কাজী শরীফ, সহকারী জজ

দুর্নীতি উদযাপনের রীতি ও আমাদের নির্লিপ্ততা

কাজী শরীফ:

আইন বিষয়ে অন্তত একদিন পড়াশুনা করেছেন কিন্তু গাজী শামসুর রহমান স্যারকে চেনেন না কিংবা স্যারের লেখা বই পড়েননি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। গাজী শামসুর রহমান আইনের জগতে শুধু বিচারক হিসেবেই খ্যাত ছিলেন না লেখক হিসেবেও তিনি অনন্যসাধারণ ছিলেন। সে অসাধারণ মানুষটির বড় সন্তানের নাম আইনুন নিশাত। ঠিক ধরেছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত শিক্ষক, গবেষক ড. আইনুন নিশাত স্যারের কথাই বলছি। গাজী শামসুর রহমান স্যার ও আইনুন নিশাত স্যারের অবস্থা অনেকটা সত্যজিত রায় ও সুকুমার রায়ের মত। কখনো পিতাকে দিয়ে আমরা সন্তানকে চিনি, কখনো সন্তানকে দিয়ে আমরা পিতাকে চিনি তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা ব্যক্তি পরিচয়েই আমাদের কাছে সম্মানের সাথে পরিচিত হন। সে গাজী শামসুর রহমান স্যার পুত্র আইনুন নিশাতকে বিয়ে করানোর জন্য পাত্রী দেখাতে মেয়ের বাড়ি গেলে মেয়ের বাবা না করে দেয়ায় বিফল মনোরথে বাড়ি ফিরে আসতে হয়! আমি একজন কন্যার পিতা হিসেবে মানুষ এমন মেধাবী ও শিক্ষিত পরিবারের সাথে আত্নীয়তা না করে ফিরিয়ে দেয়াটা আমাকে অবাক করেছে। আপনাকেও চমকে দিচ্ছে তো! এর পাশাপাশি যখন মাথায় রাখবেন আইনুন নিশাত স্যার বুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ সেসময় পাশ করেছিলেন তখন ব্যাপারটা আরো অবাক করার মত নয় কী! শুধু সে সময় কেনো এ সময়ও বুয়েট, মেডিকেল কিংবা স্বনামধন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন পাত্র বিয়ে করতে চাইলে কন্যার বাবা না করার আগে অন্তত দু’বার ভাববেন! সেখানে সত্তর দশের শুরুর দিকে কন্যার পিতা কর্তৃক আইনুন নিশাত স্যারকে পত্রপাঠ বিদায় করে দেয়ার ব্যাপারটা কন্যার পিতা হিসেবে আমার এ যুগেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়! আপনাদেরও কিছুটা নিশ্চয়ই!

আমার ধারণা পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। আর কথা না বাড়িয়ে আসল কথায় আসি। যখন আইনুন নিশাত স্যার সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে বের হয়েছেন তার এক দশক আগে আইয়ুব খান বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্র তত্ত্ব বের করেন! দেশজুড়ে ব্যাপক উন্নয়ন ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রচুর স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছিলো। সে উন্নয়নে কাজে লাগানো হচ্ছিলো প্রচুর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে। সেসময় একটা কথা বাজারে প্রচলিত ছিলো আইয়ুব সরকার মৌলিক গণতন্ত্রের নামে ভয়াবহ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত আর সে দুর্নীতির ভাগ পাচ্ছেন সারাদেশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারেরাও। আইনুন নিশাত স্যার যে মেয়েকে বিয়ে কিরতে গিয়েছিলেন সে মেয়ের বাবা দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারে এমন আশংকাযুক্ত ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি নন!

দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত। আগামী ২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবো। এমন সময় বুকে হাত দিয়ে কয়জন মেয়ের বাবা বলতে পারবেন দুর্নীতি করতে পারেন কিংবা দুর্নীতিবাজ এমন ছেলের সাথে তারা মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি নন? বরং আমরা এর উল্টো চিত্রই বেশি দেখি। ছেলে সরকারি চাকুরি করে, বেতন কম কিন্তু আলগা রুজি আছে এমন সার্টিফিকেট দিয়ে মেয়ে বিয়ে দেয়ার রীতি সমাজে বিরল নয়!

শুধু মেয়ের বাবা নিয়ে আলোচনা করলে নিজের ও শ্বশুরের গায়ে লাগে। আমাদের পিতার দিকেই তাহলে এবার দৃষ্টিপাত করা যাক। কয়জন বাবা আছেন সন্তানকে জিজ্ঞেস করেন -তোমার আয় হালাল তো? তুমি আমাকে হারাম পয়সা দিয়ে এসির বাতাস খাইয়ে গাড়িতে নিয়ে ঘুরছো না তো? আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কষ্ট পাই বলে যে লিফটওয়ালা ফ্ল্যাটে রেখছো তা তোমার বেতনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তো? তোমার মাকে যে ১১ হাজার টাকা দিয়ে জামদানি দিয়েছো, স্ত্রীর জন্য ব্যাংকক থেকে কেনাকাটা করলে, সন্তানের জন্য জাপান থেকে পুতুল এনেছো, মেয়েকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াচ্ছো কিংবা ছেলেকে অভিজাত বেসরকারি মেডিকেলে পড়াচ্ছো তা হালাল বেতনের টাকা দিয়ে তো?

কয়জন স্ত্রী আছেন স্বামী কালো টাকা সাদা করতে বেনামী প্রতিষ্ঠান খুলতে গেলে স্ত্রী ফর্মে স্বাক্ষর করার আগে জিজ্ঞেস করে “তুমি এত টাকা কোথায় পেয়েছো?” ক’জন স্ত্রী জিজ্ঞেস করে এ কয় টাকা বেতন পেয়ে কীভাবে ছেলেমেয়েদের এত ব্যয়বহুল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াও? আমাদের কয়জন মা বাবা জিজ্ঞেস করেন “বাবা, আমাকে ও তোর মাকে হজে পাঠাতে তুই এ আট লাখ টাকা কোথায় পেয়েছিস?”

অধিকাংশই জিজ্ঞেস করেনা। জিজ্ঞেস করার লোক নেই। আমরা নগদ নারায়ন যা পাচ্ছি তাই নিয়ে আনন্দে টগবগ করছি। আমাদের অসৎ উপার্জনে স্ত্রী পাশের বাসার ভাবির সাথে আভিজাত্য দেখায়, আমাদের সন্তানরা হারাম উপার্জনে ফুলে ফেঁপে উঠছে, আমাদের ভাইবোনেরা আর রেস্টুরেন্টে বছরে দুই একবার যায়না! শিশা বারগুলোতে ভীড় বাড়ে প্রতি সন্ধ্যায়! আমাদের কন্যারা ঐশী হয়, আমাদের পুত্রদের ঠিকানা হয় মাদকাসক্তি পুণর্বাসন কেন্দ্রে! ওদিকে প্রায়শই পত্রিকায় আসে এ সরকারি কর্মচারী চার হাজার কোটি টাকার মালিক, ঐ সরকারি কর্মচারী তিন বছরে করের টাকা মেরে দিয়েছে তিন কোটি,পুলিশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে নেমে দুদকের পরিচালক ঘুষ খায় ৪০ লাখ টাকা! যে পুলিশ ৪০ লাখ টাকা দিলো বলে নিজ মুখে স্বীকার করেছেন তার কত বছরের বেতন যোগ করলে ৪০ লাখ টাকা হয় সে প্রশ্ন করার লোক কোথায়?

আমাদের রাস্তা করতে গেলে দুর্নীতি হয়, আমাদের সেতু করতে দুর্নীতি হয়, আমাদের বালিশ তোলার বিল দুনিয়ায় সর্বোচ্চ,আমাদের হাসপাতালে দুর্নীতি হয়, আমাদের আদালতপাড়ায় দুর্নীতি হয় এগুলো আমরা সবাই জানি কিন্তু বলিনা। যখন অন্য কেউ করে ও ধরা খায় তখন ছি :ছি : বলি। দেশটা রসাতলে গেলো এ আফসোস করতে করতে চ্যানেল পাল্টে অন্য চ্যানেলে মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী কিংবা মেহজাবিন চৌধুরীর নাটক দেখি! কিন্তু যে টিভিতে দেখলাম, যে সোফায় গা এলিয়ে দিলাম, যে বাসায় থাকলাম তা হালাল টাকার কিনা তা নিয়ে আমাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই!

মাত্রই ইদুল ফিতর গেলো। ইদগাহের প্রথম কাতারে কারা বসেছেন তা নিশ্চয়ই দেখেছেন। কারা এখন মসজিদ কমিটির সভাপতি তা নিশ্চয়ই অজানা নয়। কাদের হাজী সাহেব, সভাপতি সাহেব বলতে বলতে ইমাম সাহেবের মুখে ফেনা উঠে তা নিশ্চয়ই আপনি জানেন! কাদের সাহায্যে ইদগাহে ত্রিপল লাগানো হয়, কাদের সাহায্যে আগামী ইদে ইদগাহ পাকা করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে তা আপনার অজানা নয় নিশ্চয়ই!

তারা কত টাকা বেতন পান, কোন পদে আছেন কীভাবে চলেন তা আমার আপনার কারোরই অজানা নয়! আমরা সবই দেখি, বুঝি আবার দুর্নীতির এ উদযাপনে শরিকও হচ্ছি!

একই পদে থেকে কেউ নন এসি বাসে চেপে রিকশায় করে বাড়িতে আসেন আর কেউ ব্যক্তিগত গাড়িতে এসির বাতাস খেতে খেতে বাড়িতে আসার পথে বাজারেই গাড়ি রেখে কোলাকুলি করতে করতে রাজনৈতিক নেতার মত বাড়িতে ঢুকেন! যে গ্রামের সহজ সরল মানুষটি এতক্ষণ চা দোকানে বসে এর ওর দুর্নীতির হারাম পয়সা নিয়ে কথা বলে সামনের জনকে থুতু বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দিচ্ছিলেন তিনিই দৌড়ে গিয়ে সে ব্যক্তির প্রশস্ত বুকে কোলাকুলি করে ও নরম হাতে করমর্দন করে গদগদ হাসিতে তৈলাক্ত হচ্ছেন! যে পরিশ্রমী বাসে টেম্পুতে চড়ে তার হাত হয় শক্ত, তার গায়ে থাকে ঘাম, চেহারায় থাকে রুক্ষতা, তার জুতোয় থাকে ধুলোর আস্তরণ। আমাদের সমাজ এমন মানুষকে মানবে কেনো?

রোজা না রাখলে ইদের নামাজের সামনের কাতারে বসতে হুজুর নিষেধ করলেও হারাম খেয়ে বেঢপ শরীর বানিয়ে বসে নামাজ পড়তে না পারলে সামনের কাতারেই হুজুর তাদের জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা করেন। কাদের জন্য এ ব্যবস্থা, কারা আমাদের সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিয়ামক তা কী আর প্রকাশ্যে বলার প্রয়োজন আছে?

আপনি ভাবতে পারেন আমি নৈরাশ্যবাদী কিংবা পরশ্রীকাতর। আপনি এও ভাবতে পারেন না পেতে পেতে হতাশায় আমি এসব লিখছি। ভাবতে আপনি নিশ্চয়ই পারেন। আমি বরং আমার জীবনের একটি গল্প ও সিদ্ধান্ত বলে লেখার শেষের দিকে হাঁটি। আমার বিয়ের আগে আম্মা মেয়ে দেখা শুরু করেন। বিয়ের কথা এগুলেই আমি হবু পাত্রীর সাথে ফোনে কথা বলি। মূলত দুটো কথা বলার জন্য কথা বলতে হতো। আমি গুছিয়ে কথা বলতে জানিনা বলে সোজাসুজিই বলতাম।

১. আপনার কি কোন প্রেমের সম্পর্ক আছে? থাকলে আমাকে বলেন। আমিই বলবো আপনাকে আমার পছন্দ হয়নি। বিয়ের পর আপনি আমাকে নিয়ে অশান্তিতে থাকবেন এটা আমার সহ্য হবেনা!

২. আমি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। এত টাকা মাইনে পাই। আপনার কী এতে চলবে?

মাইনের কথা শুনেই মেয়েদের গলা শুকিয়ে যেতো? আপাত কঠিন ভবিষ্যতের কথা ভেবে তারা আরো পড়াশুনা করবে বলে এগুতো না! একজন আমাকে পছন্দ করে ফেলে। তিনি আবদার করেন আমি যেনো অন্য কোথায় চেষ্টা করি। তাতে স্বাচ্ছন্দ্য ও সুখ দুটোই আসবে। আমি তাকে বিয়ে করিনি। আল্লাহর রহমতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তিনি যদি ঘরে আসতেন ও আমার মাইনে এ চাকুরিতে এসে আরো ২০ ভাগ কমে গেছে বলে জানতেন তাহলে আমার বিরুদ্ধে বিবাহ বিচ্ছেদের আগে একটা যৌতুকের মামলা করে দিতেন আর আমি আদালতে আদালতে দৌড়াতাম!

এদেশ এখন দখল করে নিয়েছে উচ্চবিত্ত। এখানে স্বপ্ন দেখতে হয় বিত্তের মানদন্ডে, এখানে সম্মান দেয়া হয় অর্থের স্কেলে মেপে!

আসুন আমরা চ্যালেঞ্জ করতে শিখি। বাবা সন্তানকে, সন্তান বাবাকে,স্ত্রী স্বামীকে,স্বামী স্ত্রীকে। কে কীভাবে আয় করছে ও সে আয়ের ব্যয় কীভাবে করছে তা জানতে হবে নিজ ঘরেই। প্রতিটি ঘর হয়ে উঠুক দুর্নীতি উদযাপনের নয় দুর্নীতি নিবারণের তীর্থক্ষেত্র।

আমি যখন নোয়াখালীতে যোগদান করি তখন আমার জেলার অতিরিক্ত মূখ্য বিচারিক হাকিম জনাব আলমগীর মোহাম্মদ ফারুকী স্যার বলেছিলেন ” শরীফ সৎ থাকার আনন্দ আছে, গৌরব আছে। এমন হও যেনো তুমি মারা গেলে তোমার লাশ কাঁধে নিয়ে মানুষ যাবে,পেছন থেকে মানুষ কলেমা শাহাদাত পড়বে আর বলবে লোকটা সৎ ছিলো।”

তেমন জীবনের চেষ্টায় রত হোক বাংলাদেশ। আমাদের একজন বঙ্গবন্ধু ছিলেন। যিনি বাঙ্গালিকে নিয়ে দু:খ করে “আমি পেলাম চোরের খনি”বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিক উদযাপনের আগে এই যে সামাজিকভাবে দুর্নীতির উদযাপন ও দুর্নীতিবাজদের আগ্রাসন তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে হবে আমাদেরই।

নাহয় কাজীর গরু কিতাবেই থাকবে গোয়ালে দেখা মিলবেনা!

লেখক- সহকারী জজ, নোয়াখালী।