ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ

সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে বাঙালির সংগ্রাম

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: 

“ভাঙি’ মন্দির, ভাঙি’ মসজিদ/ভাঙিয়া গির্জা গাহি সংগীত,/এক মানবের একই রক্ত মেশা/কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।”

যুগে যুগে মানবিক সমাজের স্বপ্নই দেখেছে বাঙালি জাতি। বাঙালি জাতি ধর্মের প্রতি যেমন আস্থা রেখেছে, তেমনি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দেখেছে বাঙালি জীবন এবং জাতির সার্বিক উন্নয়ন। ইতিহাসের রাজপথে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির গোলকধাঁধায় বাঙালি বিভ্রান্ত যে হয়নি এমনটি নয় কিন্তু বাঙালি তার নিজস্ব পন্থায় রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম চালিয়ে আজ অবধি মানবতার বিজয়কেই ছিনিয়ে এনেছে বারংবার।

বাঙলা ভাষায় (ধৃ+মন) ‘ধৃ’ প্রকৃতির সঙ্গে ‘মন’ প্রত্যয় যোগে তৈরি হয় ধর্ম শব্দটি। তাই ধর্ম শব্দের আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় ‘যা মনে বা অন্তরে ধারণ করা হয়।’ মানবিক অর্থে মানুষের প্রকৃত ধর্ম হলো মনুষ্যত্ব। যেমন কিনা, পশুর ধর্ম পশুত্ব। ধর্ম মহাপুরুষদের সৃষ্টি হলেও, তাতে বিশ্বাস এবং তাকে পুঁজি করে ব্যবসা এবং রাজনীতি কিন্তু মোটেও এক বিষয় নয়।

সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা। কোনো ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক বলে ধরে নেয়া হয় যখন সে কোনো বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধচারণ বা ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে।

এক্ষেত্রে ব্যক্তি গৌণ, মুখ্য হলো সম্প্রদায়। কেউ কেউ অবশ্য দাবি তোলেন যে, সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে নিজের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ এক ধরনের আনুগত্য কাজ করে থাকে কিন্তু ব্যাপারটি মোটেও তা নয়। জানা মতে, কোনো ধর্মেই অন্য ধর্ম অবমাননা বা অসম্মান করার কথা বলা নেই। ইতিহাস পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট হয় যে, বাঙালি জীবনে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ বপনে কাজ করেছে মূলত কুচক্রী রাজনীতি এবং রাজনৈতিক অনুপ্রবেশকারীরা। বাঙালি সমাজ এবং সংস্কৃতি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সব সময়েই সোচ্চার থেকেছে।

সেই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে শুরু। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপনের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে ‘বঙ্গভঙ্গ’ কার্যকর করেন কিন্তু এই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন কারা? দুই বাংলার হিন্দু এবং মুসলমানেরা। প্রগতিবাদী হিন্দু এবং মুসলমান নেতারা মাঠে-ময়দানে সেদিন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা করে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন আন্দোলনকে উত্তাল করতে। শেষ পর্যন্ত তুমুল সামাজিক আন্দোলনের মুখে ১৯১১ সালে দ্বিখণ্ডিত বাংলাকে জোড়া দিতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ সরকার।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বাতিল হলেও, স্তিমিত হলো না ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। এই গণআন্দোলন রূপান্তরিত হলো স্বাধীনতা আন্দোলনে। একই সঙ্গে ধর্মকে ঢাল বানিয়ে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নতুন মোড় নিল। দাবি ওঠানো হলো ধর্মের ভিত্তিতে ভারত-ভাগের। এ যেন স্বাধীনতা আন্দোলন নয়, ধর্মের বিপরীতে ধর্মের লড়াই। এর চাইতে বড় অধর্ম আর কী-ই বা হতে পারে?

১৯২৩ সালের জানুয়ারিতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ‘স্বরাজ’ নামক রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করতে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য অটুট রাখতে ১৯২৪ সালে অবিভক্ত বাংলার সিরাজগঞ্জে এক সভায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ঘোষণা করেন, ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের অবিসংবাদিত ঐতিহাসিক দলিল ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’। এই প্যাক্টের মূল সুরটি ছিল হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা। কিন্তু শেষ রক্ষা যে হলো না।

লাহোর প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে মুসলমান এবং হিন্দুদের জন্য পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি রাষ্ট্র জন্ম নিল ১৯৪৭ সালে। দ্বি-জাতিতত্বের পাশা খেলায় ধর্মের কার্ড জিতেছে তো বটেই কিন্তু লাহোর প্রস্তাবনা উত্থাপনের বৈঠক তদানীন্তন বঙ্গীয় কংগ্রেস নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, কিরণশংকর রায়, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর অগ্রজ শরৎ চন্দ্র বসু, মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমসহ অনেক নেতাই সেদিন প্রত্যাখ্যান করেছিল। তবে তৎকালীন রাজনীতির রাঘববোয়াল নেতারা কেউই অখণ্ড বঙ্গের পক্ষপাতী ছিলেন না। আর তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, ১৯৪৭-এর দেশভাগ বাঙালি সমাজে হিন্দু-মুসলমানের মাঝে এক বায়বীয় কাঁটা তারের বেড়া তৈরি করেই দিল।

ধর্মের ভিত্তিতে বাঙালিকে টুকরো করা হলো। ধর্মের আফিম ধীরে ধীরে রাজনীতির পতাকা তলে বাঙালি সাম্প্রদায়িকতার ঘর বোনা শুরু করল। বাঙালি জীবনে ধর্ম-অধর্মের বিবাদ ছিল না বলা যাবে না, তবে সম্মিলিত অগ্রযাত্রার উদাহরণও রয়েছে প্রচুর। আমরা দেখেছি, ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতার রাস্তায় হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে।

আবার তারাই ১৯১৯ সালে রাওলাট আইনের সময় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সত্যাগ্রহ আন্দোলনে একে অপরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ১৯৩০ সালে ঢাকার জনগণ যৌথভাবে ‘আইন অমান্য আন্দোলন’ পরিচালনা করেছে। ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার হিন্দু-মুসলমান ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’-এর বন্দিদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করার সময় ঐক্যবদ্ধ ছিল অথচ মাত্র পাঁচ মাস যেতে না যেতেই তারাই প্রচণ্ডতম সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হলো। ১৯৪৬ সালের ভয়াবহ কলকাতা হত্যাকাণ্ড এবং নোয়খালী-ত্রিপুরার চরম নিষ্ঠুরতা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল।

বাঙালি সারাজীবন শিখেছে-

‘মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।/মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ \’

একই আকাশ, একই রবি-শশী, একই রক্ত, একই নাড়ির টান, একই হাওয়া-জল, একই ফুল-ফল, একই মাটি আর একই ভাষাÑ এর কতটুকু আসলে মিথ্যে? মসজিদের আজান আর মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি- বাঙালি প্রাণকে কি একইভাবে আলোড়িত করে না? শ্বেতশুভ্র শেফালি ফুলের সুবাস কি শুধু পূজাই মনে করিয়ে দেয়? পবিত্র আতরের খুশবুতে কি তার এতটুকু ছোঁয়াও থাকে না? মনের পশুত্ব ত্যাগ করতে কোরবানি যেমন দেয়া হয়, দেবী-দুর্গা কি সেই একই কারণে মহিষাসুরকে বধ করেনি? তাহলে বিভেদটা কোথায়?

সমাজ একই, সংস্কৃতিটাও একই কিন্তু রাজনীতির বিশাল জমিনে যখন মন্দির মসজিদ বানিয়ে সবাই মোল্লা আর পুরোহিতের দায়িত্ব নিয়ে বসে, তখন সেখানে হিন্দু-মুসলমানের মাঝে বিভেদের প্রাচীর তো গড়ে উঠবেই। রাম আর রহিম একে অপরকে ঘৃণা তো করবেই। ধর্ম নিয়ে রাজনীতির খেলা, সে এক বড্ড হাড্ডাহাড্ডি খেলা। মন্দির ভাঙলে, গুনে গুনে মসজিদও ভাঙতে হবে, উল্টোটাও সত্যি, না হলে যে ধর্মের আফিম তার নেশাগুণ হারিয়ে ফেলবে। ‘গ’ বলতে কেউ ‘গরু বন্দনায় নিমজ্জিত হয়’ আবার কেউ ‘গাজীর গান গাওয়া’ শুরু করে!

পোশাকেও ছাড় নেই। লুঙ্গি আর ধুতি তো সেই কবেই নিজ নিজ ধর্ম গ্রহণ করেছে। বাঙালি নারীর শাড়িটাকেও বেশিদিন আর মুসলমান রাখা যাচ্ছে না; কাফতান বোরকা আর কাফতান আবায়া এখন মুসলমান নারীর শোভা বাড়াচ্ছে। কী মুশকিল! নাড়– আর সন্দেশ হিন্দু হয়ে গেছে; সেমাই এখনো মুসলমান আছে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই হুঙ্কার দিতেন-

‘হায়রে ভজনালয়,/তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!’

তবে বাঙালি আলোকিত জাতি। ধর্ম ভণ্ডদের ঠিকই চিনে ফেলে। এই বাংলা সুফি, বাউল, বয়াতি, ফকির লালন শাহের। এই বাংলা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির। বাংলার ‘হƒদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনাতে নজরুল’। বাঙালির একহাতে অগ্নিবীণা আর কণ্ঠে গীতাঞ্জলি। চোখের তারায় হাজার সূর্য সঙ্গে নিয়ে বাঙালির পথ চলা। বাঙালির হƒদয়ে অসাম্প্রদায়িক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বসবাস। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাই বাঙালির আজš§ অবস্থান।

ধর্মের আফিম খেয়ে দ্বিজাতিতত্তে¡র জয়-জয়কারে ১৯৪৭-এ যে দেশভাগ হলো, ১৯৭১-এ তারই বিরুদ্ধে লড়াই করে বাঙালি নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে করেছে সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভ। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে করেছে নিষিদ্ধ। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই এখনো দুই বাংলায় চলছে এবং চলবেই।

সরস্বতী পূজার দিনে মেয়র নির্বাচন বাতিল করতে এপার বাংলায় একসঙ্গে রাজপথের আন্দোলন করেছে হিন্দু-মুসলমান। ওপার বাংলায় ‘জয় শ্রীরাম’ আওয়াজ তুলে সাম্প্রদায়িক হুঙ্কার দেয়া হলেও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার পরোয়া না করে তীব্র প্রতিবাদ করেছে অপর্ণা সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়সহ অনেকেই। এপার বাংলায় খোলা তলোয়ার হাতে ‘নারায়ে তাকবির’ স্লোগান কখনোই থামাতে পারেনি নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা। ধর্মের অপব্যবহার নিয়ে ওপার বাংলায় সত্যজিৎ রায় ‘গণশত্রু’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন আর এপার বাংলায় তারেক মাসুদ নির্মাণ করেছেন ‘মাটির ময়না’। এপার বাংলায় ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর সনাতন ধর্মের মন্দিরের নিরাপত্তার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে হাটহাজারীর কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর ওপার বাংলায় সাম্প্রদায়িক নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান স্লোগান দিয়েছে, ‘হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই, একই সঙ্গে থাকতে চাই।’

সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে বাঙালির এই যে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম, তা কি থামানো সম্ভব? কখনোই নয়। মানবপ্রেমী বাঙালির বাউল মন লালনের মতো যে শুধুই জানতে চায় …

‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।/যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান /জাতি গোত্র নাহি রবে।’

লেখক: আইনজীবী ও আইনের শিক্ষক