ভুক্তভোগীকে দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বললেন সুপ্রিম কোর্ট
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ছবি: জয়দীপ্তা দেব চৌধুরী

জালিয়াতি করে হাইকোর্ট থেকে হত্যা মামলার আসামির জামিন

মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী : কক্সবাজারের একটি হত্যা মামলার এজাহারের ২ নম্বর ক্রমিকের আসামীকে জাল জালিয়াত করে ২২ নম্বর ক্রমিকের আসামী দেখিয়ে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেওয়া হয়েছে। ঘটনাটি প্রকাশ পাওয়ার পর এ নিয়ে কক্সবাজারের আদালত পাড়ায় বেশ তোলপাড় চলছে।

এ বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল সুপ্রীম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে পত্র দিয়েছেন।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম ফরিদ ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

জানা গেছে, কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালী ইউনিয়নের চেরাংঘর বাজারে চলতি বছরের ৭ এপ্রিল বিকেল ৫ টার দিকে মোরশেদ আলি প্রকাশ মোরশেদ বলিকে জনসম্মুখে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহত মোরশেদ আলি প্রকাশ মোরশেদ বলী কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মাইজপাড়ার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মরহুম ওমর আলীর পুত্র।

এ ঘটনায় ২৬ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরো ১০/১২ জনকে আসামী করে গত ৯ এপ্রিল কক্সবাজার সদর মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের ভাই জাহেদ আলী। যার কক্সবাজার সদর থানা মামলা নম্বর : ১৭/২০২২ এবং জিআর মামলা নম্বর : ২২৭/২০২২ ইংরেজি (সদর)।

কক্সবাজারের চাঞ্চল্যকর মোরশেদ আলি প্রকাশ মোরশেদ বলি হত্যা মামলার এজাহারের ২ নম্বর ক্রমিকের আসামী কক্সবাজারের একই এলাকার মনির আহমদ প্রকাশ মনু ফকিরের পুত্র মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদ (৪৫) সহ মামলার ৫ জন আসামী গত ১৬ এপ্রিল র‍্যাব-১৫ কর্তৃক গ্রেপ্তার হন।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের (পাবলিক প্রসিকিউটর) পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জানান, গত ১২ মে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ৩২৫১/২০২২ নম্বর ফৌজদারী মিস মামলামূলে মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদসহ ৫ জন আসামী জামিন চেয়েছিলেন। পরে কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল ফৌজদারী মিস মামলাটি শুনানি করে আসামীদের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন।

পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম আরো জানান, এজাহারের ২ নম্বর ক্রমিকের আসামী মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদ হাইকোর্টের বিচারপতি ভিষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের বেঞ্চে ৩৩২৯৪/২০২২ নম্বর ফৌজদারী মিস মামলা মূলে জামিন আবেদন করেন। হাইকোর্টের বেঞ্চ গত ৩০ জুন জামিন আবেদনটি শুনানি শেষে মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদকে অন্তবর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন এবং এ বিষয়ে রুল জারী করেন।

হাইকোর্ট থেকে আসামী মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদকে জামিন প্রদানের আদেশটি কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আসে। কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশেক এলাহী শাহজাহান নুরী জানান, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী গত ৬ জুলাই হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জামিনের আদেশটি যথারীতি কনফার্মেশনের মাধ্যমে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত জামিননামা সম্পাদন করে আসামির জন্য মুক্তিনামা ইস্যু করা হয়। আসামী মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদ কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে ঐদিনই মুক্তি পেয়ে যান।

কিন্তু আসামী মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদ এর বিরুদ্ধে মোরশেদ বলী হত্যাকান্ডে অর্থযোগান সহ সরাসরি সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট ও গুরুতর অভিযোগ থাকার পরও হাইকোর্ট থেকে কিভাবে স্বল্প সময়ের ব্যাবধানে আসামি জামিন পেলেন-তা নিয়ে মামলার বাদী পক্ষের লোকজনের সন্দেহের উদ্রেক হয়।

এ বিষয়ে মোরশেদ বলী হত্যা মামলার বাদী মাস্টার ওমর আলীর পুত্র জাহেদ আলী জানান, তিনি আসামী মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদ হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভের বিষয়ে ৩৩২৯৪/২০২২ নম্বর ফৌজদারী মিস মামলার রেকর্ড দেখতে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বিভাগের শরণাপন্ন হন। তিনি সেখান থেকে মিস মামলায় দাখিলীয় সকল কাগজপত্র সংগ্রহ করেন।

হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বিভাগের মিচ মামলার উত্তোলিত কাগজপত্রে দেখা যায়, হাইকোর্টে দাখিল করা জামিন আবেদনে এবং কক্সবাজারের নিম্ন আদালত থেকে নেওয়া সকল সহিমুহুরী অনুলিপিতে আসামী মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদ’কে সহিমুহুরী অনুলিপি জালিয়াতি করে মামলার এজাহারের ২ নম্বর ক্রমিকের আসামীর স্থলে ২২ নম্বর ক্রমিকের আসামী দেখানো হয়েছে।

অপরদিকে, সহিমুহুরী অনুলিপিতে এবং হাইকোর্টের জামিন আবেদনে এজাহারের ২২ নম্বর ক্রমিকের আসামী মোঃ ইয়াছিনকে ২ নম্বর ক্রমিকের আসামী দেখানো হয়েছে। গত ৩১ মে কক্সবাজার সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এর আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করার আদেশটিও সহিমুহুরী অনুলিপিতে যথাযথভাবে উল্লেখ নাই।

মামলার ২২ নম্বর আসামীর বিরুদ্ধে এজাহারে আনীত অভিযোগ খুব একটা সুনির্দিষ্ট ও গুরুতর নয়। তাই ২২ নম্বর ক্রমিকের আসামী হিসাবে মহামান্য হাইকোর্ট মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদকে জামিন দেন বলে ধারণা করেন, মামলার বাদী জাহেদ আলী।

আবার এজাহারের ২২ নম্বর ক্রমিকের আসামী মোহাম্মদ ইয়াছিন জালিয়াতি করে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেওয়া মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদ এর পুত্র। গত ৮ জুন কক্সবাজারের শিশু আদালত-১ এর বিজ্ঞ বিচারক মোসলেহ উদ্দিন ৯২/২০২২ নম্বর শিশু মিস মামলা মূলে মোঃ ইয়াছিনকে ১৪ বছর বয়স দাবি করাতে তাকে শিশু বিবেচনায় জামিন দিয়েছেন।

পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম আরো জানান, গত বুধবার (১৩ জুলাই) কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এর আদালতে এ বিষয়ে মামলার বাদী জাহেদ আলী একটি আবেদন দাখিল করেন। আবেদনটি রাষ্ট্র পক্ষে পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল এর নজরে আনলে বিচারক তাৎক্ষণিক উক্ত মামলাটির মূল নথি নিম্ন আদালত থেকে তলব করেন। ঘটনাটি প্রকাশ পাওয়ার পর এ নিয়ে কক্সবাজারের আদালত পাড়ায় বেশ আলোচনা চলছে।

এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এস.এম আব্বাস উদ্দিন বলেন, কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালী ইউনিয়নের মোরশেদ আলী প্রকাশ মোরশেদ বলী হত্যা মামলার এজাহারের ২ নম্বর ক্রমিকের আসামীকে জাল জালিয়াতি করে ২২ নম্বর ক্রমিকের আসামী দেখিয়ে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেওয়ার বিষয়ে সুপ্রীম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে পত্র দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল বৃহস্পতিবার ১৪ জুলাই ২৯৩ নম্বর স্মারকে এ বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে এ পত্র প্রেরণ করেন। পত্রে রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চকে অবহিত করে বেঞ্চ হতে এ ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।

তিনি আরো জানান, বিষয়টা মাননীয় হাইকোর্ট কর্তৃক জামিনের আদেশ। তাই হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের নির্দেশনা ছাড়া বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিতে পারছেন না।

প্রেরিত পত্রে বলা হয়েছে, কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ৩২৫১/২০২২ নম্বর ফৌজদারী মিস মামলাটি নামঞ্জুর করা হয়েছে ৩১ মে। জালিয়াতি করে সৃজিত তথাকথিত সহিমুহুরী অনুলিপির জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অনুলিপি শাখায় আবেদন করা হয়েছে ১ জুলাই এবং সেখান থেকে নকল সরবরাহ দেখানো হয়েছে ৫ জুলাই। অথচ হাইকোর্টে মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদ জামিন লাভ করেছেন ৩০ জুন। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো-কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অনুলিপি শাখা থেকে অনুলিপি সরবরাহ পাওয়ার ৬ দিন আগে আসামী মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদ হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন।

প্রশাসনিক কর্মকর্তা এস.এম আব্বাস উদ্দিন আরো জানান, হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি ভিষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের বেঞ্চে ৩৩২৯৪/২০২২ নম্বর ফৌজদারী মিচ মামলায় জামিন আবেদনের সাথে দাখিল করা অনুলিপির সাথে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অনুলিপি বিভাগ থেকে সরবরাহকৃত অনুলিপির কোন সামঞ্জস্য নেই। হাইকোর্টে দাখিলকৃত অনুলিপি সম্পূর্ণ জাল ও সৃজিত।

একইভাবে কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশেক এলাহী শাহজাহান নুরী বলেছেন, এই মামলায় কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নকলখানা থেকে সরবরাহ করা অনুলিপির সাথে উচ্চ আদালতে দাখিল করা অনুলিপির কোন মিল নেই। হাইকোর্টে দাখিলকৃত অনুলিপি সম্পূর্ণ ভুয়া ও বানোয়াট। হাইকোর্টে দাখিলকৃত অনুলিপির সাথে কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নকলখানার কোন সম্পর্ক নেই বলে জানান-মোহাম্মদ আশেক এলাহী শাহজাহান নুরী।

হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি ভিষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের বেঞ্চে ৩৩২৯৪/২০২২ নম্বর ফৌজদারী মিস মামলায় জামিন আবেদনে আসামী মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদ এর আইনজীবী ছিলেন-অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ নুরুল হুদা আনসারী এবং রাষ্ট্র পক্ষে ছিলেন-সহকারী এটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট জাহিদ আহমদ হিরু এবং অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আসামী মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদ সহ ৫ জনের পক্ষে গত ১২ মে দায়েরকৃত ৩২৫১/২০২২ নম্বর ফৌজদারী মিচ মামলায় ফাইলিং আইনজীবী ছিলেন, কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাজ্জাদুল করিম।