির হিসাবে ব্যবহারকালে কিংবা অ্যাকাডেমিক লিগ্যাল রিসার্চের জন্য প্রাসঙ্গিক হতে পারে- জনবিতর্কের জন্য নয়।

সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, অধস্তন আদালত এমনকি উচ্চ আদালত কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন মন্তব্য ও পর্যবেক্ষণ সংবাদ হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে এবং সেসব চটকদার সংবাদের ভিত্তিতে জনপরিসরে বিচারকের আদেশ নিয়ে সমালোচনা এমনকি বিচারকের প্রতি ব্যক্তি আক্রমণ ঘটছে যা স্পষ্টত আদালত অবমাননা এবং বিচারকের স্বাধীন সত্তার প্রতি হুমকি।

আইন ও বিচার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও পেশাগত অভিজ্ঞতা লাভ না করা জনগণের বড় অংশ ‘আলোচিত বা চাঞ্চল্যকর’ কোন মামলার বিষয়ে পাবলিক প্ল্যাটফর্মে মতামত দেওয়ার সুযোগ পান, মূলত এদেশে বিচারিক প্রক্রিয়ার ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ করার সুযোগ ও প্রবণতার কারণে। এটি বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা (Constructive Criticism) বা নির্দোষ মন্তব্য (Fair Comment) এর পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে আদালত অবমাননায় পরিণত হয়ে যায়৷

এক্ষেত্রে, মিডিয়ায় কর্মরত আদালত প্রতিবেদকদের দায়িত্ব ও ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিচারকের রায়ের বাধ্যকরী অংশের বস্তুনিষ্ঠ ও পক্ষপাতহীন উপস্থাপনা প্রতিবেদকের পেশাগত দায়িত্ব। বিচারকের ব্যক্তিগত পরিচয় ও নাম সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ অনভিপ্রেত। আদালতে বিচারাধীন বিষয়ের গুণাগুণ নিয়ে টিভিতে টক-শোর আয়োজন আইনগতভাবে শাস্তিযোগ্য ঘোষণা করা প্রয়োজন। আইন জানা ও আইনের ডিগ্রিধারী ব্যক্তিরা আদালত প্রতিবেদক হিসেবে নিয়োগ পেলে মিডিয়া ট্রায়ালের এই মচ্ছব কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হবে বলে আশা করা যায়।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।