জায়েদ বিন নাসের : বলা হয় শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। ইতিহাস শিক্ষারই অংশ। যে জাতি নিজ অতীত ইতিহাস, সত্তা ও অস্তিত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ সে জাতি কখনই সঠিক পথের দিশা পেতে পারে না। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ল’ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (বিলিয়া) থেকে প্রকাশিত একটি গবেষণায় তরুণদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক জ্ঞান ও জানাশোনার পরিধি অনেকের মত আমাকেও স্তম্ভিত করেছে! কিন্তু এর চাইতেও স্তম্ভিত হয়েছিলাম তখন যখন জাতীয় ৪ নেতার নাম জিজ্ঞেস করার পরে এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন ছাত্রের উত্তর পেলাম। সে ছাত্র মাত্র ১ জনের নাম বলতে পেরেছিল, তারপরে আমি আর আগাতে দেইনি। কাজী নজরুল ইসলাম ছিল সেই ছাত্রের উত্তর। বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম উহ্য রাখছি কারণ সেই বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়টির মান-মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা আমার উদ্দেশ্য না, আমার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে আত্মতুষ্টির রোগে না ভুগে বাস্তব পরিস্থিতিকে স্বীকার করে ভুল শুধরাতে ও অবস্থার উন্নতি ঘটাতে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি।
দেশের আইন শিক্ষায় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় খুব ভালো করছে। অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে অকারণে আইন বিভাগ খুলে রাখা হয়েছে। সেখানে গৎবাঁধা শিক্ষাই ছাত্ররা পান। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আইন শিক্ষার এমনই বেহাল দশা যে যারা আইনে অধ্যয়নকালীন নিজ উদ্যোগে কোর্টপাড়ায় না গেছেন তারা আইনে স্নাতক আর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে আদালতে গিয়ে অ আ ক খ না বুঝতে পেরে হতাশ হয়ে ফিরে আসেন। কোর্টের হালচাল দেখে কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না। অবশ্যই তাত্ত্বিক দিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যে থাকবে; কিন্তু তাই বলে আইনের মত প্রয়োগভিত্তিক বিষয়ে প্রায়োগিক কোন শিক্ষাই থাকবে না! তত্ত্বটা রপ্ত করার কৌশল জানতেই হবে। এই তাত্ত্বিক দিক আয়ত্ত করাও কি যথার্থভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হচ্ছে?
আইন শিক্ষায় পাস কোর্স নামে যেই ডিগ্রি ছিল সেটার অবশ্যই অবসান হওয়া দরকার, তা নাহলে বিষয় ও পেশা হিসেবে আইনের মানোন্নয়ন সম্ভব হবে না। ৪ বছরের স্নাতক প্রোগ্রাম প্রয়োজনে ৫ বছরে উন্নীত করা উচিত, না হয় ৪ বছরের মধ্যে শেষ ১ বছর প্রথম ৩ বছরের রপ্ত করা তত্ত্বের ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক দিক সম্পর্কে কোর্স, অংশগ্রহণভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত। আদালতে আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। এ সম্পর্কিত একটা আবশ্যিক বিষয় রাখার প্রয়োজনীয়তা কি এখনও আমাদের উপলব্ধির বাইরে! কোর্টে শুধু আসা-যাওয়া না; এই আসা-যাওয়াকে অর্থবহ করার অনেক তরিকা বের করা যায়। নবপ্রাণরা ব্যবহারিক প্রয়োগের কৌশল দেখতে ও জানতে পারবেন। পাশাপাশি বর্তমান পরিস্থিতিতে আদালতে প্রয়োগ হওয়া চর্চা ও চর্চিত বিষয়ের ভালো-মন্দ নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রও এর মাধ্যমে উন্মোচিত হবে।
তত্ত্ব রপ্ত করে এবং সাংবিধানিক আইনসহ অন্যান্য আইনগুলো আত্মস্থ করে যখন তরুণরা আদালতে যাবেন তখন এই সকল তরুণ আইন চিন্তকরা আইনের মানোন্নয়ন ও সংস্কার সম্পর্কে ভাবার খোড়াক পাবেন; যাতে তরুণদের সৃজনশীলতা বিকশিত হবার সুযোগ তৈরী হবে, বেরিয়ে আসবে নতুন সব চিন্তা-ভাবনা। যা জাতির বৃহত্তর কল্যাণে কাজে লাগবে। আদালতে যাবেন মস্তিষ্কে তত্ত্বের ভাণ্ডার নিয়ে; আর সেখানে ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখে নিজ চিন্তা করার শক্তি, ধীশক্তি, রুচিবোধকে কাজে খাটিয়ে মন-মননে হয়ে উঠবেন সৃজনী। তরুণ এক দেশপ্রেমিকের হৃদয়ে, অন্তরাত্মায় যখন আইন আত্মস্থ হবে তখন সরাসরি আদালতে গেলে নিশ্চয়ই তাঁর মন চাইবে নিজের সর্বোচ্চটা উজাড় করে দেশকে কিছু দেবার জন্য। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই ধারাটা অব্যাহত থাকলেই কেবল আইন শিক্ষা যথার্থতা পাবে। এজন্য এ ধারা শুরু করে প্রতিনিয়ত বজায় রাখাটা জরুরী।
এখন প্রায়ই নতুনরা আদালতে গেলে শুনতে হয় ৪ বছরে যা পড়ে এসেছেন তার কিছুই কাজে লাগবে না, একদম শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। কথাটি আংশিক সত্য। বিচারক আর আইনজীবীরা যেখানে আইনের বাস্তব প্রয়োগ ঘটান সেখানটা নতুন জায়গা হিসেবে নতুন করে জানা-শোনার বিষয় অবশ্যই আছে। কিন্তু একজন মেধাবী ও সৃজনশীল তরুণকে তিন-চারটি বছর যেই বিষয়ে পড়া গলাধঃকরণ করানো হলো সেই বিষয়ের প্রয়োগের জায়গায় গিয়ে তো তাঁর আরও ভালো অনুভূতি হওয়ার কথা, আদালতের প্রতি আকৃষ্টতা ও ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পাবার কথা। কিন্তু হয় তার উল্টা। এতেই বোঝা যায় যে গলদ তো অবশ্যই আছে।
আইনে উচ্চশিক্ষা নিয়ে একটা উল্লেখযোগ্য অংশের মানুষ আইনজীবী হবেন- এটাই স্বাভাবিক। অথচ বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বার কাউন্সিলের কোন বাস্তব সম্পর্ক নেই, মতবিনিময় বা ভাবের বাস্তবিক, বস্তুনিষ্ঠ ও কার্যকর আদান-প্রদান নেই। ইউজিসির সাথেই বা বার কাউন্সিলের সম্পর্ক কি?
বার কাউন্সিলের একটা আলাদা কমিটি আছে যাদের আইন শিক্ষা নিয়ে কাজ করার কথা৷ কিন্তু বাস্তবে ‘লিগ্যাল এডুকেশন কমিটি’ নামে এই কমিটির কার্যক্রম সেভাবে দেখা দেখা যায় না। এটি বার কাউন্সিলের তিনটা আবশ্যিক কমিটির মধ্যে অন্যতম একটি কমিটি। সবচেয়ে বেশী সংখ্যক সদস্য এই কমিটিতেই থাকেন। অন্য কোন কমিটিতেই এত সংখ্যায় সদস্য থাকেন না। বাকি কমিটিগুলোতে ৫ জন করে থাকেন, এই কমিটিতেই শুধু ৯ জন। কমিটির গঠন খুবই চমৎকার, এতে আইনের ২ জন শিক্ষকও থাকেন। আইন শিক্ষা ব্যবস্থা ঘুরে দেখা, পরিদর্শন করা, তদন্ত করা, প্রয়োজনে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য সুপারিশ করাই তো এই কমিটির কার্যক্রম হওয়া উচিত। এটি সঠিকভাবে কাজ করলে আইনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা সাবেক আমলা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শিক্ষাভিত্তিক বিভাগের প্রধান হতে পারতেন কি?
অনেক কাজ থাকে যেগুলো হয়তো দৃশ্যের সামনে এনে দৃশ্যমান করা সম্ভব না, ভিতরে ভিতরে করতে হয়। কিন্তু কাজের ফলগুলো তো অনুভব করতে পারার কথা৷ কিন্তু অনুভবও করা যায় না। স্থবির এই কমিটির কাজে গতিশীলতা আনার দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, বার কাউন্সিলের লিগ্যাল এডুকেশন কমিটি এবং বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সমন্বয় করে কাজ করা উচিত; এসকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নিবিড় একটা সম্পর্ক গড়ে উঠা প্রয়োজন; ভাবের কার্যকর আদান-প্রদান হওয়া জরুরী। আমি যেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করে এসেছি সেখানে আদালত সম্পর্কিত, ওকালতি নিয়ে ব্যবহারিক কোন কোর্সই পাইনি; স্নাতকেও না, স্নাতকোত্তরেও না। জানামতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই দেওয়া হয় না। কিছু জায়গায় নামকাওয়াস্তে অবশ্য দেওয়া হয়।
আইনের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশে কোনো বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় নেই। ৫০ বছরেও গড়ে ওঠেনি। আইন প্রণয়ন, নীতি নির্ধারণ ও বিচার ব্যবস্থা একটা দেশের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমি সবসময় বলি একটা দেশের মানুষের খাদ্যাভাস জানতে হলে খাবারদাবার খেতে হয়; পোশাক সম্পর্কে ধারণা পেতে গায়ে জড়ানো কাপড় দেখতে হয়। আর একটা দেশের সামগ্রিক রুচি দেখার প্রয়োজন হলে সে দেশের সংবিধান দেখতে হয়। আইন ব্যবস্থা নিয়ে স্বাধীন দেশে বিভিন্ন অঙ্গনের অনেক দেশপ্রেমিক নেতৃস্থানীয় মানুষজন আক্ষেপ করেছেন, এঁদের কেউ কেউ মারাও গেছেন; কিন্তু আমরা যারা এখনও জীবিত তাদের উচিত এই আক্ষেপে ভ্রুক্ষেপ করা, এবং এ নিয়ে কাজ করা।
কয়দিন আগে গাজী শামছুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ল অ্যালায়েন্সের একটা প্রোগ্রামে শ্রদ্ধেয় আইনুন নিশাত স্যার এসেছিলেন। তিনি বলে গিয়েছেন, সাক্ষ্য আইনের সংশোধন করা না গেলে দেশে ন্যায়বিচার সম্ভব হবে না। যথার্থই বলেছেন। বিদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে উনার, নিজে যে ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ, স্যারের নিজের যে বিষয়ে পাণ্ডিত্য আছে সে বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে বিচারক ছিলেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, জাতিসংঘের অধীন সংস্থায়। স্যার দেশের অমূল্য এক সম্পদ। যে বিষয়ে কাজ করেন সেক্ষেত্রে বাইরের দেশের আইন, নীতি নিয়েও ঘাটতে হয়; আন্তর্জাতিক আইন জানতে হয়৷ তিনি আইন শিক্ষার সাথে সরাসরি জড়িত নন। তবে যা বুঝা গেল তা হলো দেশপ্রেমিক সচেতন মানুষ হিসেবে আইন-আদালত নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট নন।
বেশ কিছুদিন পূর্বে দেশের স্বয়ং প্রধান বিচারপতিই তো মামলা জটকে ইঙ্গিত করে প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন মানুষ কেনো বিচার বিভাগের উপরে আস্থা রাখবে। মামলা জটের মতো এরকম আরও অসঙ্গতি, অন্যায় আছে আমাদের বিচার ব্যবস্থায়। দেশের সচেতন দেশপ্রেমিক জনগণের আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ব্রিটিশ আমল থেকে কোন মুখী? এটা পরে কোন সময় উচ্চগামী হওয়ার কি কোন বিশেষ কারণ আছে? উচ্চমুখী করার জন্য কি আদৌ কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? ব্রিটিশদের পচনশীল পাত্রে মাঝেমধ্যে অন্যায় সাজসজ্জা করা ছাড়া? আগে মানুষ কম ছিল, ভিনজাতি শাসনের নামে শোষণ করত। আর এখন মানুষ বেড়েছে, নিজেরাই নিজেদের খাচ্ছি। অবস্থা আরও ভয়ানক, উদ্ভট, জঘন্য রকমের বিশ্রী।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন সিভিল মামলার দীর্ঘসূত্রিতার কথা, ফৌজদারী বিচারের ক্ষেত্রে মিথ্যা সাক্ষ্যে বিচারের কথা। কিন্তু সেসব নিয়ে এই ৪৫-৫০ বছরে কি করতে পেরেছি আমরা যে সেসব নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলা লাগবে না? সিভিল মামলার দীর্ঘসূত্রিতা নিরসন, ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থার আমূল উৎপাটন করে ইনসাফের বিচার কায়েমের নীতি তো প্রণয়ন করিনি৷ বঙ্গবন্ধু যেই অবিচারের আইন আর প্রথাকে ইঙ্গিত করেছিলেন সেই অবিচারের আইন দিয়ে আর জুলুমের প্রথা বজায় রেখেই তো বিচার ব্যবস্থা এগিয়ে চলছে।
বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখে রেখে গেছেন বিনা বিচারে রাজনৈতিক কারণে এক ব্যক্তিকে বন্দি রাখার মর্মান্তিক, অমানবিক, কুরুচিপূর্ণ অত্যাচারের কথা। কি এমন করলাম যে সে কথা আজ প্রাসঙ্গিকতা হারাবে? আজও তো তা প্রাসঙ্গিক যখন দেখি বিনা বিচারে স্বাধীন বাংলাদেশে ২০-৩০ বছর ধরে জেল খেটে কারাগার থেকে সহায়সম্বলহীন একেকটা তাজা মানবপ্রাণ অমলিন মুখ নিয়ে মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে আসেন। কারামুক্তিতে তাঁদের চোখেমুখে তো আনন্দ দেখতে পাই না, যা দেখতে পাই তা হলো ছোট এক জায়গা থেকে বদলে যাওয়া কোন এক বড় জায়গায় প্রবেশের পর খাপ খাওয়ানোর বহু চিন্তার ঝক্কির দুঃশ্চিন্তা আর আতঙ্ক।
ব্রিটিশদের সংজ্ঞায় যিনি রাষ্ট্রদ্রোহী সেই ব্যক্তি কি আদৌ স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন? রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইন নিয়ে বিগত ৫০ বছরে ক’টা কাজ হলো আইন শিক্ষাঙ্গনে? ক’টা গবেষণাপত্র বের হলো এ নিয়ে? প্রতি বছর গড়ে মাত্র ১টা ধরে ৫০টা হবে? আচ্ছা, ৫টা হবে? এ নিয়ে একটাও পিএইচডি পাওয়া যাবে?
আইনে উচ্চশিক্ষার জন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া জরুরী। কয়েক বছর আগে শুনেছিলাম রংপুরে একটা হবে বেসরকারিভাবে। কিন্তু আইনের জন্য পাবলিক একটা বিশ্ববিদ্যালয় খুবই প্রয়োজন। অনেকেই এই তাগিদ অনুভব করেন। এটা শুধু দরকার না, খুবই প্রয়োজন। এ নিয়ে কাজ করার আছে ইউজিসির, বার কাউন্সিলের, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের আইনের শিক্ষকদের, আইনজীবী সমিতিগুলোর, আইনের ছাত্রদের। সকলেরই এর পক্ষে জোরালো আওয়াজ তোলা উচিত।
আইন শিক্ষার ক্ষেত্রে গরু কেতাবে রেখে গোয়ালে না রাখলে হয় না কোনমতেই। মুট কোর্ট নামে এক ধরণের প্রতিযোগিতায় ইংরেজি ভাল বলতে পারা গুটি কতক স্মার্ট ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে টিম গঠিত হয়। আইনের চেয়ে সেখানে ভাষা নিয়েই বেশী কপচানো হয়। এই বাস্তব প্রতিযোগিতাটাও যদি বাংলায় সম্ভব হত তবে ভাল হত৷ এতে অংশগ্রহণ থাকে শতকরা হারে আইন শিক্ষার্থীদের মাত্র ২-৪ জনের। আইনের বিশ্লেষণে, আইনকে গণমানুষের ভীতির বাইরে নিয়ে আসতে মাতৃভাষা প্রয়োগের কোন বিকল্প থাকতে পারে না। সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার চর্চায় মাতৃভাষায় বাদি-বিবাদী পক্ষকে দলিল-দস্তাবেজ সরবরাহ না করা গেলে আইন ব্যবসা না হয়ে অসাধু ভাষা ব্যবসাই রয়ে যাবে। বাংলার যাও প্রয়োগ তা এমন কঠিন আর জটিল যে তা সাধারণ মানুষের বোঝার বাইরে।
মানুষের বোধগম্য ভাষাতে আইন চর্চা চাই, আইন শিক্ষা চাই, আদালতের কার্যক্রম এমন ভাষাতেই চাই৷ মুট কোর্ট নামের যেই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় তার দু-একটা দেখার ভাগ্য হয়েছিল। সেখানে কৃত্রিমতাই মূল উপাদান মনে হয়েছে, যদিও এর প্রতি বিশেষ আগ্রহ আমার ছিল না। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যারা এইসব প্রতিযোগিতায় অংশ নেন তারা যদি বাংলায় সুযোগ পেতেন তবে আরও ভাল করতে পারতেন এবং আইন নিয়ে প্রকৃতপক্ষেই কাজ করার ক্ষেত্র বহুগুণ বেড়ে যেত। যাদের আইনের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা আছে তারা নিজ ভাষায় চর্চার সুযোগ পেলে নিজেদের মেলে ধরতে পারবেন; প্রসারিত হবে আইন নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্র। যখন ভাষার প্রয়োগে অতিরিক্ত সময় দিয়ে কৃত্রিমতা প্রকাশ করার বাধ্যবাধকতা থাকবে না তখন অনুবাদের কাজের ক্ষেত্র প্রসারিত হবে; সৃজনী শক্তি কাজে লাগিয়ে আইন শিক্ষার্থীরাও নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন করার সুযোগ পাবেন। বিকশিত হবে আইনাঙ্গন।
আইন বিশ্লেষণ, আইন নিয়ে গবেষণা, পুরান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, নতুন আইন তৈরী, সাংবিধানিকতার ব্যাপ্তির সুন্দর ও জগদ্বিখ্যাত ব্যাখা-বিশ্লেষণসহ আইন ও নীতিপ্রণয়নে আমদের ছেলেপেলে অবদান রাখতে পারবে বলে বিশ্বাস করি। এতে হৃদয়ে এবং অন্তরাত্মায় আইনকে লালন করা সম্ভব হবে। সৎ, মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষার্থীরা আইনে আকৃষ্ট হবেন; আইনের মানোন্নয়ন হবে। সর্বোপরি সর্বাঙ্গীন বিবেচনায় সামগ্রিকভাবে আইন অঙ্গনের সুদিন আসবে।
একবার মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছিলেন তাঁর নাকি মাথামোটা তাই ‘সরল বিশ্বাস’-এর সংজ্ঞা নাকি তিনি বুঝেন না! নিশ্চয়ই স্যারের মাথামোটা না। জ্ঞানী লোক তাই ইশারায় বলার চেষ্টা করেছেন, এই যা। বিগত ৫০ বছরে ‘সরল বিশ্বাস’-এর সংজ্ঞার বিকল্প প্রস্তাব কয়জন গবেষক (শিক্ষার্থী বা শিক্ষক অথবা উভয়) করেছেন সংসদকে বা আইন মন্ত্রণালয়কে? বিভিন্ন সাংবিধানিক ইস্যু নিয়ে ভারতে কন্সটিটিউশন ক্লাব অব ইন্ডিয়া বিতর্ক করে, আলাপ করে। আমাদের এমন প্রতিষ্ঠান কই? আমরা কি এরকম প্রস্তাব তৈরীতে বা সংগঠন বানাতে অক্ষম? অবশ্যই না। এই দেশ কয়েক মাসে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি, সীমাবদ্ধতা বাদ দিলে বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রগতিশীল জনকল্যাণকর একটা সংবিধান তৈরী করেছে। এই দেশ জন্মের মাত্র বছর দুয়েকের মধ্যেই মেরিটাইম নিয়ে আইন বানালো। জাতিসংঘ যেটা করলো ১৯৮২ সালে, জন্মের তিন যুগ পরে। আমাদের পূর্বসুরীরাই তো এসব করেছেন। আমরা পারি। কিন্তু সুষ্ঠু শিক্ষা ব্যবস্থা আর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে সব যেনো হারাতে বসেছি!
আমরা কাঙ্গালের জাতি না। মেধা-মননে আমরা অনেক উচ্চে। স্পর্ধা নিয়ে ড. কামাল হোসেনকে একবার বলেছিলাম, “স্যার আমরা আপনাদেরকে প্রায় ভিনগ্রহের মানুষ বানিয়ে দিয়েছি। কামাল হোসেন তো এই মাটিরই সন্তান। হয়তো সব ব্যাচে কামাল হোসেন জন্মায় না, কিন্তু কোনো না কোনো ব্যাচে তো খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।” তিনি উত্তরে বললেন, “আমি অক্সফোর্ডসহ আরও বেশ কয়েক জায়গায় পড়িয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়িয়েছি। আমার মনে হয়েছে এখানকার ছেলেমেয়েরা ওখানকার (অক্সফোর্ড, ক্যাম্ব্রিজ) চেয়েও মেধাবী। আমি তো মনে করি প্রতি ব্যাচেই এরকম ছেলেপেলে আছে।” এ থেকে পরিষ্কার মানবসম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমরা নিজেদের মেলে ধরতে পারছি না। বসে না থেকে এই ব্যাপারে কাজ করার দরকার। বিচারক আর আইনজীবীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা অপরিহার্য। নবীন আইনজীবীদের প্রশিক্ষণের একটা ব্যবস্থা কয়েক বছর চললো, তারপর বন্ধ হয়ে গেলো। পিছনে হাঁটা শুরু করলাম, এখনও হাঁটছি সে পথেই। এর পরিবর্তন প্রয়োজন।
আমরা দেউলিয়াত্বের জাতি না। তাহলে কেনো আমাদের এরকম অবস্থা হবে? দেওয়ালে পিঠ ঠেকতে আর কি বাকি আছে? এখন সময় ঘুরে দাঁড়ানোর। ভাগ্যিস! আইনের লোক রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তান আমলে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠানের জন্য জায়গা দিয়ে গিয়েছিলেন; কাল পরিক্রমায় যেই প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে দিল চেতনা মুখে বলা এক, আর প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া আরেক বিষয়। প্রথম কাজটা খুবই সহজ; দ্বিতীয়টা শক্ত, অনেক শক্ত কাজ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় শিক্ষিত আইনজীবী দরকার; ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সৎ ও মেধাবী বিচারক প্রয়োজন। মামলা জট, মিথ্যা মামলা ইত্যাদি অসঙ্গতি দূর করতে প্রয়োজন রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সদিচ্ছা। সম্মিলিত প্রয়াসেই এই বেহাল দশা থেকে মুক্তি মিলবে।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ল’ অ্যালায়েন্স