ডিসেম্বরেই হতে পারে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দায়েরকৃত দুই মামলার বিচারকাজ প্রায় শেষের দিকে। বর্তমানে মামলা দুটিতে রায়ের আগের ধাপে যুক্তিতর্ক চলছে যা শেষ হলে রায় ঘোষণা করবেন ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।

আদালত সূত্র জানায়, গত ২৩ অক্টোবর থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করে রাষ্ট্রপক্ষ। আগামী সপ্তাহেই এটি শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর পর আসামিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শুরু হবে, যা শেষ হওয়ার পরই রায় ঘোষণা করা হবে।

মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান। তিনি বলেন, নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়, কবে নাগাদ রায় হবে। তবে আমরা এ বছরই রায় পাওয়ার প্রত্যাশা করছি।

রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলির প্রত্যাশা সত্যি হলে আসছে ডিসেম্বরেই হতে পারে বহুল আলোচিত এ মামলার রায়।

মামলা দুটিতে মোট আসামি ৫২ জন। তাদের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের এবং ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলার ঘটনায় হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানের ও শরিফ শাহেদুল ইসলাম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। তাই মামলা থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ৪৯ আসামির বিচার চলছে।

মামলা দুটিতে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৩৮ আসামির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১২০-বি, ৩২৪, ৩২৬, ৩০৭, ৩০২, ১০৯ ও ৩৪ এবং বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের ৩, ৪ ও ৬ ধারায় চার্জ গঠন হয়।

দণ্ডবিধি আইনের ৩০২ ধারায় মানুষ হত্যার অভিযোগে এবং ১২০-বি ধারায় হত্যার অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়। উভয় ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং সর্বনিম্ন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

অন্যদিকে বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের ৩ ধারায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রাণহানি এবং ৬ ধারায় অর্থ, পরামর্শ ও বিস্ফোরক দিয়ে সহায়তার অভিযোগে একই দণ্ডের বিধান রয়েছে। ৩০২ ও ১২০-বি ধারা এবং বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের ৩ ও ৬ ধারা অনুযায়ী তারেক রহমানসহ ৩৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ও সর্বনিম্ন যাবজ্জীবন কারাদ- হতে পারে।

৩৮ আসামির মধ্যে তারেক রহমান ছাড়াও রয়েছেন- সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপিদলীয় সাবেক এমপি কাজী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদ, বিএনপি দলীয় ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম আরিফ, হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. হানিফ, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তৎকালীন মহাপরিচালক আবদুর রহিম ও রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, হরকাতুল জিহাদ নেতা আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মাদ ওরফে জিএম, শেখ আবদুস সালাম, কাশ্মীরের নাগরিক আবদুল মাজেদ ভাট, আবদুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মাওলানা ইয়াহিয়া, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে পীর সাহেব, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, বাবু ওরফে রাতুল বাবু, মুফতি হান্নানের ভাই মুহিবুল্লাহ মফিজুর রহমান ওরফে অভি, মাওলানা আবু সাইদ ওরফে ডাক্তার জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, শাহাদত উল্যাহ ওরফে জুয়েল, হোসাইন আহমেদ তামিম, মইনুদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, আরিফ হাসান সুমন, মো রফিকুল ইসলাম সবুজ, মো. উজ্জল ওরফে রতন, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাও. তাজউদ্দিন, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুনছালিন, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার ও লিটন ওরফে মাও. লিটন।

অন্যদিকে সাবেক আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরীসহ ৬ সরকারি কর্মকর্তার সর্বোচ্চ ৭ বছর এবং সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদাসহ ৫ জনের সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ডের ধারার অভিযোগে বিচার চলছে। অন্যরা হলেন- সাবেক আইজিপি শহুদুল হক, সাবেক ডিসি পূর্ব মো. ওবায়দুর রহমান, সাবেক ডিসি দক্ষিণ খান সাইদ হাসান, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লে. কমান্ডার (অব) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লে. কর্নেল (অব) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার, মেজর (অব) এটিএম আমিন, তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়া ৩ তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ও এএসপি আবদুর রশীদ।

১১ সরকারি কর্মকর্তার মধ্যে আসামি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক, সাইফুল ইসলাম ডিউক ও এটিএম আমিনের বিরুদ্ধে দ-বিধির ২১২ ও ২১৭ ধারায় চার্জ গঠন হয়। দ-বিধির ২১২ ধারায় মুত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে অভিযুক্ত আসামিদের প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে সর্বোচ্চ ৫ বছর এবং সর্বনিম্ন ৩ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

অন্যদিকে দণ্ডবিধির ২১৭ ধারায় কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি থেকে বাঁচাতে সরকারি কর্মকর্তা হয়েও আইনের বিধান পালন না করার অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তি ২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। উভয় ধারাতেই সর্বোচ্চ শাস্তির কথা বলা থাকলেও সর্বনিম্ন শাস্তির কথা বলা নেই; আদালতে ইচ্ছাধীন ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে।

আসামি ওবায়দুর রহমান ও খান সাইদ হাসানের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হয় দ-বিধির ২০১, ২১২ ও ২১৭ ধারায়। দ-বিধির ২০১ ধারায় অপরাধীকে বাঁচানোর জন্য সাক্ষ্য-প্রমাণ অদৃশ্য করে মিথ্যা তথ্য সরবরাহের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৭ বছর এবং যাবজ্জীবন অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে এ ধারায় সর্বনিম্ন শাস্তির কথা বলা নেই, যা আদালতের ওপর নির্ভর করে। এই দুই আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হওয়া অপর দুই ধারার শাস্তির বিষয়ে উপরোল্লিখিত আলোচনায় বলা আছে।
আসামি খোদা বক্স চৌধুরী, রুহুল আমিন, মুন্সি আতিক, আবদুর রশীদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হয় দণ্ডবিধির ২১৮ ও ৩৩০ ধারায়। দণ্ডবিধির ২১৮ ধারায় কোনো অপরাধীকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে ভুল রেকর্ড বা দলিল প্রস্তুত করার অভিযোগে সর্বোচ্চ ৩ বছর এবং ৩৩০ ধারায় ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো নিরপরাধীর স্বীকারোক্তি আদায় করতে বাধ্য করতে মারধর করা হলে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

এদিকে ট্রাইব্যুনাল সূত্র বলছে, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলটির অভিযুক্ত ৭ নেতা এবং সাবেক দুই গোয়েন্দা প্রধানের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১২০-বি, ৩২৪, ৩২৬, ৩০৭, ৩০২, ১০৯ ও ৩৪ এবং বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের ৩, ৪ ও ৬ ধারায় চার্জ গঠন হলেও তাদের বিরুদ্ধে মূলত দণ্ডবিধির ১২০-বি এবং বিস্ফোরক আইনের ৬ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অপরাধীদের সহায়তার অভিযোগও রয়েছে।

দণ্ডবিধির ১২০-বি ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা ২ বছর বা ততোধিক মেয়াদের দণ্ডে দণ্ডনীয় কোনো অপরাধের ষড়যন্ত্র যদি করেন তবে তিনি একই অপরাধে অভিযুক্ত হবেন, যেন তিনি অনুরূপ অপরাধে সহায়তা করেছেন। অন্যদিকে বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি স্থান, অর্থ, পরামর্শ অথবা বিস্ফোরকদ্রব্যাদি সরবরাহ করে সহায়তা করে তবে সেই ব্যক্তি একই অপরাধে অভিযুক্ত হবেন।

প্রসঙ্গত ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলটির জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালায় জঙ্গিরা। হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। আহত হন শতাধিক নেতাকর্মী। এ ঘটনায় মতিঝিল থানার উপপরিদর্শক ফারুক হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী বাদী হয়ে পৃথক ৩টি এজাহার দায়ের করেন।

মামলায় সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, মুফতি আবদুল হান্নানসহ ২২ আসামির বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর প্রথম চার্জ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। পরবর্তী সময়ে অধিকতর তদন্তের জন্য তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। যাদের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ১৮ মার্চ চার্জ গঠন করা হয়। গত ৩০ মে, মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। গত ১২ জুন মামলাটিতে জামিনে ও কারাগারে থাকা ৩১ আসামির আত্মপক্ষ শুনানি শুরু হয়। যা গত ১১ জুলাই শেষ হয়। আত্মপক্ষ শুনানিতে জামিনে ও কারাগারে থাকা ৩১ আসামির সবাই নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। এর পর শুরু হয় সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ। কারাগারে থাকা ২৩ আসামির মধ্যে ২০ জন আসামি সাফাই সাক্ষ্য প্রদান করেন। গত ১১ অক্টোবর মামলা দুটিতে আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়। গত ২৩ অক্টোবর থেকে যুক্তিতর্ক শুরু হয়। -আমাদের সময়

 

সম্পাদনা- ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম