নির্বাচনের নিরাপত্তা
বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান

নির্বাচনের নিরাপত্তা

বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান: শান্তিপূর্ণ পন্থায় সরকার পরিবর্তনের সর্বকালের সর্বদেশের অনুমোদিত পন্থা হচ্ছে “সার্বজনীন সাধারণ নির্বাচন”। এই নির্বাচনে ভোটাররা নিজ ভালো লাগার রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীকে নিজ ইচ্ছানুযায়ী ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে এক অনির্বচনীয় আনন্দ লাভ করে থাকেন। নির্বাচনের দিন এগিয়ে এলে এই উৎসাহী ভোটারগণ ভোটে অংশগ্রহণ করার জন্য আঁকুপাঁকু করতে থাকেন। নির্বাচনের দিন এক আনন্দঘন পরিবেশে ভোট দিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে ফলাফলের জন্য। নিজ প্রার্থী নির্বাচিত হলে উল্লাসে ফেটে পড়ে।

বাংলাদেশের আবহমানকালের নির্বাচনের এই পবিত্র দৃশ্য আমরা অবলোকন করেছি এযাবতকাল। অথচ বিগত ১৫ বছরের তিনটি নির্বাচনে এই দৃশ্য সামগ্রিকভাবে অনুপস্থিত ছিল। রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে নির্বাচন ব্যবস্থাটাই গণমানুষের চেতনা থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। গুন্ডামী বদমাইশী লুচ্চামী করে গত পনের বছরে সংসদ সদস্য নির্বাচন করার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার পবিত্র বিপ্লব সংগঠিত না হলে আর হয়তো কখোনো নিষ্কলুষ নির্বাচন এদেশে অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা জাগ্রত হতো না। এই বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন ও পলায়ন হওয়ায় আবার ফিরে এসেছে মুক্ত বাতাসের পরিবেশ। এই পরিবেশ ধরে রেখেই নিষ্কলুষ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করার এক অপার সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে। আসুন আমরা নির্বাচন নিষ্কলুষ রাখার বিধানটি প্রণয়ন করি।

নির্বাচন নিষ্কলুষ রাখার প্রস্তাবিত রূপরেখা

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান বলবত রেখেও বাংলাদেশের ধ্বংস হয়ে যাওয়া নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে নিষ্কলুষ রাখা সম্ভব। নতুন সংবিধানে শুধুমাত্র নিম্নরূপ বিধান সংযোজন করতে হবে-

(১) দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর দলীয় প্রধানমন্ত্রী ও সরকার  শুধুমাত্র রুটিন কর্মকান্ড পরিচালনা করবে।

(২) একটি নিরপেক্ষ শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

(ক) মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিজ সুবিবেচনা অনুসারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেবেন।

(খ) শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে সর্বশেষ অবসর গ্রহণকারী প্রধান বিচারপতি; তার অপ্রাপ্তিতে কিংবা অস্বীকারে আপীল বিভাগের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি; তার অপ্রাপ্তিতে কিংবা অস্বীকারে সর্বশেষ অবসর গ্রহণকারী সেনা প্রধান; তার অপ্রাপ্ত কিংবা অস্বীকারে সর্বশেষ অবসর গ্রহণকারী নৌপ্রধান; তার অপ্রাপ্তি কিংবা অস্বীকারে সর্বশেষ অবসর গ্রহণকারী বিমান বাহিনী প্রধানকে মনোনীত ও নিয়োগ করতে হবে।

(গ) নির্বাচন কমিশনার হিসাবে হাইকোর্ট ডিভিশনের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ সরকারী কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত স্বনামখ্যাত সামরিক কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্বনামখ্যাত চিন্তাবিদ ও সমাজ সেবককে মনোনীত ও নিয়োগ দিতে হবে।

**(৩) নির্বাচন ঘোষণার পূর্বক্ষণে যে দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছে সে দলকে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে মর্মে সাংবিধানিক বিধান করতে হবে।

(৪) ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা দলের সদস্যপদ পরিত্যাগের মাধ্যমে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। তবে পরবর্তীতে যে কোন রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ গ্রহণ করলে সংসদে তার সদস্য পদ শুন্য হয়ে যাবে মর্মে সাংবিধানিক বিধান করতে হবে।

আরও পড়ুনসাধারণের সংস্কার ভাবনা/প্রস্তাবনা

(৫) সংসদ সদস্য পদে প্রতিযোগিতা করতে হলে ন্যূনতম যে কোন ডিসিপ্লিনে শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক থাকতে হবে মর্মে সাংবিধানিক /আইনগত বিধান করতে হবে।

(৬) কোন ব্যবসায়ী সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলে তাকে ব্যবসার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। সংসদ সদস্য পদে থাকাকালীন ব্যবসায়ে সংযুক্ত হলে সংসদে তার সদস্যপদ শুন্য হয়ে যাবে মর্মে সাংবিধানিক/আইনগত বিধান করতে হবে।

(৭) নির্বাচনকালীন যে সেন্টারে নির্বাচন কলুষিত করার চেষ্টা করা হবে- তদন্তক্রমে সে সেন্টারের নির্বাচন বাতিল হবে মর্মে সাংবিধানিক বিধান করতে হবে। সে সেন্টার বাদ রেখে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করার সাংবিধানিক/আইনগত বিধান করতে হবে।

(৮) নির্বাচন কলুষিত করার প্রচেষ্টার সাথে জড়িত নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কিংবা জড়িত যে কোন ব্যক্তিকে তদন্তক্রমে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করার সাংবিধানিক/আইনগত বিধান করতে হবে।

নির্বাচন ব্যবস্থা নিষ্কলুষ রাখার পাশাপাশি সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির কিছু সংস্কার সাধন করে সংসদকে প্রকৃত জনগণের সংসদে পরিণত করা আবশ্যক। এযাবতকালের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি মাননীয় সংসদ সদস্যগণ সংসদে “ফ্লোর ক্রসিং বিরোধী” ও “স্পিকার গিলোটিন” বিধান দুটির কারণে স্বাধীনভাবে সংসদে তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারেন না। ভবিষ্যতের সংসদে এ দুটি বিধান পরিহার করে নতুন সংবিধান রচনা করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির সংশোধন করতে হবে।

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ঐ বছরের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকলে ঐ নির্বাচন কলুষিত করার কোন আবশ্যকতাও ঐ দলের থাকবে না। ফলশ্রুতিতে মাঠ পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা ঐ নির্বাচনে শুধু যে নিস্ক্রিয় থাকবে তাই-ই নয়, বরং তারা নির্বাচন কলুষিত না হওয়ার পক্ষে ইস্পাত কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দল সমূহের কর্মীরা নির্বাচন কলুষিত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করলে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা সেটি বাধাগ্রস্ত করবে। এতে সার্বিকভাবে নির্বাচন কলুষমুক্ত থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস।

সংসদ কার্যপ্রণালী বিধির সংশোধন

(১) সংবিধানে “ফ্লোর ক্রসিং” বিরোধী কোন বিধান রাখা হবেনা। সংসদের কোন সিদ্ধান্তে ভোটাধিকার প্রয়োগে সংসদ সদস্যগণ স্বাধীন থাকবেন এবং দলীয় সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ভোট প্রদানের অধিকারী থাকবেন।

(২) সংসদের কার্যপ্রণালীতে “স্পিকার গিলোটিন” বিধান বাতিল করতে হবে। সংসদ সদস্যকে নির্দ্বিধায় বক্তব্য পেশের সুযোগ দিতে হবে।

উপরোক্ত দুটি বিষয়ে যথোপযুক্ত বিধান নতুন সংবিধানে সংযুক্ত থাকলে সংসদ হয়ে উঠবে প্রাণবন্ত এবং সেখানে জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটবে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।