সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা পুনর্মূল্যায়ন চেয়ে দায়ের করা রিট আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। রিটকারীরা সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে সংক্ষুব্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায় তাদের রিট আবেদনটি সরাসরি খারিজ করেন আদালত।
সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে— ‘(১) সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হবেন; (২) মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে; (৩) জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে।’
আজ সোমবার (৫ মার্চ) এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ এই খারিজ আদেশ দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন রিটকারী অ্যাডভোকেট একলাছ উদ্দিন ভূইয়া। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার।
শুনানির শুরুতে অ্যাডভোকেট একলাছ উদ্দিন ভূইয়া আদালতকে বলেন, ‘আমরা রিটে কোটা প্রথা কেন সংস্কার করা হবে না, তার নির্দেশনা চেয়েছি। তখন আদালত বলেন, এগুলো (কোটা পদ্ধতি প্রণয়ন) হয়েছে ১৯৯৭ ও ২০১১ সালে। এসব এখন বলছেন কেন?’
একলাছ উদ্দিন বলেন, ‘যখন কোটা নির্ধারণ হয়, তারপরও কয়েকবার তা সংস্কার হয়। বুদ্ধিজীবীরাসহ অনেকেই এই কোটার বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছেন। নারী, মুক্তিযোদ্ধা, উপজাতিসহ অনেক কোটা হয়েছে।’ তখন আদালত বলেন, ‘এসব সরকারের পলিসি। এগুলো কি সরকারের নজরে নেই?’
এর জবাবে একলাছ উদ্দিন বলেন, ‘আমি শুধু রুল চাচ্ছি (কোটা সংস্কার চেয়ে)। কেননা, এই কোটার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরাও কোটা সুবিধা পাচ্ছে।’ তখন আদালত বলেন, এই কোটার কারণে কোনও ভায়োলেশন (সংবিধান লঙ্ঘন) হয়েছে কিনা?’
একলাছ উদ্দিন তখন আদালতকে বলেন, ‘এই কোটা ব্যবস্থার কারণে সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদের ভায়োলেশন হয়েছে। একটি ছেলে এ কারণে আত্মহত্যাও করেছে। তাই এ বিষয়ে একটি রুল চাচ্ছি। রুল দিয়ে বিষয়টি সংস্কারের আদেশ দিন।’
এসময় আদালত রিটকারীদের এই আইনজীবীকে জিজ্ঞাসা করেন—‘যারা রিট করেছেন, তারা কি কোটা নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন? ঢাকা বিশ্বাবদ্যিালয়ের যে শিক্ষার্থী রিট করেছেন, তিনি কি পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পাননি? আর অন্যরাও এই কোটার বিষয়ে সংক্ষুব্ধ কিনা?’ জবাবে একলাছ উদ্দিন বলেন, ‘রিটকারী শিক্ষার্থী এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। অন্য দুজন রিটকারী সাংবাদিক। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থী সামনে চাকরির পরীক্ষা দেবেন।’
এসময় আদালত এই আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি বলতে চান, আমি আইনে পাস করেছি, এখন ডাক্তার হতে চাই? তিনিতো এখনও সংক্ষুব্ধ হননি। এটা ভবিষ্যতের বিষয়। এখনও তিনি পরীক্ষা দেননি। তার আগেই তিনি রিট করেছেন? কোটা আছে কী না আছে , সেটা সরকারের পলিসি। আপনি সংক্ষুব্ধ কিনা, ক্ষতিগ্রস্ত কিনা, তা হওয়ার আগেই আদালতে এসেছেন? আপনিতো সাংঘাতিক লোক।’
এরপর আদালত আদেশ দিয়ে রিট আবেদনটি সরাসরি খারিজ করে দেন।
পরে একলাছ উদ্দিন ভূইয়া গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আদালত রিট খারিজ করে দিয়েছেন। আমরা এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করবো।’
প্রসঙ্গত, এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি দুপুরে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিটটি দায়ের করেন অ্যাডভোকেট একলাছ উদ্দিন ভূইয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আনিসুর রহমান মীরসহ তিন জনের পক্ষে এ রিট দায়ের করা হয়।
রিট আবেদনে বলা হয়, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার সরকারি, বেসরকারি, আধা-সরকারি এবং জাতীয়করণ প্রতিষ্ঠানে জেলা ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে ৩০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ১০ শতাংশসহ ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য কোটা প্রবর্তন করে আদেশ দেন।
পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় এই কোটা প্রথা সংস্কার ও পরিবর্তন করা হয়। বর্তমানে জনপ্রসাশন মন্ত্রণালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি নিয়োগে কোটা রয়েছে, প্রতিবন্ধী একশতাংশ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতি-নাতনির জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির জন্য ৫ শতাংশ, সবমিলে চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা বিদ্যামান রয়েছে।
২০১৫ সালের ৩১ মার্চ একটি দৈনিক পত্রিকার প্রকাশিত রিপোর্ট অনুয়ারী দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৪১ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির এবং ২০ লাখ ১৬ হাজার ৬১৫ জন প্রতিবন্ধী। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী— দেশে মুক্তিযোদ্ধা ২ লাখ ৯ হাজার। ফলে দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৪১ জন নৃগোষ্ঠির জন্য কোটা রয়েছে ৫ শতাংশ। একইসঙ্গে ২০ লাখ ১৬ হাজার ৬১০ জন প্রতিবন্ধীর জন্য কোটা রয়েছে এক শতাংশ।
এদিকে, পিএসসি’র তথ্য মতে ২১, ২২ ও ২৫তম বিসিএস পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পোষ্যদের সংরক্ষিত ৩০ শতাংশের স্থলে ১০.৮, ২.২, ও ৫.২ শতাংশ পূর্ণ হয়েছিল। ফলে বাকি সংরক্ষিত কোটা শূন্য থেকে যায়।
রিট আবেদনে আরও বলা হয়, ২০০৮ সালে পিএসসি’র উদ্যোগে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা প্রথা নিয়ে একটি সমীক্ষা হয়। ওই সমীক্ষা অনুসারে কোটা প্রথা অসাংবিধানিক ও ন্যায়নীতির পরিপন্থী। কোনও কোটা চিরদিন থাকা ঠিক নয়। এই কোটা সংবিধানের ১৯, ২৮, ২৯ ও ২৯(৩) এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
রিটে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সচিব, আইন সচিব, জাতীয় সংসদ সচিবালয় সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছিল। বাংলা ট্রিবিউন