আবদুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বান্দরবান

আদালতের স্মৃতি: মোনাফেক…

আবদুল্লাহ আল মামুন:

(১)

বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, নীচের ছবির হাতে লেখা সূত্র একটি নিটোল প্রেমের গল্প।

মাস খানেক আগের কোন একদিন। প্রায় ৪ টা বাজে। কগনিজেন্স, ট্রায়াল শেষ করে আমি ক্লান্ত। কোর্ট পুলিশ একটা ১৫ বছরের মেয়েকে নিয়ে এসেছে। সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কামরুন্নাহার মেয়েটার ২২ ধারার জবানবন্দী নিয়েছে। ছিপছিপে, শুকনো, শ্যামলা, ছোট্ট ভীত একটা মেয়ে। একদম বাচ্চা। মেয়েটা অপহরণ মামলার ভিক্টিম। তদন্তকারী কর্মকর্তা মেয়েটার ডাক্তারী পরীক্ষার অনুমতি চেয়েছেন। মেয়েটা নাবালিকা হওয়ায় নিজ জিম্মায় দেওয়া যাবে না। মেয়েটাকে কেউ জিম্মায় নিতে হবে। নয়তো সেফ হোমে পাঠাতে হবে।

মেয়েটাকে নেওয়ার জন্য কেউ আসেনি। পুলিশ বললো, বাবা কোর্টে এসেছিলো। মেয়ের সাথে কথা বলেছে। মেয়েটা বলেছে, বাবার সাথে জিম্মায় যাবে না। বাসায় যাবে না। জেলে যাবে। বাবা রাগ করে কোর্ট থেকে চলে গিয়েছে। মেয়েটা নাকি বিয়ে করেছে। ঐ ছেলেকে পুলিশ ধরেছে। ছেলেটা জেলে আছে।

(২)

আমি নড়েচড়ে বসলাম। এজাহারটা পড়লাম। ২২ ধারায় ভিক্টিমের/ বাচ্চাটার জবানবন্দীটা পড়লাম। অভিযুক্ত মেয়েটার গৃহ শিক্ষক। পড়ানোর সাথে সাথে মন লেনদেন হয়েছে। ছেলেটা দরিদ্র। টিউশনি করে সংসার চালায়। পড়ালেখার খরচ চালায়। মেয়েটার বাবার হোটেল ব্যবসা আছে। বাবা মেয়েটাকে জোর করে বিয়ে দিতে চাইলে মেয়েটা ছেলেটার সাথে পালিয়েছে। পালিয়ে বিয়ে করেছে। ৫ দিন পরে পুলিশ মেয়েটাকে ছেলের বাড়ি থেকেই আটক করেছে। ছেলেকে আগে ধরেছে। এরপর, মেয়েকে।

(৩)

আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করলাম-ছেলেটা কোথায়?
– জেলে।
তুমি কি চাও?
– আমিও জেলে যেতে চাই। ওর সাথে থাকবো।

কি ভয়ংকর বিষয়।
স্বেচ্ছায় কারাবরণ! এই বাচ্চা মেয়ে কেন জেলে যাবে?

আমি এজাহারে ঠিকানা দেখলাম। সদরের মামলা। মেয়েটার বাবা এজাহারকারী। মেয়েটার বাবার হোটেল সদরেই। এজাহারের নীচে উনার মোবাইল নাম্বার আছে। কি মনে করে উনাকে আমি ফোন করলাম। পরিচয় দিয়ে কোর্টে আসতে বললাম।

(৪)

১০ মিনিটের মাথায় উনি হাজির। জিজ্ঞাসা করলাম। এটা তার বড় মেয়ে। লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছেন না। বাচ্চা মেয়ে। আরও বাচ্চা আছে। ক্লাস সেভেনে পড়ে মাত্র। স্কুলে না গিয়ে এসব করে বেড়াচ্ছে। বড় মেয়ে যদি এসব করে ছোটটা কি করবে?
আমি মনোযোগ দিয়ে ১৫/২০ মিনিট ধরে তাকে বলতে দিলাম। যখন বুঝলাম তার আর কিছু বলার নেই,তখন তাকে বললাম এই ছেলেটা কেমন? বলে -ভালো। খারাপ অভ্যাস আছে?
-না।
জিজ্ঞাসা করলাম আপনি যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছেন সে কি করে?
– গ্যারেজের মিস্ত্রি। এইট পাস।
আমি বললাম- এই ছেলেটা ডিগ্রি শেষ বর্ষে পড়ে। শিক্ষিত ছেলে। পাস করলে আপনার পাশে দাড়াবে। এইটা ভালো না গ্যারেজের মিস্ত্রি ভালো?
তিনি নিশ্চুপ।

আমি বললাম- ক্লাস সেভেনের মেয়েকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছেন। এই ঘটনার জন্য আপনি দায়ী। আপনি আপনার মেয়েকে পালাতে বাধ্য করেছেন।
নিশ্চুপ।

(৫)

মাঝে বার বার উনার ফোন আসছিলো। আমি রিসিভ করতে বললাম। উনি কথা বলে বললেন- স্যার, ছেলে বেশি গরীব। ঘরে কিচ্ছু নেই। বাসায় একটা খাটও নেই। মাটিতে শোয় চাটাই বিছিয়ে। মা আর একটা পাগল ভাই আছে। এই ছেলের কাছে মেয়ে কিভাবে দেবো?

আমি বললাম- টাকা না থাকা সমস্যা না। ছেলেটার স্বভাব ভালো। সে উঠে দাড়াবে। আপনি আপনার মেয়ের সাথে সাথে, ছেলেটার জীবনও ধবংস করছেন।

উনি বললেন- স্যার, ছেলের মা, এলাকার লোকজন নিয়ে হোটেলে বসে আছে।

আমি বললাম, আপনার মেয়েটা ছোট। ছেলেটাও ছোট। আপনারা বড়রা পারেন ওদের জীবন বদলে দিতে। আপনি না আসা পর্যন্ত আমি কোর্টে থাকবো। আপনি ওদের সাথে সম্মানের সাথে কথা বলবেন। এসে আমাকে জানাবেন। আপনার মেয়ে আজ জেলে যাবে না। বড় মেয়ে যদি জেলে যায়,সেটা লজ্জার।

(৬)

আমি মেয়েটাকে ডাকলাম। বললাম জেলে যাওয়া খুব খারাপ।
– স্যার, ও যে জেলে আছে!!

আহারে কিশোরী!!

–আজ তুমি তোমার বাবার সাথে বাসায় যাবে।
– আমি যাবো না।
–এমন যদি হয় যে তোমার বাবা এসে বলে উনার ভুল হয়েছে। তোমাকে ঘরে নিতে চায়!
– স্বামীকে ছাড়া আমি যাবো না।

যদি তোমার স্বামীকে মেনে নেয়?

আমি জানি না মেয়েটার চোখে ঐ মুহুর্তে আমি যে দ্যুতি দেখেছি তা কোন শিল্পী বা ক্যামেরা ধারন করতে পারবে কিনা?
ও প্রায় টেবিলের উপর এসে….. সত্যি!

বাচ্চা মেয়ে।

–আমি বললাম তাহলে কি তুমি যাবে?
-হ্যা যাবো।
আমি বললাম- কিন্তু শর্ত আছে। তোমার বয়স কম। তুমি স্বামীর সংসার করতে পারবে না। আগে তোমার ১৮ হবে। তুমি পাস করবে। ছেলেটা চাকুরি করবে। পড়া শেষ করবে। তোমার বাবা মা আবার অনুষ্ঠান করে তোমাকে তুলে দেবে। তারপর।

– বাবা যদি আবার জোর করে?
–তুমি আমাকে এসে বলবে। থানায় খবর দেবে। আমি না থাকলে কোর্টে এসে আমার মতো অন্য কোন স্যারকে বলবে।

বাচ্চাটা কনভিন্সড!!!

(৭)
মেয়েটাকে পাঠালাম। অপেক্ষা ওর বাবা আসার।
২ ঘন্টা পরে হাজির। একজন মহিলাসহ আরো অনেক লোক। আমার খাস কামরায় মাত্র ২ জন বসতে পারে। গাদাগাদি করে ৪/৫ জনকে বসালাম। আরো ৪/৫ জন দাঁড়িয়ে।

আমি শুনলাম। মহিলাটা ছেলের মা।
জিজ্ঞাসা করতেই বললেন- স্যার, আমার ছেলেকে উনাকে দিয়ে দিলাম।

বাহ! বাহ! পান চিবোচ্ছেন দেখছি!!

আমি মেয়ের বাবাকে দেখলাম। সন্তুষ্ট।
স্যার, আপনি যা বলেছেন সেই অনুযায়ী কথা বলেছি। আমি ছেলেকে মেনে নিলাম।
২ পক্ষ রাজী।

এবার, আমি বললাম- আমার কিছু শর্ত আছে।
মেয়েটাকে বলা কথাগুলো বললাম। পক্ষরা আরো সন্তুষ্ট। কথা তাদের মনে ধরেছে। মেয়ের বাবাকে বললাম- আবার যদি জোর করে মেয়ের বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে আপনি জেলে যাবেন। মেয়ের বাবা বুঝলেন। ছেলে পক্ষও বুঝলো।

(৮)

সবাইকে বের করে দিলাম। মেয়েটাকে আবার ডাকলাম।

বললাম, আজ তুমি বাসায় যাবে।
– আমার স্বামী?
–আমি ওকে বললাম, তুমি যদি আমাকে একটা সূত্র বলতে পারো, তাহলে ওকেও ছাড়া যায় কিনা আমি ভাববো। আমি তাকে কাগজের (a+b)2 এর সূত্রটা বলতে বলেছিলাম।

মেয়েটা সূত্র ভুল বলেছিলো। আমি সঠিকটা লিখে দেখালাম। সে মাঝখানে 2ab ভুল বলেছে।

জীবনের সূত্র সঠিক হলে অংকের সূত্র ভুল হলে কি এসে যায়!

আমি হেসে বললাম, তুমি সূত্র ভুল করেছো। এবার আমি যা বলবো তা মানবে।
ও মাথা নাড়ে।
মেয়েটার বাবা, ছেলেটার মাকে বলা কথাগুলো বললাম। ও মেনে নিলো। স্যার ও (স্বামী) কি আসবে?
আমি বললাম, কাল তোমার বাবা ওকে নিয়ে বাসায় যাবে।

মেয়েটা ( অবাক)।
যদি না আসে?
আমি কথা দিচ্ছি।
-স্যার কথা দিয়ে কথা রাখে না কিন্তু মোনাফেক।
–আমি মোনাফেক না। কাল ৫ঃ৩০ এর মধ্যে ও তোমার বাবার সাথে তোমাদের বাসায় যাবে।

– আমি বাবার সাথে যাবো স্যার।

(৯)

বাবা মেয়ের সামনা সামনি কথা হওয়া জরুরি। বাবাকে ডাকলাম। ১০ মিনিটের মধ্যে মেয়ে বাবার বুকে।
বাবা আমাকে মাফ করে দাও। আমি তোমার সাথে যাবো।
-(বাবা) আমি ভুল করেছি। মাফ কর।

মাঝে মাঝে চোখ জ্বালা করে। আমি আমার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত প্রায় ১১ঃ০০ টা ছুঁই ছুঁই করছে।

বাবা মেয়ে বের হয়ে যাচ্ছে।
-স্যার কথা রাখবেন তো।
– অবশ্যই।
পরদিন আসলেই ৫ঃ০০ টার মধ্যে ছেলেটাকে নিয়ে মেয়েটার বাবা বাসায় ফিরেছিলেন। আমি আমার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের সাথে কথা বলেছিলাম।

(১০)

ছেলেটা বাড়ি ফেরার পর কি হয়েছিলো জানতে চাইনি। অল্প বয়সের প্রেম মারাত্মক হয়।

মায়াবতী লেখক হুমায়ূন আহমদের গল্পের মতো, একজোড়া মায়াবতী চোখ হয়তো একটি শুকনো, লিকলিকে ছাপোষা ছেলের অপেক্ষায় ছিলো।

দয়াময় তুমি তাদের জীবন আনন্দময় করো। অংকের সূত্র ভুল করুক। কিন্তু, জীবনের সূত্র যেন ভুল না হয়।
অভিভাবকের মায়াময় হাত যেন সব সময় ওদের মাথার উপরে থাকে।

বিঃদ্রঃ এই কাহিনীর অনেকটুকু অংশ মনসুর, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার,বান্দরবান প্রত্যক্ষ করেছে। বিশেষ করে মোনাফেক ডাকার, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করার এবং সূত্র ভুল করার অংশগুলো। আর এটা কিভাবে যেন লিগ্যাল এইড ডায়েরির উপরেই লেখা হয়েছে। তাও আবার নীচের মনোগ্রামের উপরে!

লেখক- অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বান্দরবান।
(২৭.১১.২০১৯)