সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের দায় কার
মনিরা নাজমী জাহান

কেন থামছে না ‘সেক্সটরশন’ ?

মনিরা নাজমী জাহান:

সেক্সটরশন ভয়াবহতা নিয়ে জানার আগে আমাদের সর্বপ্রথম যে বিষয়টি জানা প্রয়োজন তা হচ্ছে সেক্সটরশন বলতে আসলে কি বুঝায়? সেক্সটরশন বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা না থাকলে এর ভয়াবহতা নিরুপন করা সম্ভব না। আসুন আমরা আলোকপাত করার চেষ্টা করি ‘সেক্সটরশন’ বলতে আসলে কী বুঝায়? একটি সময় পর্যন্ত ‘সেক্সটরশন’ বলতে বুঝানো হতো কোনও সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে যৌন লিপ্সা চরিতার্থ করাকে। কোনও উচ্চপদস্থ বা প্রভাবশালী কেউ যদি তার নিম্নপদস্থ বা তার কাছে সাহায্যপ্রার্থী কাউকে বিশেষ কোনও সুবিধা বা সাহায্য করার বিনিময়ে তার যৌন লিপ্সা চরিতার্থ করতো তাকে ‘সেক্সটরশন’ বুঝানো হতো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ২০১৯ সালের জুলাই মাসে নরওয়ের সাবেক মন্ত্রী Svein Ludvigsen সেক্সটরশনের দায়ে ৫ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। একই অপরাধে কানাডায় দণ্ডিত হন কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন আদালতের বিচারক Stevan Ellis।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধের ব্যাপকতার বিষয়টি মাথায় রেখে এই ‘সেক্সটরশন’ নামক অপরাধের সংজ্ঞার ব্যাপকতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে সেক্সটরশন নামক ভয়াবহ মরণ ফাঁদটি সাইবার ক্রাইমের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এই ব্যবহার হবার অন্যতম কারণ হচ্ছে বর্তমানে ‘সেক্সটরশনে’র  হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহত হচ্ছে যৌনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছবি এবং ভিডিও। এমনকি এই অপরাধের উদ্দেশ্যেও এসেছে ব্যাপকতা। আগে যেখানে শুধু যৌন লিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য এই অপরাধ করা হতো, কিন্তু বর্তমানে যৌন লিপ্সা চরিতার্থ করা ছাড়াও যোগ হয়েছে ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে ভিকটিমের কাছ থেকে অর্থ আদায় এবং ছবি বা ভিডিও দেখিয়ে ভিকটিমের ওপর মানসিক চাপ প্রয়োগ করে  নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক মাধ্যমের সহজলভ্যতার কারণে এই ধরনের সাইবার ক্রাইম খুব সহজেই সংগঠিত হচ্ছে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে বর্তমানে এই অপরাধ এক দেশে বসে সংগঠিত করে আরেক দেশের জনগণকে ভিকটিম করা হচ্ছে।

তথ্য প্রযুক্তির এই উৎকর্ষ সাধনের যুগে মানুষের জীবনের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ছোঁয়া মানুষের জীবনকে সহজতর করেনি। তবে এই উৎকর্ষতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কিছু অসাধু ও দুষ্টু চক্র এই প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ব্যবহার করছে অসাধু উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য। দুষ্টচক্র দ্বারা কৃত এমনই এক মরণ ফাঁদের নাম ‘সেক্সটরশন’।এই ভয়াবহ মরন ফাদের কবলে পড়ে পৃথিবীর বহু মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। বাংলাদেশ ও তার ব্যাতিক্রম নয়। ইন্টেলিজেন্স কোম্পানি সেনসিটির এক প্রতিবেদনে জানা যায়, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এক লাখের বেশি নারীর ছবি সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে ভুয়া নগ্ন ছবি তৈরি করা হচ্ছে এবং অনলাইনে তা শেয়ার করা হচ্ছে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ব্যবহার করে এসব ছবি থেকে নারী দেহের পোশাক সরিয়ে ফেলা হচ্ছে এবং মেসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের মাধ্যমে নগ্ন ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব বিবস্ত্র নারীর অধিকাংশই অল্পবয়সী। কিন্তু যারা এসব করছে তাদের বেশিরভাগ একে শুধুমাত্র ‘বিনোদন’ হিসেবে বর্ণনা করে থাকে।বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী পরিষদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর গড়ে ১১ জন নারী সাইবার ক্রাইমের কারণে আত্মহত্যা করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য,  অনেক ক্ষেত্রে একজন নারী সাইবার সেক্সটরশনের শিকার হন তার খুব কাছের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারও দ্বারা।

তবে এখানে আরেকটি উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে যারা সাইবার সেক্সটরশনের ভিকটিম হয় তারা শুধু ব্ল্যাক মেইলিং বা পূর্ব শত্রুতার কারণে হয় না। একটা বড় অংশ স্ক্যামিং-এর শিকার হয়। এই স্ক্যামিংটা হয় মূলত ফিশিং লিংকের মাধ্যমে!  ভিকটিমের বয়স বেশিরভাগ ক্ষেত্রে থাকে ১৬-২৫ বছরের মধ্যে এবং তারা জানেই না কীভাবে আইডি হ্যাক হলো।

তবে এই কথাও সত্যি যে বাংলাদেশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ এবং  সিআইডি’র সাইবার পুলিশ সেন্টার সহ আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাহিনী  সেক্সটরশন সহ অন্যান্য সাইবার ক্রাইমের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করছে।সম্প্রতি সাইবার জগতে সংঘটিত নারীর প্রতি হয়রানিমূলক অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও আইনি সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (Police cyber support for women) নামে ফেসবুক পেজ, ইমেইল আইডি ও হটলাইন নম্বর চালু করেছে পুলিশ সদর দফতর। যেসব নারী সাইবার বুলিং, আইডি হ্যাক, স্পর্শকাতর তথ্য-ছবি-ভিডিও প্রকাশ, সাইবার স্পেসে যৌন হয়রানি ইত্যাদি অপরাধের শিকার হচ্ছেন, তারা এখানে অভিযোগ জানাতে পারবেন। সম্পূর্ণ নিরাপত্তার সঙ্গে ভিকটিমের তথ্য গোপন রেখে প্রয়োজনীয় সেবা ও আইনি সহায়তা দেবে পুলিশ সদর দফতর।তবে এই সাপোর্ট সেন্টারের উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এই সাপোর্ট সেন্টারে  যারা সেবা দেবেন, তদন্ত করবেন, তারা সবাই পুলিশের নারী সদস্য। যেখানে ভিকটিমরা নির্দ্বিধায় তাদের সমস্যাগুলো বলতে পারবেন।

স্বাভাবতই প্রশ্ন জাগে এত উদ্যোগের পর কেন থামান যাচ্ছে না সেক্সটরশন?এর পিছনে  রয়েছে বহুমাত্রিক কারন। এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে প্রথম একটি বিষয়ের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন কতৃক প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনের দিকে। যেখানে উল্লেখ করা হয় যে দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন হলেও সাইবার হয়রানির শিকার হয়েও দেশের আক্রান্তদের ৮০.৬ শতাংশ আইনের আশ্রয় নেন না।

সেই একই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আশ্রয় না নেয়ার কারন। অভিযোগ কেন করেন না- এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভুক্তভোগীদের ২৩ শতাংশই বিষয়টি ‘গোপন রাখতে’ চেপে যান বলে জানান। ২২ দশমিক ৭ শতাংশই জানেন না কিভাবে আইনি সহায়তা নেয়া যায়। আর ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ আইনি ব্যবস্থা নিয়ে উল্টো হয়রানির আশঙ্কায় ভোগেন। এছাড়াও অভিযোগ করেও লাভ হবে না বলে মনে করেন ১৬ শতাংশ। ওই এক ই প্রতিবেদনের জরিপে দেখা গেছে, ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ সামাজিক ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণের  ভয়ে এবং ৩ দশমিক ৯ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রভাবশালী হওয়ায়, ভয়ে আইনের আশ্রয় নেন না। অন্যদিকে সাইবার অপরাধের প্রতিকার বিষয়ক আইন সম্পর্কে জানেন না ৬৩ শতাংশ ভুক্তভোগী।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে প্রতিকার বিষয়ক আইন সম্পর্কে জানেন না ৬৩ শতাংশ ভুক্তভোগী। তার মানে বিশাল একটি অংশ প্রতিকার বিষয়ক আইন সম্পর্কে অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছেন যার ফলে তারা অপরাধের স্বীকার হলেও কি করা উচিৎ তা বুঝতে পারছে না। এই জন্য প্রয়োজন সচেতনতা মূলক কার্যক্রম জোরদার করা।এই সচেতনতামূলক কার্যক্রম ২ টি ভাবে বিভক্ত হতে হবে ।একটি ভাগে  সচেতনতা মূলক কার্যক্রমে থাকবে ইন্টারনেট ব্যবহার নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাখার জন্য কি করতে হবে সেই বিষয়টি নিয়ে । আরেকটি  ভাগে থাকতে হবে কেউ আক্রান্ত হলে বা ভিকটীম হলে তার করণীয় সম্পর্কে।সব চেয়ে গুরুত্বপুর্ন হচ্ছে এই পুরো সচেতনমূলক কার্যক্রমটি হতে হবে সাধারন মানুষের বোধগম্য ভাষায়।এই জন্য প্রয়োজনে বিশেষ কোন মাস বা সপ্তাহ কে সচেতনলতামূলক মাস বা সপ্তাহ ঘোষণা দেয়া যেতে পারে।

সেক্সটরশন নিয়ন্ত্রনে আরেকটি গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা পালন করে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রনে তৈরিকৃত আইন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা।সাইবার সেক্সটরশনের ক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে পেনাল কোড, ১৮৬০ প্রভৃতি আইন রয়েছে বটে কিন্তু যেহেতু অপরাধ টা প্রযুক্তি নির্ভর এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষতা সাধনের সাথে সাথে অপরাধের ধরনেও আসছে পরিবর্তন তাই এই ধরনের অপরাধ মোকাবেলার আইনেও আসতে হবে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন।প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাইবার অপরাধ মোকাবেলায় প্রণীত আইনের দিকে লক্ষ্য করলেই আমরা দেখবো আমাদের আইনটির আরও কত যুগোপযোগী এবং পরিবর্তন করা দরকার।সাইবার অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা এই মুহূর্তে একটি। যার কারনে সারা দেশের মামলা একটি ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ফলশ্রুতিতে বিচার পাবার ক্ষেত্রে  দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টির  আশংকা তৈরি হয়।অবশ্যই  বিভাগীয় পর্যায়ে দ্রুত সাইবার ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করে সেখানে যোগ্য প্রসিকিউটর নিয়োগ দিতে হবে।আরেকটি গুরুত্বপুর্ন বিষয় হচ্ছে সাইবার থানা স্থাপন।যে খানে ভুক্তভোগীরা সরাসরি মামলা করতে পারবে।সেই থানা তে সাইবার অপরাধের উপর প্রশিক্ষিত যথেষ্ট জনবল থাকতে হবে যাতে তারা যে কোন ধরনের সাইবার অপরাধের সমাধান দিতে পারেন।

ইন্টারনেটের নিজস্ব কোন পরিসীমা নেই।তাই চাইলেই এক দেশে বসে আরেক দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার করে অপরাধ করা সম্ভব।সাম্প্রতিক সময়ে আমরা এমনটি লক্ষ্য করেছি সেক্সটরশনের ক্ষেত্রেও। অপরাধী এক দেশে বসে আরেক দেশের নাগরিককে ভিকটীম বানাচ্ছে।তাইসেক্সটরশনের মত বাউন্ডারি লেস একটি ক্রাইম  মোকাবেলায় যেমন চাই জনসচেতনতা ঠিক তেমনি চাই মোকাবেলার জন্য চাই যুগোপযোগী আইন এবং প্রশিক্ষিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই অপরাধ নির্মূল সম্ভব নয়।

(লেখকঃ শিক্ষক , আইন বিভাগ , ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়)