এ বি এম খায়রুল হক

আদালত এবং বঙ্গবন্ধুর অপূর্ণ স্বপ্ন

এ বি এম খায়রুল হক:  সেই কবে ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৫ তারিখে পাকিস্তান গণপরিষদে হাইকোর্টের গঠন ও অবস্থান প্রসঙ্গে গণপরিষদের অন্যতম কনিষ্ঠ সদস্য শেখ মুজিব জনগণের ‘স্পিডিলি’ ও স্বল্প খরচে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সম্বন্ধে বক্তব্য দেন।

‘কারাগারের রোজনামচা’য় ৩০ জুন, ১৯৬৬ তারিখে তিনি লিখছেন- ‘…এই জেলে অনেক লোক আছে, যারা দুই-তিন বৎসর হাজতে পড়ে আছে সামান্য কোনো অপরাধের জন্য। যদি বিচার হয় তবে ৬ মাসের বেশি সেই ধারায় জেল হতে পারে না। বিচারের নামে কি অবিচার।…’

পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার ঘোষণায় বাঙালি মানসে এক প্রচণ্ড ধাক্কা খায়। ১৯৪৯-এর সংগ্রাম, ১৯৫২-এর আত্মত্যাগ ও বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় বহু রক্তের বিনিময়ে, বহু ত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের শৃঙ্খলামুক্ত হতে পেরেছি। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও প্রায় চার লাখ মা-বোনের সল্ফ্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালি জাতি এই প্রথমবারের মতো স্বাধীনতা লাভ করে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে তার স্বাধীন বাংলায় পদার্পণ করেন। ১৪ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিচার বিভাগের মূল গলদগুলো দূর করে এই বিভাগের ‘করাপশন’ ও ‘ডিলেস’মুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫ তারিখে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেন- ‘…যদি একটা মামলা সিভিল কোর্টে হয়, ২০ বছরেও সে মামলা শেষ হয় বলতে পারেন আমার কাছে…।’ তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ‘…সিস্টেমের মধ্যে পরিবর্তন করতে হবে। মানুষ যাতে সহজে বিচার পায় এবং সাথে সাথে বিচার পায়। ব্যাপক পরিবর্তন দরকার।’

এরপর ৪৫ বছর পার হয়ে গেছে, অবস্থার উন্নতি তো দূরের কথা, বরঞ্চ ৩৫ লাখ মামলা নিয়ে বিচার বিভাগের নাভিশ্বাস উঠছে। প্রতিদিন মামলার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলা শুরু হতেই লেগে যায় প্রায় ২২ বছর। আপিল বিভাগ পর্যন্ত বিচার শেষ হতে লেগে যায় আরও ১৩ বছর। হাইকোর্ট বিভাগে ডেথ রেফারেন্সের সংখ্যা এখন সম্ভবত ৮২০ (জানুয়ারি, ২০২১)। আর দেওয়ানি মোকদ্দমা যে কত দিনে শেষ হয়, সে সম্বন্ধে কিছু না বলাই ভালো।

এই হলো জাতির পিতার স্বপ্ন ও আশাবাদের পরিণতি। কেন এই মামলা-মোকদ্দমার জট, কী পদ্ধতিতে আমরা এই অসহনীয় অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি- তা আলাদাভাবে সবিস্তারে আলোচনা প্রয়োজন, সেই আলোচনা বারান্তরে হবে। এবার আদালতের ভাষা প্রসঙ্গ।

১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্নির্মাণে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। সব সমস্যার মধ্যেও বাংলাদেশের সংবিধান বাংলা ভাষায় প্রণয়ন করা হয় এবং স্বাধীনতার প্রথম বার্ষিকী ১৬ ডিসেম্বর থেকে তা বলবৎ করা হয়। সংবিধান বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে ঘোষণা করে। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ দ্বিধাহীনভাবে সংবিধানকে বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করে। ১৫৩ অনুচ্ছেদ সংবিধানের বাংলা পাঠের প্রাধান্য ঘোষণা করে। ১৪৮ অনুচ্ছেদ সাংবিধানিক পদের শপথ ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে। এই অনুচ্ছেদের বাধ্যবাধকতা অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণ ‘বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন’ মর্মে ঘোষণা করেন।

যেহেতু সংবিধান বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন, সেহেতু সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ তাদের ঘোষিত শপথ দ্বারা এই সর্বোচ্চ আইন রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করতে তারা বাধ্য বিধায় সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদও রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করতে তারা বাধ্য; সেহেতু রাষ্ট্রভাষায় রায় প্রদানসহ সুপ্রিম কোর্টের সব কার্যক্রম বাংলা ভাষায় হওয়ার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

এবার পাকিস্তান জন্মের প্রথম দিকে দৃষ্টি ফেরাই। প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষা প্রচলনের পক্ষে সংগ্রাম করে গেছেন। ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ তারিখে যুবলীগ প্রতিষ্ঠার সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করেন তরুণ শেখ মুজিব। ভাষা-সংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ‘…বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক।’ সেই থেকে বাংলা ভাষা প্রচলনের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং সেই পথ ধরে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো।

১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭২ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে দুটি বিষয়ের ওপর বিশেষ জোর দেন- প্রথমত, আইনের শাসন বাস্তবায়ন; দ্বিতীয়ত, নিজের ভাষায় রায় দেওয়ার তাগিদ, অর্থাৎ ধারণা করি, মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষায় রায় দেওয়ার কথা তিনি এভাবেই বলেন-

‘…আমাদের মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছেন, যে ইংরেজি ভাষায় অনেক কিছু আমাদের চলছে। …আপনারা চেষ্টা করুন যেভাবে আপনাদের ভাষা আসে তার মধ্য থেকেই জাজমেন্ট লেখার চেষ্টা করুন। এভাবেই যা শেষ পর্যন্ত ভাষায় পরিণত হয়ে যাবে। অল্প কথায় লেখুন, যতটুকু পারা যায়, লেখা যায়, আমরাও চেষ্টা করতেছি, আমাদেরও অসুবিধা হয়ে যায়, …কিন্তু আমরা চেষ্টা করতেছি… তাই আমরাও আশা করব যে, আপনাদের হাইকোর্টে, সুপ্রিম কোর্টের যেখানে আপনারা লিখতে আরম্ভ করেছেন।’

এটা কোনো আদেশ-নির্দেশ ছিল না, ছিল তার অনুরোধ, আশাবাদ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সুপ্রিম কোর্টের তদানীন্তন বিচারপতিগণ জাতির পিতার আবেগের কোনো মূল্যই দেননি। ১৯৮৯-৯০ সাল পর্যন্ত কোনো বিচারপতি শপথ গ্রহণ ব্যতিরেকে তাদের রায়ে একটি শব্দও বাংলায় লেখেননি। ইতোমধ্যে প্রশাসনে সীমিত আকারে হলেও বাংলা ভাষার ব্যবহারের সূচনা হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে সারাবিশ্বে প্রশংসিত হন; জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বের সব বাঙালি কৃতজ্ঞচিত্তে হিমালয় দর্শন করল।

একটা প্রতিবন্ধকতা হয়তো ছিল, সেটা ‘হাইকোর্ট রুলস, ১৯৬০’। কিন্তু তাও সংবিধানের আলোকে কোনো বাধাই নয়। তা ছাড়া প্রধান বিচারপতি সংবিধানের ১০৭ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত বিধি প্রণয়ন ক্ষমতা ব্যবহার করে ১৯৭৩ সালে ‘দ্য সুপ্রিম কোর্ট (হাইকোর্ট ডিভিশন) রুলস, ১৯৭৩’ প্রণয়ন করেছিলেন। সেই বিধিমালায় রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি, হয়তো মাতৃভাষা বাংলার প্রতি তাদের অঙ্গীকারের ঘাটতি ছিল।

আমরা বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধন করব এবং একই সঙ্গে শুধু ইংরেজি নয়, আরও অনেক ভাষায় বুৎপত্তি লাভের চেষ্টা করব। আমরা অন্যান্য ভাষা, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষায় লিখিত সাহিত্য, লিগ্যাল হিস্ট্রি, কনস্টিটিউশনার ডেভেলপমেন্ট, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উচ্চ আদালতের, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষায় লিখিত রায়, সম্ভব হলে ইউরোপিয়ান কোর্টের রায় পড়ে, রেশিও ডিসিডেন্ডি অনুধাবন করে, আমাদের মাতৃভাষায় সকলের জন্য বোধগম্য করে আমরা রায় লিখব। আমরা ধারণা, ভাষা নিয়ে এটাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল।

লেখক: আইন কমিশনের চেয়ারম্যান; সাবেক প্রধান বিচারপতি