অ্যাডভোকেট কামরুল হাসান

বাংলাদেশের নীল ও সবুজ অর্থনীতির ভবিষ্যৎ এবং আইনগত বিশ্লেষণ

কামরুল হাসান :

তৃতীয় বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোট্ট একটি দেশ বাংলাদেশ। মৈত্রী সুপার থার্মাল, রূপপুর, মাতারবাড়ি, পায়রা এবং সোনাদিয়া ইত্যাদি, যা সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের চলমান বৃহৎ প্রকল্পগুলোর কয়েকটির নাম মাত্র। প্রকৃতপক্ষে, এই মহাপ্রকল্পগুলোর নাম শুনলেই আমরা অনেকেই চিন্তায় পড়ে যাই, যে এগুলোর কি লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কার্যক্রম এবং আইনগত ভিত্তি। পাশাপাশি এ প্রকল্পগুলো সম্পর্কে ভালো কিংবা মন্দ দিক নিয়ে নানান আলোচনা, সমালোচনা, অভিমত, অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ চলমান। সর্বোপরি আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি বর্তমান সরকার বাস্তবমুখী উন্নয়নের লক্ষ্যে সর্বাত্তকচেষ্টায় নিয়োজিত আছে। ধারাবাহিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের এবং কর্তব্য। পৃথিবীময় প্রায় সকল সমুদ্র তীরবর্তী দেশ সমুদ্র সম্পদের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল, আর সেইদিক থেকেই নীল (Blue) ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতির ধারণাটি পরিচিতি পায়, যা বর্তমান বিশ্ব-অর্থনীতিতে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচিত বিষয়। বর্তমান সরকারের ২১টি নির্বাচনী প্রচারপত্রের মধ্যে নীল (Blue) ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতি একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়। সার্বিকভাবে নীল (Blue) ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতি বলতে, সাগরে বিদ্যমান সম্পদের সঠিক ব্যবহার এবং এর টেকসই উন্নয়নের নীতিকে বুঝায়। এছাড়া সমুদ্রের যাবতীয় সম্পদ সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং কর্মক্ষেত্রের লক্ষ্যে যাবতীয় অর্থনীতিক উন্নয়ন করাই এর মূল উদ্দেশ্য। এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন১৯৮২ এর অধীনে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় অনুযায়ী বাংলাদেশ এযাবৎকাল পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠে ১,১৮,৮১৩ বর্গ কিলোমিটার সমতুল্য এলাকা সমুদ্র সম্পদের উপর একচ্ছত্র অধিকার অর্জন করেছে। যা বাংলাদেশের অর্থনীতির নতুন দিগন্ত হিসাবে উন্মোচিত হয়েছে। সমুদ্র অর্থনীতিতে যেসকল বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তা হচ্ছে :

  • একুয়া কালচার মাধ্যমে সামুদ্রিক মাছ কিংবা সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণ ও পর্যটনের ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করা। এছাড়াও, সামুদ্রিক জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ, প্রজনন, তত্ত্বাবধানসহ যথাযথ উন্নয়ন ও গবেষণা করা।
  • সামুদ্রিক সম্পদের অনুসন্ধান বা বাণিজ্যিকীকরণ বা উন্নয়ন বান্ধব জ্ঞান অন্বেষণ কিংবা গবেষণার লক্ষ্যে এর পরিধি প্রসার করা।
  • উন্নত প্রযুক্তি মাধ্যমে সামুদ্রিক মৎস্য শিকার এবং মৎস্যজীবীদের সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা।
  • আধুনিক কারিগরি প্রযুক্তি নির্ভর গভীর সমুদ্রব ন্দর,সমুদ্র জাহাজ, জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এবং মেরামতের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা।
  • সামুদ্রিক এবং উপকূলীয় পর্যটন ক্ষেত্রের শোভা বর্ধন এবং পর্যটন কেন্দ্রের নিরাপত্তা আধুনিকায়ন এবং নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা।
  • সমুদ্র তীরবর্তী খনিজ সম্পদের সন্ধান, সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ও বাস্তবধর্মী প্রকল্প বাস্তবায়নে নিশ্চয়তা দেওয়া।
  • প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং অপচয় রোধে সমুদ্রে প্রবাহিত বায়ু, সমুদ্র স্রোত এবং তরঙ্গ প্রবাহ সংরক্ষণে সঠিক এবং বাস্তবমুখী প্রকল্প গ্রহণ এবং এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করা।
  • সমুদ্রের সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশবান্ধব বর্জ্য নিষ্কাশনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

অপরদিকে, পৃথিবীর বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন বা সুন্দরবন বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত, যা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সৌন্দর্যের একটি অন্যতম নিদর্শন। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কো জরিপে ১৯৯৭ সাল সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। উপরন্তু, গবেষকরা মনে করেন, জলবায়ুর অতিমাত্রায় পরিবর্তন এবং মানবসৃষ্ট কারণে সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আজ হুমকির মুখে, যা রক্ষা করা অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে। কেননা সুরক্ষিত প্রাকৃতিক পরিবেশের অভাব দেশের অর্থনীতিতে গুরুতর প্রভাব বিস্তার করে। এছাড়াও, বর্তমানে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনে মুখরিত কমবেশী সকল দেশ। বিশেষ করে উন্নতদেশ এবং পরিবেশবান্ধব আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পরিবেশ রক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রকার প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বলা যায় যে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বর্তমান পরিবেশ বিপর্যয়ের একটি অন্যতম কারণ। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের উষ্ণতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে পরিবেশ সম্পর্কীয় নানাবিধ সমস্যা দৃশ্যমান। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণগুলোর মধ্যে মানবসৃষ্ট কারণ অন্যতম। এই পরিস্থিতিতে, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের পাশাপাশি দূষণের হাত থেকে পরিবেশকে রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রকল্পে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব কলকারখানা নির্মাণে সবুজ অর্থনীতি বা গ্রিন ইকোনমি উপর আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আধুনিক এবং পরিবেশ বান্ধব টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে সবুজ অর্থনীতি বা গ্রিন ইকোনমির প্রধান কাজ হল পরিবেশকে ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষা করা। এছাড়াও পরিবেশে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সবুজ অর্থনীতি বা গ্রিন ইকোনমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সবুজ অর্থনীতিকে বাস্তবমুখী এবং কার্যকরী করতে নিম্নরূপ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া অপরিসীম। যেমন :

  • বায়ু শক্তি সংরক্ষণে প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন।
  • পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য ইকোসিস্টেমের আধুনিক ব্যবহার।
  • জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ, পর্যবেক্ষণ এবং আধুনিক গবেষণার জন্য যুগোপযোগী প্রকল্প বাস্তবায়ন।
  • আধুনিক কৃষিভিত্তিক কলকারখানা, ব্যবস্থাপনা, সম্প্রসারণ এবং গবেষনাগার লক্ষ্যে কাজ করা।
  • পরিবেশের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সৌর-সেচ, জল-পাম্প প্রকল্পের আধুনিকীকরণ এবং সহজলভ্যতা ।
  • পরিবেশ দূষণরোধে ইটভাটায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার।
  • পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভারসাম্যের জন্য সময় উপযোগী ব্যবস্থাপনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন।
  • বেসরকারিখাতকে এগিয়ে আসার জন্য উৎসাহ এবং যথাযথ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা।
  • প্রাকৃতিক গ্যাস ও পানি অপচয় থেকে জনকল্যাণকর সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
  • বায়ু, শব্দ, ও পানি দূষণ থেকে বাঁচার লক্ষ্যে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
  • সময় উপযোগী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, সরকারি বৃত্তি প্রদান এবং উন্নত গবেষণার লক্ষ্যে ছাত্রসমাজকে উদ্বুদ্ধকরা। এছাড়া সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে,বেশিবেশি সভা, সেমিনার, কর্মশালা ইত্যাদির কার্যক্রমের ব্যবস্থা।
  • সময় উপযোগী ও বাস্তবমুখী আইন প্রণয়ন এবং এর সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

১৯৮২ সালের আন্তর্জাতিক সমুদ্র বিষয়ক চুক্তিতে যে বিষয়গুলো রয়েছে তার মধ্যে সমুদ্র সীমানা নির্ধারণ অন্যতম। এই চুক্তি অনুযায়ী সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত সকল দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হবে। আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট দেশের ভূমিরেখা বা বেজলাইন থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত হবে আঞ্চলিক সমুদ্র অঞ্চল, পরবর্তী ২৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত হবে সন্নিহিত অঞ্চল, ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত হবে অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ২০০ মাইল মহীসোপানের তলদেশ ভোগের অধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এইসীমা ৩৫০ মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশ ভোগ করা যাবে, এক্ষেত্রে সমুদ্র তীরবর্তী যেকোন দেশকে আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন ১৯৮২ এর ধারা: ৭৬ অনুসারে ২১ সদস্য বিশিষ্ট মহীসোপান কমিশনের নিকট দাবি জানাতে হয়।

মানবসৃষ্ট দূষণই সমুদ্র দূষণের প্রধান কারণ, কেননা পরিত্যক্ত প্লাস্টিক, আবাসিক বর্জ্য, রাসায়নিক কীটনাশক, শিল্প-কারখানার পরিত্যক্ত রাসায়নিক বর্জ্য, গভীর সমুদ্র খনি খনর্ন সংক্রান্ত, সমুদ্রের তেলবাহী জাহাজ দুর্ঘটনা, পরিত্যক্ত জাহাজ মেরামত, বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ ইত্যাদিসহ প্রতিনিয়ত সমুদ্রের পানি দূষণে সমুদ্রের উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল সরাসরি হুমকির সম্মুখীন হয়। সমুদ্রের পরিবেশ দূষণরোধে ২০০৪ সালে স্টকহোম কনভেনশন আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত হয়। যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক ডিসক্লারেশন ১৯৯২ এর নীতি ১৫ আলোকে মানবস্বাস্থ্য এবং স্থায়ী জৈবদূষণ থেকে পরিবেশকে রক্ষা করা। এর ধারাবাহিকতায়, সামুদ্রিক সম্পদ এবং পরিবেশের উপর জোর দিয়ে ২০১৭ সালে জাতিসংঘে মহাসাগর বিষয়ক একটি সম্মেলন হয়, এই সম্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো মহাসাগর, সমুদ্র এবং সমুদ্র সম্পদ সংরক্ষণ এবং এর টেকসই উন্নয়নের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এছাড়াও, পৃথিবীর জলবায়ু এবং এর প্রতিকূল প্রভাব মানবজাতির উদ্বেগের প্রধান কারণ। এছাড়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বায়ুমণ্ডলের গ্যাসের ঘনত্ব অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ায় পৃথিবীপৃষ্ঠ, বায়ুমণ্ডল এবং মানবজাতির উপর বিপরীতমুখী প্রভাব বিস্তার করে। গবেষণায় উঠে এসেছে যে, আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিষয়ক আইন ও নীতিমালায় নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। ইহা প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বের ধনীদেশগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষণে বিভিন্নভাবে দায়ী, যার ফলে দরিদ্র দেশগুলো নানাবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। জলবায়ুর বিপর্যয় এবং জলবায়ুর অতিরিক্ত পরিবর্তন রোধে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সম্মেলনের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো গ্রীনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ স্থিতিশীল রাখা, যা পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়া ওজোনস্তর সংরক্ষণের লক্ষ্যে ১৯৮৫ সালে ভিয়েনা কনভেনশন এবং তার দুই বছর পর ১৯৮৭ সালে মন্ট্রিল প্রটোকল নামে আরেকটি আন্তর্জাতিক নীতিমালা গৃহীত হয়, যার লক্ষ্য পৃথিবীর ওজোনস্তর ক্ষয়কারী দ্রব্য সামগ্রীর ব্যবহার রোধে বিকল্প ব্যবহার নিশ্চিত করা।

আঞ্চলিক পানি ও সামুদ্রিক অঞ্চল আইন ১৯৭৪ এর ধারা ৮ অনুসারে, বাংলাদেশ সরকার সামুদ্রিক দূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে এবং সামুদ্রিক পরিবেশের গুণগত এবং পরিবেশগত ভারসাম্য সংরক্ষণের যেকোন ব্যবস্থাগ্রহণ করতে পারবে। পাশাপাশি ধারা ৯ অনুযায়ী রাষ্ট্র এর সমুদ্রপৃষ্ঠে আঞ্চলিক সামুদ্রিক অঞ্চল, সন্নিহিত অঞ্চল, অর্থনৈতিক ও মহীসোপানের তলদেশের অবস্থিত সকল সম্পদের একচ্ছত্র অধিকার দাবি করতে পারবে। যদিও আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক গৃহীত রায় অনুযায়ী বাংলাদেশ সমুদ্রপৃষ্ঠে ২০০ নটিক্যাল মাইল অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ২০০ মাইল মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সকল প্রকার সামুদ্রিক সম্পদের উপর একচ্ছত্র অধিকার অর্জনকরে। যা বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে অধিকহারে প্রভাব বিস্তার করবে। অধিকিন্তু, বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮ (ক) তে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে রাষ্ট্রযন্ত্র যথাযথ কার্যপ্রণালীর প্রস্তুতি এবং কার্যক্রম গ্রহন করিবেন। ইহা প্রত্যাশিত যে, রাষ্ট্রযন্ত্র দেশের সার্বিক উন্নয়নের উদ্দেশ্য সাধনে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিমালা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জনগণের মাঝে গণসচেতনতা সৃষ্টি করবে। এছাড়াও ক্ষেত্রবিশেষে জনগণকে প্রণোদনা প্রদানে নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে। তাছাড়া, আধুনিক এবং টেকসই উন্নয়নের প্রয়োজনে রাষ্ট্র যেসকল উদ্যোগ নিয়েছে তার সঠিক ও যুগোপযোগী বাস্তবায়ন করাই হবে প্রধান পদক্ষেপ। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী দেশের পরিবেশ রক্ষা এবং সংরক্ষণ করা সম্ভব। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উহার উপাদানসমূহের টেকসই ব্যবহার, জীব সম্পদ ও তদ্ সংশ্লিষ্টজ্ঞান ব্যবহার হইতে প্রাপ্ত সুফলের সুষ্ঠু ও ন্যায্য হিস্যা বণ্টন এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে বিধান করিবার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিকভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এর ফলশ্রুতিতে, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন, ২০১৭ গৃহীত হয়, এই আইনের ধারা ২(১৯) অনুযায়ী বলা যায় যে, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে জীব সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্য তৈরি বা উৎপাদন যেমন: ঔষধ, শিল্পে ব্যবহার্য এনজাইম, খাদ্যের সুগন্ধি, মানবদেহে ব্যবহার্য সুগন্ধি ও প্রসাধনী, রং, ইমালসিফাইয়ার, ওলিওরেজিন্‌স, প্রভৃতিসহ অণুজীব, শস্য, মৎস্য এবং প্রাণিসম্পদের কৌলিগত পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে অন্য জীব হইতে নির্যাস বা জিন সংগ্রহ করা যাবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে, ধারা: ৫ এর অধীনে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ক গবেষণা, গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ প্রকাশ কিংবা প্রকাশিত হইলে, উহা কোনো সেমিনার বা কর্মশালায় উপস্থাপন বা প্রচার করা যাইবে এবং উহাতে প্রাপ্ত ফলাফল বা মতামত জাতীয় কমিটি উহার কার্যাবলী সম্পাদনকালে বিবেচনায় লইতে পারিবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আন্তঃবাহিনী গণসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এর ব্যবস্থাপনায় গত ২১ জুন ২০১৮ থেকে সমুদ্রে নিরাপদ জাহাজ চলাচল, নীল (Blue) ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতি উন্নয়ন, সমুদ্র সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষায় হাইড্রোগ্রাফির (পৃথিবীর জলভাগ সম্বন্ধে গবেষণা) গুরুত্ব তুলে ধরতে বিশ্বব্যাপী “হাইড্রোগ্রাফি” দিবস ২০১৮ পালিত হয়েছে। এছাড়া এই সেমিনারের মূল উদ্দেশ্য হল জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক ২০৩০ কর্মসূচীর বাস্তবায়ন, যা কিনা সাগর, মহাসাগর, সমুদ্র উপকূল এবং সামুদ্রিক সম্পদের সঠিক হিস্যা, ব্যবহার এবং টেকসই উন্নয়ন।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকার যেসকল নীতিমালা গ্রহণ করেছে তার মধ্যে ধারা২ (চ) তে পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে এর গুণগত ও পরিমাণগত মানের উন্নয়ন ও অবনতিরোধে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। কিছু কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্যদ্বারা পরিবেশের ক্ষতি সাধন হয়, এ ক্ষতি থেকে নিরুপায় এর জন্য দূষিত বর্জ্য নিষ্কাশন এর মাধ্যমে ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা সম্ভব। পরিবেশের দূষণরোধে ধারা ২ (খ) তে পরিবেশ দূষণের কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে বায়ু, পানি বা মাটির তাপ, স্বাদ, গন্ধ, ঘনত্ব বা উহাদের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন অথবা সংমিশ্রন অথবা নির্গমনের মাধ্যমে পরিবেশ বা অন্য সবধরণের জীবনসহ জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক, অহিতকর বা ধ্বংসাত্মক কার্য বলে ধরে নেওয়া হয়। পরিবেশগত সমস্যা এবং সমাধানের লক্ষ্যে , ধারা ৫ (১) উল্লেখ করা হয়েছে যে, পরিবেশের অবক্ষয়ের কারণে কোন এলাকার সংকটাপন্ন অবস্থায় উপনীত হইয়াছে বা হইবার আশংকা রহিয়াছে তাহা হইলে সরকার উক্ত সংকটাপন্ন অবস্থা হইতে উত্তোরণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করিবে। এর পাশাপাশি ধারা ৬(১) অনুযায়ী বলা যায় যে, স্বাস্থ্যহানিকর বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া বা গ্যাস নিঃসরণকারী যানবাহন চালানো যাইবেনা বা উক্তরূপ ধোঁয়া বা গ্যাস নিঃসরণ বন্ধ করার লক্ষ্যে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্যকোন ভাবে উক্ত যানবাহন চালু করা যাইবেনা৷ যথোপযুক্ত প্রতিকারের লক্ষ্যে ধারা ৬ (১) অনুযায়ী ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে৷

এছাড়াও বন্য পশুপাখি বা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকার যে নীতিমালা প্রদান করেছেন তারমধ্যে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অন্যতম। এই আইনের ধারা : ২ (৮) বলা হয়েছে ‘‘কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি” যার অর্থ হলো পৃথিবীর উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র্য সংরক্ষণে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি (১৯৯২), যাহার মূললক্ষ্য জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, ইহার উপাদানসমূহের টেকসই ব্যবহার এবং উহা হইতে প্রাপ্ত সম্পদের সুষ্ঠু ও সুষম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। তাছাড়া অভয়ারণ্যের প্রয়োজনে, ধারা : ১৩ (১) বলা হয়েছে যে, সরকারি বন, বনের অংশ, সরকারি ভূমি, জলাভূমি বা যেকোন নির্দিষ্ট এলাকাকে বন ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণের নিমিত্ত সুনির্দিষ্টভাবে সীমানা নির্ধারণ পূর্বক, অভয়ারণ্য ঘোষণা করিতে পারিবে। এছাড়াও ধারা : ১৩ (৩) অনুযায়ী বলা যায় যে, কোন জলাভূমিকে অভয়ারণ্য হিসাবে ঘোষণা করা হইলে উক্ত এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠী, যেমন-জেলে, নৌকাচালক ইত্যাদি পেশাগত, প্রথাগত বা জীবন জীবিকার অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখিতে হইবে। জনগণের বিনোদনের প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সাফারী পার্ক, ইকোপার্ক, উদ্ভিদ উদ্যান এবং বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র তৈরি করতে পারব। এই ক্ষেত্রে, ধারা : ১৯ (১) অনুযায়ী বলা যায় সরকার, বন্যপ্রাণীরসংরক্ষণ, গবেষণা, জনসাধারণের চিত্তবিনোদন বা শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যেও উদ্দেশ্যে যেকোন সরকারি বনভূমিকে, সাফারী পার্ক, ইকোপার্ক, উদ্ভিদ উদ্যান বা ক্ষেত্রমত, বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্র হিসাবে ঘোষণা করিতে পারিবে। এর পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যসংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকার বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এর ধারা : ২২ (১) অনুযায়ী সরকারি ভূমি, ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমি বা বৃক্ষরাজি অথবা সংরক্ষিত বন, খাসজমি, জলাভূমি, নদী, সমুদ্র, খাল, দীঘি বা বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত পুকুরকে উক্ত এলাকার প্রথাগত বা সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং অনুশাসন সংরক্ষণ সাপেক্ষে বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা হিসাবে ঘোষণা করিতে পারিবে।

এমতাবস্থায়, বলা যায় যেদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করাই হবে মূল উদ্দেশ্য। আন্তর্জাতিক আইনের পাশাপাশি দেশের প্রচলিত আইন দ্বারা আর্থসামাজিক এবং টেকসই উন্নয়ন করা সম্ভব। তবে সমুদ্র সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি নির্দিষ্ট এবং স্বয়ং সম্পূর্ণ আইন প্রণয়ন করা অতীব জরুরী। পাশাপাশি বলা যায় যে,সমুদ্রে বিদ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষা যতটা না জরুরী, তারচেয়ে বেশি জরুরী প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্য এবং ভারসাম্য রক্ষা করা। বর্তমানে যে সকল বৃহৎ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নাধীন আছে, এ গুলোর সঠিক এবং যথাযথ বাস্তবায়ন করা ও নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নানাবিধ প্রতিকুলতা থেকে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করাই হবে সমৃদ্ধির বাংলাদেশ। পরিশেষে বলা যায় যে, একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নীল অর্থনীতি ও সবুজ অর্থনীতি উভয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা নীল অর্থনীতি দেশের সামুদ্রিক সম্পদের উন্নয়নে এবং সবুজ অর্থনীতি দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। এ সকল অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশে প্রচুর পরিমাণে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এই উন্নয়নের ও অগ্রগতির ধারা বজায় রাখতে সরকার এবং জনগণকে একসাথে কাজ করতে হবে। নানাবিধ প্রতিকূলতা থেকে বেরিয়ে এসে, রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়ন এবং অর্থনীতির চালিকাশক্তিকে শক্তিশালী করতে পারলেই একটি সুন্দর দেশ গড়া সম্ভব।

লেখক : পিএইচডি গবেষক ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী