মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

জেনে নিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি

শেখ ইমরুল বারী: বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী এবং বৃহৎ প্রতিনিধিত্বমূলক গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বিশ্বব্যাপী সাধারন মানুষের মাঝে বিশেষ কৌতূহলের সৃষ্টি করে। মার্কিন মুলুকের নির্বাচনী সমীকরণ  ও বেশ জটিল । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রতি অধিবর্ষের অর্থাৎ লিপ ইয়ার (leap year) এর নভেম্বর মাসের প্রথম সোমবারের পরের মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয় (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের আর্টিকেল-২ এর দ্বাদশ সংশোধনী)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূলত ৫০টি স্টেট (state) এর একটি সম্মিলিত রাস্ট্র ব্যবস্থা। এই ৫০টি স্টেট এর সাথে পৃথক একটি ফেডারেল ডিসট্রিক্ট (Federal district) আছে। এই ফেডারেল ডিসট্রিক্ট বা ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া হল গোটা আমেরিকার রাজধানী যা ওয়াশিংটন ডিসির নামে পরিচিত । উল্লেখ্য যে এই ফেডারেল ডিসট্রিক্ট কোন স্টেট এর আওতায় নয় আবার নিজেও কোন স্টেট নয়। এই ফেডারেল ডিসট্রিক্ট মূলত একটা পলিটিক্যাল সিস্টেম (political system) যার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ইলেকটোরাল কলেজ নামের একটি নির্বাচনী পদ্ধতি। যুক্তরাষ্ট্রে ইলেকটোরাল কলেজ এর সংখ্যা ৫৩৮। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হতে হলে একজন প্রার্থীকে সর্বনিম্ন  ২৭০টি ইলেক্টোরাল ভোট নিশ্চিত করতে হবে। উল্লেখ্য যে যুক্তরাষ্ট্রের এক এক রাজ্যে বিভিন্ন সংখ্যক ইলেকটোরাল কলেজ রয়েছে। যেমন ক্যালিফোর্নিয়ার ইলেকটোরাল কলেজ এর সংখ্যা ৫৫ আবার মন্টানার ইলেকটোরাল কলেজ এর সংখ্যা ৩। এভাবে সব গুলো স্টেট মিলে মোট ইলেকটোরাল কলেজ ৫৩৮ টা।

এখন প্রশ্ন হল ইলেকটোরাল কলেজ কি? এক কথায় ইলেকটোরাল কলেজ হল কিছু ব্যক্তি। প্রত্যেক স্টেটে যে সংখ্যক ইলেকটোরাল কলেজ আছে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল ঠিক সেই সমপরিমান প্রতিনিধি নির্ধারণ করবে। একজন মার্কিন নাগরিক যখন তার পছন্দের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছে একই সাথে সে ঐ প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর বা তার দলের মনোনীত ব্যক্তিদেরকে ভোট দিচ্ছে। উদাহরণ সরূপ, ক্যালিফোর্নিয়ার একজন নাগরিক যখন জো বাইডেনকে ভোট দিচ্ছে সে মূলত ডেমোক্রেট পার্টির মনোনীত ৫৫ জন ইলেকটোরাল কলেজকে ভোট দিচ্ছে। যেহেতু ক্যালিফোর্নিয়ার ইলেকটোরাল কলেজ এর সংখ্যা ৫৫ জন। এবার ধরুণ ক্যালিফোর্নিয়ার মোট ভোটার ৯ জন এর মধ্যে ৫ ভোট জো বাইডেন পেয়েছে আর ৪ ভোট ট্রাম্প পেয়েছে। যেহেতু বেশি ভোট জো বাইডেন পেয়েছে সুতরাং জো বাইডেন বা তার পার্টির মনোনীত সকল ইলেকটোরাল কলেজ জয় লাভ করছে এবং হিলারি এই স্টেট এর নির্ধারিত সব ইলেকটোরাল কলেজগুলো সে পাবে অর্থাৎ তার ঝুলিতে ৫৫ টি ইলেকটোরাল কলেজ যোগ হবে। এই ভাবে গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫৩৮ ইলেকটোরাল কলেজ এর মধ্যে যে ২৭০ টি বা তার বেশি ভোট পাবে সে মার্কিন মুলুকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হবে।

এখন প্রশ্ন হল এই ইলেকটোরাল কলেজ কি ভাবে নির্ধারিত হয়? আমরা জানি আমেরিকার কেন্দ্রীয় আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট প্রতিনিধি পরিষদ (House of representative) ও সিনেট। জনসংখ্যার অনুপাতে পঞ্চাশটি স্টেট থেকে মোট ৪৩৫ জন সদস্য দুই বছর পরপর প্রতিনিধি পরিষদে (House of representative) নির্বাচিত হন । উল্লেখ্য যে দেশটির রাজধানী শহর ওয়াশিংটন ডিসিতে ছয় লাখের বেশি লোক থাকে, কিন্তু কেন্দ্রীয় আইনসভার কোনো কক্ষেই তাদের কোনো কার্যকর প্রতিনিধিত্ব নেই। কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে (House of representative)  ভোটাধিকার বিহীন তাদের  তিন জন পর্যবেক্ষক কেবল বসতে পারেন। সিনেটে তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই ।

এছাড়া প্রতি ছয় বছর পর পর পর্যায়ক্রমে রোটেশনের মাধ্যমে ছোট-বড় প্রতিটি অঙ্গরাজ্য থেকে সমানসংখ্যক অর্থাৎ দু’জন করে মোট ১০০ জন সদস্য সিনেটে নির্বাচিত হয়ে আসেন। এ দুইয়ের সমষ্টি অর্থাৎ (house of representative + Senate) ৪৩৫+১০০=৫৩৫, তার সাথে যোগ হয় ওয়াশিংটন ডিসির  প্রতিনিধি পরিষদে (House of representative) ভোটাধিকার বিহীন তাদের তিনজন পর্যবেক্ষক। এ নিয়ে সর্বমোট ৫৩৮ জনই হলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইলেকটোরাল কলেজ। যেমন ক্যলফোর্নিয়ার ইলেকটোরাল কলেজ এর সংখ্যা ৫৫ জন এর মধ্যে ৫৩ জন কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রতিনিধি পরিষদের (House of representative) এর সদস্য এবং ২ জন হল  সিনেট সদস্য।

উল্যেখ্য যে, জনসংখ্যার ওঠানামার সাথে স্টেট গুলোর ইলেকটোরাল কলেজ এর সংখ্যা পরিবর্তন হয়, কিন্তু মূল সংখ্যা ৫৩৮-এই স্থির থাকে। দ্বিতীয়ত, জাতীয় নির্বাচন হলেও কোনো একক জাতীয় নিয়মের ভিত্তিতে হয় না এ নির্বাচন। প্রতিটি অঙ্গরাজ্য তার নিজস্ব নিয়ম ও আইনের ভিত্তিতে ভোটগ্রহণ কার্যক্রম পরিচালনা করে।

ফলাফল ও শপথ গ্রহন

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নভেম্বরের প্রথম দিকে, কিন্তু শপথ নিয়ে হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে বসতে বসতে হয়ে যায় জানুয়ারির শেষ। এ অন্তর্বর্তী সময়ে বিদায়ী প্রেসিডেন্টকে বলা হয় লেইম ডাক (Lame Duck) প্রেসিডেন্ট। জানুয়ারির ৬ তারিখে কংগ্রেসের একটি যৌথ অধিবেশনে ইলেকটোরাল ভোট গণনা করা হয়। সিনেটর সভাপতির তদারকিতে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ২০ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন।

উপরোক্ত আলোচনায় মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি সহজ ভাষায় বর্ণনা করার এক ক্ষুদ্র প্রায়াস। আশা করি তা বিদগ্ধ পাঠকের কৌতূহল কিছুটা হলে ও মেটাবে নতুবা আরো কৌতূহলি করে তুলবে। যদি ও এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আরো কিছু টুইস্ট রয়েছে যা পরে এক সময় আলোচনা করব।

শেখ ইমরুল বারী: শিক্ষানবিশ আইনজীবী।