ভারতের ৪৯তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন বিচারপতি উদয় উমেশ (ইউ ইউ) ললিত। আজ শনিবার (২৭ আগস্ট) তাঁকে শপথ পাঠ করান ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু।
প্রধান বিচারপতি হিসাবে ললিতই দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী থেকে সরাসরি সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের বিচারপতি এবং পরে প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিযুক্ত হলেন। এর আগে ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসে বিচারপতি এসএম সিকরি শীর্ষ আদালতের আইনজীবী থেকে সরাসরি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এবং পরে প্রধান বিচারপতি হন।
তবে প্রধান বিচারপতির পদে ললিতের বেশিদিন থাকা হবে না। মাত্র আড়াই মাস এ পদে থাকবেন তিনি। আগামী ৮ নভেম্বর ললিতের ৬৫ বছর বয়স পূর্ণ হবে। তারপরই অবসর নেবেন তিনি। নিয়ম অনুযায়ী ৬৫ বছরের বেশি বয়সে প্রধান বিচারপতির পদে থাকা যায় না। এর আগে মাত্র চারজন ললিতের থেকে কম সময়ের জন্য প্রধান বিচারপতি পদে ছিলেন।
চলতি মাসের শুরু দিকে নিয়ম মেনেই ভারতের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি ইউ ইউ ললিতের নাম প্রস্তাব করেন সুপ্রিম কোর্টের সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এনভি রমণা। যিনি গতকাল ২৬ অগস্ট অবসরে গেছেন। তাঁর অবসরের পরদিনই দেশের ৪৯তম প্রধান বিচারপতি হিসাবে আজ শপথগ্রহণ করেন ললিত।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
বিচারপতি ললিত ১৯৫৭ সালের ৯ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৩ সালের জুন মাসে তিনি আইনজীবী হিসাবে তালিকাভুক্ত হন এবং ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বম্বে হাই কোর্টের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
১৯৮৬ সালের জানুয়ারিতে তিনি দিল্লি হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এর পর ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে তাঁকে সুপ্রিম কোর্টের তরফ থেকে একজন বরিষ্ঠ আইনজীবী হিসাবে মনোনীত করা হয়।
বিচারপতি ললিত একজন খ্যাতিমান আইনজীবী ছিলেন। ২জি স্পেক্ট্রাম কাণ্ড মামলায় ললিতকে সিবিআই-এর সরকারি আইনজীবী হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছিল।
২০১৪ সালের ১৩ অগস্ট তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন। রমণার উত্তরসূরি হিসাবে ললিত এই মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্টের সব থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারপতি ছিলেন। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় দিয়ে বহু বার খবরের শিরোনামে উঠে এসেছেন ললিত।
বিতর্কিত ‘তিন তালাক’ মামলা
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হওয়ার পর থেকে বিতর্কিত ‘তিন তালাক’ মামলা-সহ একাধিক যুগান্তকারী মামলায় রায় দিয়েছেন ললিত। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারকের সাংবিধানিক বেঞ্চ ২০১৭ সালের অগস্টে ‘তিন তালাক’ প্রথাকে ‘অকার্যকর’, ‘অবৈধ’ এবং ‘অসাংবিধানিক’ বলে রায় দেয়। এই সাংবিধানিক বেঞ্চের সদস্য ছিলেন ললিত। তিন জন বিচারপতি বিশেষ সম্প্রদায়ের এই বিবাহবিচ্ছেদ প্রথার বিপক্ষে রায় দেন। ললিতও রায় দেন বিপক্ষেই।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জে এস খেহার এবং বিচারপতি এস আবদুল নাজির এই রায়কে ছয় মাসের জন্য স্থগিত রাখার পক্ষে ছিলেন। পাশাপাশি এই বিষয়ে সরকারকে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করার কথাও বলেন তাঁরা। তখন বিচারপতি কুরিয়ান জোসেফ, আর এফ নরিমান এবং ললিত এই প্রথাকে ‘সংবিধানের লঙ্ঘন’ বলে উল্লেখ করে এই প্রথার বিপক্ষে রায় দেন।
ঐতিহ্যবাহী পদ্মনাভস্বামী মন্দির মামলা
বিচারপতি ললিতের নেতৃত্বে একটি বেঞ্চ রায় দিয়েছিল, ত্রিবাঙ্কুরের রাজপরিবারেরই কেরলের ঐতিহ্যবাহী পদ্মনাভস্বামী মন্দির পরিচালনার অধিকার রয়েছে। একদা দেশীয় রাজ্য ত্রিবাঙ্কুরের ভারতভুক্তির সময় থেকেই ওই মন্দির পরিচালনার ভার ত্রিবাঙ্কুর রাজপরিবার কর্তৃক নিযুক্ত এক আধিকারিকের হাতে ছিল। তবে ২০০৯ সালে পদ্মনাভস্বামী মন্দির পরিচালনার জন্য ট্রাস্ট গড়ার নির্দেশ চেয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন এক আইনজীবী।
২০১১ সালে কেরল হাইকোর্ট সে রাজ্যের সরকারকে মন্দির এবং মন্দিরের সম্পত্তির দায়িত্ব নেওয়ার জন্য একটি ট্রাস্ট তৈরির নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে ত্রিবাঙ্কুর রাজপরিবার-সহ নানা শিবির। সমগ্র কেরল জুড়ে বিতর্কের ঢেউ ওঠে।
সমগ্র পরিস্থিতি বিচার করে কেরলের তিরুঅনন্তপুরমে পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের পরিচালনার দায়িত্ব ত্রিবাঙ্কুর রাজপরিবারের হাতে রাখার পক্ষে রায় দেন বিচারপতি ললিত। রায়ে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ত্রিবাঙ্কুর রাজপরিবারের প্রয়াত রাজা চিথিরা থিরুনাল বলরাম বর্মার মৃত্যুর পরে পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের সেবায়েত হওয়ার অধিকারী তাঁর ভাই মার্তণ্ড বর্মা এবং তাঁর উত্তরাধিকারীরাই।
পকসো আইনে বিতর্কিত মামলা
২০২১-এর জানুয়ারি মাসে বম্বে হাই কোর্টের নাগপুর বেঞ্চের বিচারপতি পুষ্প গানেদিওয়ালা রায় দিয়েছিলেন, শিশুদের পোশাক খুলে বা জামাকাপড়ের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে তাদের বুক বা গোপনাঙ্গ স্পর্শ না করা হলে ‘শিশুদের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ আইন’ (পকসো) আইনে তাকে যৌন নির্যাতন বলে ধরা হবে না। বোম্বে হাইকোর্টের এই রায় নিয়ে দেশ জুড়ে তোলপাড় পড়ে যায়। বিচারপতি গানেদিওয়ালার রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মামলা করা হয় শীর্ষ আদালতে।
এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে উঠলে বিচারপতি ললিত, বিচারপতি এস রবীন্দ্র ভট্ট এবং বিচারপতি বেলা ত্রিবেদীর বেঞ্চ বম্বে হাই কোর্টের এই রায় খারিজ করে দেয়। সুপ্রিম কোর্ট বম্বে হাই কোর্টের ওই রায়কে ‘অযৌক্তিক’ বলে জানায়, যৌন নিগ্রহের অপরাধের ক্ষেত্রে সরাসরি ত্বকের স্পর্শ জরুরি নয়, যৌন অভিপ্রায় আছে কি না, তা বেশি জরুরি। তিন বিচারপতির বেঞ্চ বম্বে হাই কোর্টের ওই রায়কে ‘সঙ্কীর্ণ পর্যবেক্ষণ’ বলেও উল্লেখ করে।
বাবরি মসজিদ মামলা
রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ মামলার জন্য সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চেও ছিলেন বিচারপতি ললিত। এই বেঞ্চের নেতৃত্বে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। তবে ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি অর্থাৎ যে দিন এই মামলার চূড়ান্ত শুনানি হওয়ার কথা ছিল, সে দিন শুনানির শুরুতেই নিজেকে এই মামলা থেকে সরিয়ে নেন ললিত।
শুনানির শুরুতেই মসজিদ পক্ষের আইনজীবী রাজীব ধওয়ন বিচারপতি ললিতের বেঞ্চের সদস্য থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আইনজীবী ধওয়ন দাবি করেন, ১৯৯৭ সালে বিচারপতি ললিত নিজেও বিতর্কিত বাবরি মসজিদ মামলার আইনজীবী ছিলেন। সে সময় তিনি এক পক্ষের হয়ে মামলাও লড়েছিলেন। তাই বিচারপতি ললিতের বেঞ্চে থাকা উচিত হবে না, বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তাঁর সঙ্গে সহমত হন অন্যান্য বিচারপতিরাও। এরপরই এই সাংবিধানিক বেঞ্চ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন বিচারপতি ললিত। ওই একই বেঞ্চের সদস্য ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি রমণাও।