ব্যারিস্টার গাজী ফরহাদ রেজা : আইনজীবীরা স্বাভাবিকভাবেই মিশুক, কথা বলা পছন্দ করে। দু’জন প্র্যাকটিসিং আইনজীবীর মধ্যকার কথোপকথন অত্যন্ত সাবলীল। কোর্ট-কাছারি, মামলা, মক্কেলের কথা, সারাদিনের কর্মকান্ড, কোন কোর্টে কি রিলিফ দিচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ে পারস্পরিক তথ্য বিনিময় হয় পেশাগত সহজাত স্বভাবজনিত কারণে। তাই খুব সহজেই এই ধরণের আইনজীবী কে বা কারা তা ওই কোর্টে কর্মরত অন্যান্য বেশিরভাগ আইনজীবীর জানা-শোনার মধ্যে থাকে, ক্ষেত্রবিশেষে তৈরি হয় আন্তরিক সেতুবন্ধন।
কোর্টে আমাদের কিছু বিজ্ঞ কলিগ আছেন যারা অন্যত্র বড়/মাঝারি কোম্পানিতে বেতনভুক্ত কর্মচারী। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মামলার ব্যাপারে তাঁরা মাঝে মাঝে কোর্টে আসেন। তবে মামলা সংক্রান্তে এলেও সেটা নিজে করেন না, বরং নিয়মিত প্র্যাকটিসিং আইনজীবীর মাধ্যমে কাজ সারান। সাধারণত আমাদের অনেক আইনজীবী বন্ধু কিছু দিন প্র্যাকটিস করে বা একদম প্র্যাকটিস না করে চাকরি শুরু করেন। এখন প্রশ্ন হলো, তাঁরা এই কাজটি করতে পারেন কিনা? উত্তর হল বার কাউন্সিল আইনে আপনি আইনজীবী হলে আর অন্য পেশা/চাকরী/ব্যবসা করতে পারবেন না। আর যদি করতেই চান, সেক্ষেত্রে আপনার আইনজীবী সনদ স্থগিত রাখার আবেদন করতে হবে ততদিন পর্যন্ত যতদিন না আপনি পূর্ণাঙ্গ আইন পেশায় ফিরছেন।
হঠাৎ করে কেনো এই ইস্যু? বেশ কিছু দিন লক্ষ্য করা যাচ্ছে হাতে গোনা কিছু বিশেষ শ্রেণীর বিজ্ঞ আইনজীবী সনদধারীরা আইন পেশায় না থেকেও আইনজীবী হিসেবে নিজেদের প্রচার করেন এবং অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ধরা যাক, তিনি করেন চাকরী (বার কাউন্সিলের কর্মচারী), কিন্তু একই সাথে তিনি আইনজীবী পরিচয় দেন এবং মামলাও রিসিভ করেন। কেউ কেউ আছেন, যারা আইন পেশায় আছেন কিন্তু নিয়মিত আইনজীবী নন, যেমন: বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক। আমি নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছি, তাই শিক্ষকদের ছোট করে কোনো কথা বলছি না। কিন্তু আইন শিক্ষক ফুলটাইম আইনজীবী নন, ঠিক যেমন আইনজীবী ফুলটাইম আইন শিক্ষক নন। আরো কিছু বিজ্ঞ আইনজীবী আছেন যারা বিভিন্ন কোম্পানির লিগ্যাল টিম লিড করছেন চাকুরীজীবী হিসেবে। কোর্টে কালে ভদ্রে আসেন। আরো কিছু বিজ্ঞ বিভিন্ন চাকুরীতে বিভিন্নভাবে নিয়োজিত। দুঃখজনক হলেও এটা সত্য বার কাউন্সিল আইন অনুযায়ী সেটা অনুমোদিত না।
এই আলোচনার সাথে আর একটি আলোচনা অনেক দিন থেকেই আছে যে, আইনজীবীদের পেশাগত ট্রেনিং এবং অন্যান্য অনেক উন্নত দেশের বারের মত বাৎসরিক বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ (একটি নির্দিষ্ট ঘণ্টার, নির্দিষ্ট বিষয়ের, নির্দিষ্ট প্রসিডিওর এর উপরে ইত্যাদি) দেওয়ার বিষয়ে। প্রতি বৎসর প্র্যাকটিসিং আইনজীবীরা তো বটেই অন্যান্য আইনপেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরাও করতে পারবেন এবং এভাবে তারা পেশায় আপডেট থাকতে পারবেন নিয়মিত কোর্টে না এসেও। এই বিষয়টি কিভাবে করা যাবে সে বিষয়ে কতেক পরামর্শ নিম্নরূপ
ইংল্যান্ডে আমি যখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইনের উপর এলএলএম করছিলাম তখন আমার একজন শিক্ষক ছিলেন। তাঁর নাম মাইকেল ডিভাইন। উনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, কিন্তু যুক্তরাজ্যের ব্যারিস্টার। তবে উনি ফুলটাইম শিক্ষকতা করেন। পাশাপাশি উনি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিরোধ নিয়েও কাজ করতেন। তাঁর কাছে শুনেছি, প্রতিবৎসর তাঁকে একটি নির্দিষ্ট ঘণ্টার ট্রেনিং নিতে হত লিগ্যাল প্রফেশনে আপডেট থাকার জন্য। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই ইংল্যান্ডের ব্যারিস্টার হিসেবে প্র্যাকটিস করার লাইসেন্স রিনিউ হতো। এভাবেই তিনি তাঁর প্র্যাকটিসিং লাইসেন্স রাখতেন সাথে ইউনিভার্সিটিতে আইন শিক্ষকতা করতেন।
এবার আসি তাঁদের ব্যাপারে যাদের আইনজীবী লাইসেন্স আছে, কিন্তু কোর্টে আসেন না। কোর্ট সম্পর্কিত কিন্তু কোর্টে আসা লাগে না। যেমন আন্তর্জাতিক চুক্তি, আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তি, কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন, ইনকাম ট্যাক্স ইত্যাদি। তাঁদের প্র্যাকটিস গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ঐ যে সমালোচনা আছে প্র্যাকটিস লাইসেন্স অর্জনে কোর্টের চৌকাঠ মাড়াতেই হবে তা কিন্তু বর্তমান সময়ে বাস্তবিক নয়।
এরপর আছেন যারা কমার্শিয়াল/নন লিটিগেশন, এক কথায় কোর্ট অ্যাডভোকেসি ছাড়া সবই করেন, এমন কি কোর্টের ড্রাফটিং সার্ভিস দেন অনেকে। আবার অনেক চেম্বার আছে, যারা লিটিগেশন/নন লিটিগেশন উভয়ই সেবা দিয়ে থাকেন। যাক, এত কথা উদহারণ কেনো দিলাম? কারণ একটা বিষয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন। সেটা হলো আধুনিক বিশ্বে আইন পেশার বহুমাত্রিক চাহিদা তৈরি হয়েছে। আইন পেশা যেহেতু একটি স্বাধীন পেশা এই পেশাকে ছোট গণ্ডিতে ভাবা বাস্তব সম্মত না। তাই আমি মনে করি এই বিষয়ে বার কাউন্সিল সহ দেশের আইন জগতের সকলকে সমান আগ্রহ সহকারে সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করতে হবে।
তার মানে আমি বলছিনা যারা আদালত প্রাঙ্গণে টাউট বা যারা আইন পড়েই নাই যারা মামলা রিসিভ করে তাদের ব্যাপারে কোনো ছাড় থাকবে। কিন্তু যারা আইন পড়েছে, দেশ-বিদেশে বিভিন্ন ডিগ্রী নিয়ে নিজেদের যোগ্যতাকে শাণিত করেছেন কিন্তু এখন কোর্টে না এসে আইন পেশাজীবী হয়েছেন, যেমন আইন শিক্ষক, কোম্পানির আইন কর্মকর্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের যদি প্র্যাকটিসিং লাইসেন্স সারেন্ডার না করে বাৎসরিক নির্দিষ্ট ঘণ্টায়, নির্দিষ্ট বিষয়ে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের/কর্মশালায় অংশগ্রহণের বিষয়টি চিন্তা করা হয় তাহলে দুইটি জিনিস ঘটবে: ১. নন প্র্যাকটিস এ যারা আছেন, ওই ট্রেনিং গুলো নিয়ে প্রফেশনে আপডেট থাকতে পারতেন; ২. দেশে বার কাউন্সিলের অধীনে বা আলাদা ভাবে প্রফেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গড়ে উঠবে যারা ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠা কোচিং সেন্টার গুলোর প্রয়োজনীয়তা কমাবে। সাথে সাথে আইন পেশার অধিক্ষেত্র বাড়বে, পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি, কে কয়টা মামলা করল, না করলো, এই সব বিষয় আসলো না। এই পেশার বিভিন্ন সেক্টরকে এক করলেই না সেক্টর বড় হবে, পেশার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে। আর সেক্ষেত্রে আইনজীবীর সংখ্যা বেশি হলেও সমস্যা নাই, কারণ সবাই তখন আদালতেই যে প্র্যাকটিস করতে হবে সেই ধরাবাঁধা চিন্তার উন্নতি হবে, কোর্টের কিউবিকেল তারাই নিবে যারা রেগুলার কোর্টে আসে। অন্যরা কোর্টের বাইরে সম্মানের সাথে কাজ করবে, কোর্টে না এসে শুধু সম্মান রক্ষার্থে বলবে না যে তিনি কোর্টে প্র্যাকটিস করা আইনজীবী!
সবশেষে বলতে চাই, আমরা যারা নিয়মিত কোর্টে মামলা করবো বলেই ঠিক করেছি তারা প্রতিদিন কোর্টে এসে এক অদ্ভুত আনন্দ পাই, যেটা কোর্টের বাইরে কাজ করে যত টাকাই ইনকাম করা যাক না কেনো, তার সাথে কোনো তুলনাই হবে না। হেয়ারিং করে অর্ডার নিয়ে কোর্ট থেকে হাসি মুখে বের হওয়া অথবা অর্ডার না করতে পেরে মক্কেলের মন ভারী মুখ – এসবের ভিতরে জীবন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিদিন নতুন নতুন অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ। যা কোর্টের বাইরে কাজ করে পাওয়া যায় না। কিন্তু তাই বলে অন্যান্য আইন পেশাজীবীদেরকে তাদের লাইসেন্স সারেন্ডার করতে বলা কতটুকু বাস্তবিক এবং যুক্তিযুক্ত তা চিন্তা ভাবনার সুযোগ থাকা উচিৎ। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো তাদের আইন পেশায় আমরা বর্তমানে যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি তা তারা অনেক আগেই পার করে এসেছে। প্র্যাকটিসিং আইনজীবী এবং নন প্র্যাকটিসিং আইনজীবী সবাইকে প্র্যাকটিসের আপডেট থাকাই মূল কথা। উন্নত আইনজীবী শুধু কোর্ট প্র্যাকটিস করলেই হবেন, বিষয়টাকে এইভাবে সংকীর্ণ করে না দেখে, প্র্যাকটিসের গণ্ডি বাড়িয়ে সেটাকে পেশাগত প্রশিক্ষণের আওতায় কিভাবে আনা যায় সেই চিন্তা করা উচিৎ বলে মনে করি।
লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।