সারা দেশের অধস্তন আদালতগুলোতে সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রায় তিন হাজারের বেশি পদ শূন্য রয়েছে। এই শূন্যপদ পূরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট দুটি নিয়োগ বিধিমালা—
১. জেলা জজ ও অধস্তন আদালত এবং বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতগুলোর (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৯
২. জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসির আদালতগুলোর (সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ২০০৮
—সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে। সংশোধিত বিধিমালার খসড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপকমিটি ইতোমধ্যে পর্যালোচনা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রশাসনিক উন্নয়ন-সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে উপস্থাপনের সুপারিশ করেছে। এখন সচিব কমিটিতে অনুমোদনের পরই নতুন নিয়োগ বিধি কার্যকর হবে বলে আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
জানা যায়, জেলা জজ ও অধস্তন আদালতগুলো এবং বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতগুলোর সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ১ হাজার ৭৫২টি পদ শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসির আদালতগুলোয় সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ১ হাজার ২১৬টি পদ শূন্য রয়েছে। আদালতগুলোয় এসব সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়া ও কার্যক্রমকে অধিকতর স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গতিশীল করার প্রয়োজনীয়তা থেকেই নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন করা হচ্ছে।
নিয়োগ নিয়ে অতীতে তুঘলকি কাণ্ড
সূত্র জানায়, বিগত সরকারের আমলে বিচার বিভাগের কর্মচারী নিয়োগ নিয়ে গভীর অনিয়ম ও দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে। সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ঘুষ নিয়ে নিয়োগ প্রদান করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়া হতো, এবং একটি নিজস্ব সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়।
ফলস্বরূপ, তিন হাজারের বেশি পদে নিয়োগ হয়েছে কেবল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলা থেকে, যা ছিল মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা। টাকার বিনিময়ে অদক্ষ লোক নিয়োগ পাওয়ায় আদালতের কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিচার বিভাগে নিয়োগ নিয়ে এই তুঘলকি কাণ্ড দেখে হতবাক ও বিস্মিত মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। পরে নিয়োগ বিধি সংশোধন করে বিচার বিভাগে সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষমতা পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
খসড়া বিধিমালায় যা রয়েছে
বর্তমানে লোকবল নিয়োগের জন্য একজন অতিরিক্ত ও একজন যুগ্ম জেলা জজ এবং একজন সিনিয়র সহকারী জজের সমন্বয়ে প্রার্থী বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি প্রার্থী বাছাই করে নিয়োগের জন্য জেলা জজের কাছে সুপারিশ করেন। সুপারিশ অনুযায়ী জেলা জজ নিয়োগ দিয়ে থাকেন; কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে জনবল নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়। ওপরের হস্তক্ষেপে নিয়োগ নিয়ে বিরক্ত অনেক জেলা জজও।
সংশোধিত খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে,
জেলা জজ শূন্য পদ চিহ্নিত করে তা জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের কাছে পাঠাবেন। কমিশন প্রার্থীদের লিখিত, মৌখিক ও প্রয়োজনে ব্যবহারিক পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করবে।
কমিশনের চেয়ারম্যান হবেন আপিল বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি, এবং সদস্য হিসেবে থাকবেন হাইকোর্ট বিভাগের দুই বিচারপতি, জনপ্রশাসন সচিব, অর্থ সচিব, আইন সচিব, অ্যাটর্নি জেনারেল সহ ১০ জন।
বাছাইকৃত প্রার্থীদের তালিকা পাওয়ার পর ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে জেলা জজ নিয়োগ সম্পন্ন করবেন।
নিয়োগ কার্যক্রমের প্রক্রিয়া
-
শূন্যপদ ঘোষণা: পদ শূন্য হওয়ার এক মাসের মধ্যে জেলা জজ তা সার্ভিস কমিশনে পাঠাবেন।
-
বার্ষিক নিয়োগ পরীক্ষা: সারাদেশের শূন্যপদ একত্র করে বছরে একবার বা একাধিকবার পরীক্ষা নেওয়া হবে।
-
বোর্ড গঠন: মৌখিক পরীক্ষার জন্য বিচারকদের সমন্বয়ে বোর্ড গঠন করা যাবে। কারিগরি সদস্যও অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।
চলমান নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ বিধান
বিশেষ বিধান করে এই খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, বিধিমালার এই সংশোধনী কার্যকর হওয়ার তারিখে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অধীনে চলমান কোনো সরাসরি নিয়োগের কার্যক্রমে লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ সম্পন্ন না হলে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ বৈধ প্রার্থীদের আবেদনসমূহ, তদসংযুক্ত কাগজাদি (যদি থাকে) ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বিধিমালার এই সংশোধনী কার্যকর হওয়ার সাত কার্যদিবসের মধ্যে বাছাইকারী কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করবে।
বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ বর্ণিত আবেদন, তদসংযুক্ত কাগজাদি (যদি থাকে) ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রাপ্তির পর তার ভিত্তিতে বাছাই-সংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণ করবে এবং এ ক্ষেত্রে নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও আবেদন আহ্বানের প্রয়োজন হবে না। তবে বিধিমালার এ সংশোধনী কার্যকর হওয়ার তারিখে কোনো নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অধীনে সরাসরি নিয়োগের কার্যক্রমে লিখিত পরীক্ষা সম্পন্ন হয়ে থাকলে এবং তৎপরবর্তী কোনো ধাপ অনিষ্পন্ন থাকলে ওই পদের নিয়োগ ও বাছাই কার্যক্রম এমনভাবে সম্পন্ন করতে হবে, যেন বিধিমালার এই সংশোধনী জারি হয়নি।
বিচারকদের মন্তব্য
অনিয়ম বন্ধে বিচার বিভাগের অনেকেই জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম বলেন,
আমরা অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। আশা করি কমিশনের মাধ্যমে আদালতে দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ হবে। এতে বিচারপ্রার্থীদের প্রত্যাশিত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
আরও কয়েকজন বিচারক বলেন,
টাকার বিনিময়ে অযোগ্য লোক নিয়োগের ফলে বিচারকরা বিপদে পড়েন। অনেক কর্মচারী টাইপ করতে জানে না, ফলে আদালতের কাজ ধীরগতির হয়ে যায়, হয়রানি বাড়ে।