মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ্ আল-গালিব

পরিবেশ রক্ষায় বিধিবদ্ধ আইন বনাম প্রাকৃতিক আইন

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ্ আল-গালিব:

আমি পরিবেশ আইনের একজন ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যখন পরিবেশ আইন পড়তাম আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আরিফ রব্বানী খান স্যার প্রায়ই একটা বলতেন,পরিবেশ প্রতিশোধ নিতে কখনই পিছপা হয় না। পরিবেশকে আমরা যেভাবে পরিবর্তন করি, ঠিক সেভাবেই আমাদের জবাব দেয়। কথাটা শতভাগ সঠিক। আমরা যেভাবে পরিবেশের ক্ষতি সাধন করে চলেছি, ফলস্বরুপ আমরা ফিরতি কিছু পাব না, তা কি হতে পারে!

আজকাল পত্রপত্রিকা বা ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া যেখানেই চোখ রাখি না কেন, সব জায়গায় পরিবেশ বিপর্যয়ের খবর দেখি। ঢাকা কিংবা দিল্লীর বায়ুদূষণ, অস্ট্রেলিয়া-ব্রাজিলের বনভমিতে আগুন, হিমালয়ের বরফ গলা, জাপানে জলোচ্ছ্বাস, ইতালির বন্যা, অথবা বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি সব কিছুর পেছনেই যে মানুষের হাত আছে তা কে না বোঝে।

আমরা “Sustainable Development” নামে একটা নীতি জানি। পরিবেশ আইনের ভাষায় এই নীতি অনুসারে উন্নয়ন এবং পরিবেশ রক্ষা এক সাথে চলে। গোটা বিশ্বে যে এত এত উন্নয়ন দেখছি আমরা, এই SD নীতির দোহাই দিয়েই চলছে। আমি দৃঢ়চিত্তে দায়িত্ব নিয়ে বলছি, উন্নয়ন এবং পরিবেশ রক্ষা কখনই একসাথে চলতে পারে না। আমরা একটা অজুহাত বের করেছি মাত্র। আপনি অবকাঠামোগত উন্নয়ন  আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন যার কথাই বলেন না কেন, পরিবেশের ক্ষতি করবেন না, এটা কখনই হতে পারে না।

আরও একটা নীতি আছে, “Common but Differentiated Responsibilities” পরিবেশের যে যতটুকু ক্ষতি করবে সে তার জন্য দায়ী থাকবে। উন্নত দেশ যে হারে পরিবেশের বিপর্যয় করছে, সে তুলনায় স্বল্প উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ কম বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। তবে আমরা দেখি ক্ষমতাধরেরা দোষ বেশি করলেও, দায় কাঁধে নেন না।

গোটা বিশ্বে বিভিন্ন সময় পরিবেশ রক্ষা এবং দূষণ রোধে প্রায় ৩০০০ বেশী আন্তর্জাতিক ট্রিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যেমনঃ
1. Declaration of the United Nations Conference on the Human Environment (the 1972 Stockholm Declaration)
2. Rio Declaration on Environment and Development 1992
3. Vienna Convention for the Protection of the Ozone Layer, 1985
4. Montreal Protocol on Substances that Deplete the Ozone Layer, 1987
5. Convention on Biological Diversity, 1992
6. Cartagena Protocol on Biosafety to the Convention on Biological Diversity, 2000
7. United Nations Framework Convention on Climate Change, 1992
8. Kyoto Protocol to the United Nations Framework Convention on Climate Change, 1997
9. Convention on the Protection and Use of Transboundary Watercourses and International Lakes (ECE Water Convention), Helsinki, 1992
10. International Convention on Civil Liability for Oil Pollution Damage (CLC), Brussels, 1969, 1976,1984 and 1992 সহ বিভিন্ন ট্রিটি।

পরিবেশ সংক্রান্ত  এসব আন্তর্জাতিক কনভেনশনগুলোতে কত সুন্দর সুন্দর কথা লেখা আছে কিন্তু বাস্তবতা পুরোটা ভিন্ন। “কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই।” এইসব কনভেনশনের কতটা আমরা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি তা সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ।

বাংলাদেশও সময়ে সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। সে অনুসারে আইন প্রনয়ন করেছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, আমাদের দেশে অদ্যাবধি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে পরিবেশ সম্পর্কিত প্রায় ১৮৫টি আইন রয়েছে।

দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে ১৮ ক অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এবং পরিবেশ আদালত আইন, ২০১০ এ পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিধান প্রনয়ন করা হয়েছে।  তবে এক অদ্ভুত কারণে পরিবেশ আদালতে মামলার সংখ্যা অবিশ্বাস্য ভাবে কম।

এছাড়াও পরিবেশ সংক্রান্ত অন্যান্য আইন এবং বিধিমালা গুলো হলঃ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭,বন আইন ১৯২৭,পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৭৭,কৃষিকীট অধ্যাদেশ ১৯৬২,কীটনাশক অধ্যাদেশ ১৯৭১,মৎস্য সংরক্ষণ আইন ১৯৫০,সামুদ্রিক মৎস্য অধ্যাদেশ ১৯৮৩, বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আদেশ ১৯৭৩, ধোঁয়া আইন ১৯০৫, কিশোর ধূমপান আইন ১৯১৯, প্রেক্ষাগ্রহে ধূমপান নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৫২, ইট পোড়ানো নিয়োন্ত্রন আইন (সংশোধন) ১৯৯২,  ইট-পোড়ানোর (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা,১৯৮৯, পৌর এলাকার মাঠ ও জলাধার সংরক্ষণ আইন, বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ১৯৫৯, পাবলিক পার্ক বা উদ্যান আইন ১৯০৪, অবাঞ্ছিত বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৫, শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬, ইমারত নির্মাণ আইন এবং বিধিমালা, Ozone Depleting Substances (Control) Rules, 2014, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রন ) আইন, ২০১৩, চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা ২০০৮, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১৬ সহ অসংখ্য আইন প্রনীত হয়েছে। কিন্তু এতসব আইন কতটা কাজে আসছে?

বর্তমান সময়ে যে বিষয় নিয়ে গোটা বিশ্ব সংকটে আছে তা হল, “করোনা ভাইরাস”। আমি চিকিৎসা বিজ্ঞান বা অনুজীব বিজ্ঞানের ছাত্র না, হয়ত এই জীবনঘাতী ভাইরাস সংক্রামণের পেছনে অনেক কারণ আছে,  তবু এ কথা বলতে পারি, পরিবেশের চরম বিপর্যয়ে এমন রোগ জীবাণু ছড়ানোতে খুব অবাক হবার কিছু নাই। আমরা নিজেরা নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবে পরিবেশকে যেভাবে ব্যবহার করেছি, পরিবেশ প্রতিশোধ নিবেনা তা ভাবা সত্যি বোকামি।

সম্প্রতি আমরা টিভির পর্দায় দেখেছি,  কক্সবাজারের বালিয়াড়িতে ঝাঁকে ঝাঁকে বিচরণ করছে লাল কাঁকড়া, ডালপালা মেলতে শুরু করেছে সাগরলতা। লোকালয়ের খুব কাছে এসে ডিগবাজিতে মেতেছে একদল ডলফিন। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত  যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।  আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংস্থা গুলো বলেছে,গোটা বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের হার আকস্মিক হারে কমে এসেছে, কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, নিউ ইয়র্কেও চলতি সপ্তাহে কার্বন নিঃসরণ কমেছে ১০ শতাংশ।ব্রিটিশভিত্তিক গবেষনা প্রতিষ্ঠান  থিংকট্যাংক কার্বন ব্রিফ বলেছে, গত দুই মাসে চীনে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ২৫ শতাংশ কমে গেছে। ওজন লেয়ার কাজ করছে আগের তুলনায় বেশি। কলকারখানা গুলো বন্ধ থাকাতে ধূলি ধোঁয়া ও বিষাক্ত পদার্থ যেমন কমে এসেছে, প্রকৃতি ফিরে পেয়েছে প্রাণ।

জাতিসংঘের তথ্য মতে প্রায় ৭৫ ভাগ রোগ পশুপাখির মাধ্যমে মানুষের শরীরে ছড়ায়। তাই প্রকৃতি যতটা স্বাভাবিক থাকবে, পশুপাখি যতটা নিরাপদে বিচরণ করতে পারবে মানুষ ঠিক ততটাই কম রোগে আক্রান্ত হবে।

পবিবেশকে আমরা তার সুবিধা মত অগ্রসর হতে না দিলে, যতই আইন প্রনয়ন করিনা কেন, পরিবেশ বিপর্যয় আমরা ঠেকাতে পারছি না। হয়ত তাই সময়ে সময়ে পরিবেশ নিজেই আইন তৈরী করে এবং তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখছে , প্রস্তুত করছে আগামীর জন্য সবুজ,সুন্দর,বসবাসযোগ্য একটা নবযৌবনা পৃথিবী।

লেখক- শিক্ষানবীশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।
email: ghalibhit@gmail.com