সাঈদ আহসান খালিদ
সাঈদ আহসান খালিদ; সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বার কাউন্সিলের পণ্ড পরীক্ষা: আর কত স্বপ্নভঙ্গ?

সাঈদ আহসান খালিদ: বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অ্যাডভোকেটশিপ তালিকাভুক্তির লিখিত পরীক্ষায় ‘প্রশ্ন কঠিন’ হওয়ার অজুহাতে সন্ত্রাসীদের হামলায় অজস্র পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্র ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, পরীক্ষা পণ্ড হয়েছে কয়েকটি কেন্দ্রে, শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের চোখের নোনাজলে প্লাবিত ছিন্ন উত্তরপত্রের পাতা। এটি একটি জঘন্য, নজিরবিহীন ও অবিশ্বাস্য ঘটনা।

এই পরীক্ষা নিয়ে এমনিতেই যথেষ্ট জল ঘোলা হয়েছে। পূর্বে ৬ মাস পরপর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও বিগত কয়েক বছর ধরে পরীক্ষার আয়োজক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ বার কাউন্সিল পরীক্ষা আয়োজনে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে- কোন পরীক্ষা গ্রহণ করেনি, আইনের ডিগ্রিধারী শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের অ্যাডভোকেট হওয়ার স্বপ্ন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে যার ফলশ্রুতিতে পরীক্ষা গ্রহণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে রাস্তায় এসে আন্দোলন করতে হয়েছে, উচ্চ আদালতে রিট হয়েছে। পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ চূড়ান্ত করেও স্থগিত করার উদাহরণও আছে। বহুল আরাধ্য, বহু শিক্ষানবিশের স্বপ্ন পূরণের সোপান এই পরীক্ষা এখন আবার ধূলিস্যাৎ করা হল। আইন অঙ্গনে এর চেয়ে অন্যায়, এর চেয়ে অবিচার, এর চেয়ে মানবতাবিরোধী, এরচেয়ে ঘৃণ্য আর কিছু হতে পারে না। তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

প্রথমত- এর দায়ভার বার কাউন্সিলের। পরীক্ষার আয়োজক কর্তৃপক্ষ হিসেবে পরীক্ষা কেন্দ্র ও পরীক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে এই প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হয়েছে। এটি ঘটিয়েছে গুটিকয়েক ধান্দাবাজ শিক্ষানবিশ আইনজীবী নামের সন্ত্রাসী। এই কয়েকটি নরকীটের জন্য সব সাধারণ শিক্ষানবিশ আইনজীবীর স্বপ্ন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না। শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের মধ্যে চার বছরের এলএল.বি. অনার্স ডিগ্রিধারী তারুণ্য যেমন আছে তেমনি আছে নৈশ আইন কলেজ থেকে দুই বছরের ডিগ্রিধারী বয়সে প্রবীণ কিন্তু কর্মে শিক্ষানবিশ আইনজীবীও। আন্দোলনের নামে দেশের সিনিয়র আইনজীবীদের প্রতি অশোভন ব্যবহার, অ্যাটর্নি জেনারেল মহোদয়ের সাথে অসদাচরণসহ এই পরীক্ষা ভণ্ডুলের অভিযোগও এই দ্বিতীয় ক্যাটাগরির শিক্ষানবিশদের বিরুদ্ধেই উত্থাপিত হচ্ছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছরের এলএল.বি. ডিগ্রি প্রোগ্রাম বন্ধ করা হলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নৈশ কলেজে এই ডিগ্রি বহাল আছে, যে কোন বয়সে এই ডিগ্রি নেওয়া যায়। এটি দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সাংঘর্ষিক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ বছর মেয়াদি এলএল.বি. ডিগ্রি নিষিদ্ধ ঘোষনা করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ল’ কলেজ গুলোতে একই ডিগ্রী জারি রাখার মাজেজা কী? ২ বছরের এলএল.বি. ডিগ্রি নিয়ে আইনজীবী হওয়া যদি আইন পেশার মানের অবনমনের কারন হয়ে থাকে তাহলে তো সেই ডিগ্রির সুযোগ সবখানেই বন্ধ হওয়ার কথা! আর যদি ইস্যুটা হয় সরকারি আইন কলেজ বনাম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক মানের প্রশ্ন- তাহলে সম্পূরক প্রশ্ন উঠে- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এইসব সান্ধ্যকালীন ল কলেজে প্রদত্ত ২ বছরের এলএল.বি. ডিগ্রি কোন মানদণ্ডে অন্যদের চেয়ে উত্তম?

একটা সময় পর্যন্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ল কলেজে ২ বছরের আইনের ডিগ্রি নিয়ে আইনজীবী হওয়ার উপযোগিতা ছিল যখন গুটিকয়েক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোথাও আইন শিক্ষার ব্যবস্থা ছিলনা। এখন বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগ খোলা হয়েছে, বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে চার বছর মেয়াদি আইনের অনার্স শিক্ষার্থীদের জায়গা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। দেশের জেলা বার এসোসিয়েশনগুলোতে প্রতি বছর আইনের ৪ বছরের অনার্স ডিগ্রিধারী প্রচুর নবীন আইনজীবী যুক্ত হচ্ছে- কোর্টগুলোতে অনার্স ডিগ্রিধারী আইনজীবীদের স্থান সংকুলানই এখন মুশকিল।

বার কাউন্সিল এর পরীক্ষা ভণ্ডুল ও উত্তরপত্র নষ্ট করার ঘটনা ১৯৮০ সালের পাবলিক এক্সামিনেশান অফেন্সেস অ্যাক্ট অনুযায়ী একটি ফৌজদারি অপরাধ। এই ঘৃণ্য ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা, ভবিষ্যত অ্যাডভোকেটশিপ পরীক্ষার জন্য তাদেরকে চির অযোগ্য ঘোষণা করা এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা পুনরায় গ্রহণের জোর দাবি জানাই।

বার কাউন্সিল কে নিয়মিতভাবে পরীক্ষা গ্রহণের আহবান জানাচ্ছি, না পারলে সেটি ঘোষণা করে দিন- সরকার বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সরকারি আইন কলেজগুলোতে চার বছরের এলএল.বি (অনার্স) ডিগ্রি চালু করা হোক নতুবা এই দুই বছরের এলএল.বি. ডিগ্রি নামের তামাশা বন্ধ করা হোক। বাংলাদেশে আইনজীবী, বিচারক কিংবা আইনের পেশাজীবী হওয়ার একমাত্র একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন চার বছরের এলএল.বি. (অনার্স) ডিগ্রি হওয়া উচিত।

আইনজীবী পেশায় প্রবেশের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ এখন সময়ের দাবি। ‘যার নাই কোন গতি সে করে উকালতি’- এই ধারণাকে পরিপুষ্ট করার প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন ভণ্ডুল করার সময় এসেছে।

সাঈদ আহসান খালিদ: সহকারী অধ্যাপক; আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।