হয়রানি ও জেল খাটার পর জানা গেল পরোয়ানা ভুয়া!

কোনও মামলার আসামি না হয়েও জেল আর হয়রানির শিকার হতে পারেন যে কেউ। এর কারণ ভুয়া গ্রেফতারি পরোয়ানা। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে নিরীহ প্রতিপক্ষকে হয়রানি করতে এই বেআইনি পন্থা বেছে নেন অনেকে। টাকার বিনিময়ে একশ্রেণির দালাল চক্র ও আদালতের অসাধু কর্তারা তাদের সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

গ্রেফতারি পরোয়ানা আসল নাকি নকল আদালতে তা যাচাই-বাছাই করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ কারণে কেউ নির্দোষ হলেও কারাগার থেকে বের হতে লেগে যায় অন্তত এক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময়।

সম্প্রতি এমন হয়রানির শিকার হয়েছেন মাদারীপুরের কালকিনি থানার পশ্চিম সাহেব রাজাপুর গ্রামের ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষক মুহাম্মাদ আক্কাস খান স্বপন (৩৫)। তার বিরুদ্ধে দেশের কোনও থানা বা আদালতে মামলা নেই। তবুও ভুয়া পরোয়ানার কারণে ১৪ দিন কারাগারে থাকতে হয়েছে তাকে। তার বাবার নাম আব্দুর রাজ্জাক খান

পুলিশ জানিয়েছে, ডাকে আসা পরোয়ানা নকল না আসল তা যাচাইয়ের কোনও পন্থা নেই। মামলার নথি না দেখে পুলিশ কখনও ভুয়া পরোয়ানার বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারে না। আর সেই মামলার নথি যদি এক জেলা থেকে আরেক জেলায় থাকে, তা খুঁজে তলব করে দেখতে অনেক সময় লাগে আদালতের। ততদিন গ্রেফতার ব্যক্তিকে থাকতে হয় কারাগারেই। পরোয়ানা নকল হলেও এ বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এক্ষেত্রে পুলিশ ছেড়ে দিতে পারে না। তারা কেবল আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়ন করে থাকেন।

এ ধরনের ভুয়া গ্রেফতারি পরোয়ানার কারণে প্রায়ই মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে স্বীকার করেছে পুলিশ। আইনজীবীদের দাবি— দেশের আদালতগুলোতে একশ্রেণির অসাধু দালাল চক্র এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। তারা বলছেন, ‘কখনও কখনও আইন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরাই এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এটা প্রতিরোধ করা দরকার।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৮ আগস্ট ভোরে কালকিনির হামেদ খান বাজার থেকে আক্কাসকে গ্রেফতার করেন ওই থানার সহকারী উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এএসআই) আবুল বাশার। গ্রেফতারের সময় এএসআই জানান, গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার একটি মাদক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি তিনি। তার বিরুদ্ধে আদালতের সাজা পরোয়ানা রয়েছে। পরোয়ানায় জয়দেবপুর থানার মামলা নম্বর ৩ (১০) ২০০৯ ও দায়রা নম্বর ১৯/১০।

একজন মাদ্রাসা শিক্ষক মাদক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত জেনে এলাকাবাসীর সঙ্গে তার পরিবারও হতবাক। তারা ভাবতেই পারেননি আক্কাসের নামে এমন মামলা থাকতে পারে। গাজীপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালত তাকে সাজা দিয়েছেন। এছাড়া পুলিশ জানায়, তিনি নাকি দীর্ঘদিন ধরে পলাতক।

গ্রেফতারের পরে কালকিনি থানা পুলিশ মাদারীপুর আদালতে সোপর্দ করে আক্কাসকে। এরপর তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন মাদারীপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। পরবর্তী সময়ে ওই মামলার কাগজ নিয়ে গাজীপুরে আসেন আক্কাসের স্বজনরা। প্রথমে তারা জয়দেবপুর থানায় গিয়ে জানতে পারেন মামলাটি চেক জালিয়াতির। জয়দেবপুর থানার মামলা নম্বর ৩ (১০) ২০০৯। গাজীপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে দায়রা মামলা নম্বর ১৯/১০।

এই মামলার বাদী মো. মাহবুব। তার বাবার নাম তমিজ উদ্দিন। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বারতোপা গ্রামে তাদের বাড়ি। মামলার আসামি দু’জন। তারা হলেন— ঢাকা সবুজবাগের উত্তর মুগদাপাড়া এলাকার মরমুজুল হক রুবেল। তার বাবার নাম সৈয়দ সিরাজুল হক। অন্য আসামি (বিবাদী) হলেন ঢাকার উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা বরেন্দ্র টেক্সটাইল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রেজাউল করিম। তার বাবার নাম মো. আলাউদ্দিন।

মামলাটি মূলত জমি কেনাবেচা নিয়ে। বাদীর সঙ্গে জালিয়াতি করেছেন বিবাদীরা। সাড়ে ১১ লাখ টাকার চেক জালিয়াতির এই মামলার রায় হয়েছে আগেই। মামলায় একটি ভুয়া পরোয়ানা তৈরি করে পূর্ব শত্রুতার জেরে আক্কাসের নাম-ঠিকানা লিখে মাদারীপুর কালকিনি থানায় পাঠানো হয়। সেই অনুযায়ী তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

আক্কাসের ভাগ্নে মো. সাইফুল ইসলাম ও অন্য স্বজনরা গাজীপুরে এসে পরোয়ানার ফটোকপি নিয়ে আইনজীবী আক্তার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলাটির বিষয় খোঁজ নিয়ে বিস্তারিত জানতে পারেন। সাইফুল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা মামলা নম্বর নিয়ে গাজীপুর জয়দেবপুর থানায় খবর নিই। ২০০৯ সালের মামলা হওয়ায় থানা থেকে তেমন কিছু জানাতে পারেনি। এরপর গাজীপুরে আইনজীবী আক্তার হোসেনের সঙ্গে কথা বলি। তিনি খোঁজ নিয়ে মামলার নথি বের করেন আদালত থেকে।’

আইনজীবী আক্তার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আক্কাসের পরিবার মামলা নম্বর নিয়ে এলে আমার জুনিয়রকে খোঁজ নিতে বলি। তিনি মামলার নথি দেখেন। মামলাটির রায় হয়ে গেছে। চেক ডিজঅনারের মামলায় মুহাম্মাদ আক্কাস খান স্বপন নামে কোনও আসামি নেই। তখন বিষয়টি আমরা আদালতে আবেদন করে উত্থাপন করি। এরপর আদালত তাকে অব্যাহতি দেয়।’

এটি ভুয়া পরোয়ানা ছিল বলে জানান এই আইনজীবী। তার কথায়, ‘এ ধরনের ঘটনা আগে কখনও পাইনি। এই প্রথম। আমি তো হতবাক। এর সঙ্গে আদালতের দালালরা জড়িত। তারা টাকার বিনিময়ে এগুলো করে। আইনজীবীরাও জড়িত থাকতে পারেন।’

ভুক্তভোগী আক্কাস খান স্বপন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাইরে আমার কোনও শত্রু নেই। শত্রু আমার ঘরেই থাকতে পারে। তবে কারও নাম বলতে পারবো না। আমি ছোট চাকরি করে খেয়েপড়ে বেঁচে আছি। বিপদে পড়লে আমার পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রতিপক্ষের অনেক ক্ষমতা। তাই চুপচাপ থাকি। কোনও অপরাধ না করেও প্রায় ১৩ দিন জেল খেটেছি।’

কালকিনি থানার এএসআই আবুল বাশার গণমাধ্যমকে জানান— অন্য জেলা থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা সবসময় পুলিশ সুপারের কার্যালয় আসে। তিনি তা প্রথমে গ্রহণ করেন। এরপর সেটি ঠিকানা অনুযায়ী বিতরণ হয় থানাগুলোতে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তা থানার রেজিস্টারে তালিকাভুক্ত করে আসামিকে গ্রেফতারের জন্য এসআই বা এএসআইকে নির্দেশ দেন। এরপর তারা আসামিদের গ্রেফতার করে থাকেন।

এএসআই আবুল বাশার বলেন, ‘মাদ্রাসার শিক্ষক মুহাম্মাদ আক্কাস খান স্বপনের বিষয়েও এই নিয়ম মানা হয়েছে। গ্রেফতারি পরোয়ানাগুলো সব একই রকম। কোনটা আসল কোনটা নকল তা কিন্তু যাচাই-বাছাই করার সুযোগ হয় না থানা পুলিশের। আমি তাকে গ্রেফতার করে মাদারীপুর জেলা আদালতে পাঠাই। মামলা নম্বর নিয়ে তার স্বজনরা গাজীপুরে খোঁজ নেন। পরে শুনেছি পরোয়ানাটি ভুয়া ছিল। তাকে আসামি করে একটি চেক ডিজঅনারের মামলা ছিল সেটি।’

পরোয়ানাগুলো যাচাই-বাছাই করার প্রক্রিয়া আছে কিনা জানতে চাওয়া হয় পুলিশ সদর দফতরের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি-অ্যাডমিন) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের কাছে। তিনি বলেন, ‘একই জেলার ভেতরে আদালত পরোয়ানা জারি করলে সংশ্লিষ্ট পুলিশের মাধ্যমে তা সরাসরি চলে যায় থানায়। তবে এক জেলা থেকে অন্য জেলার পরোয়ানাগুলো ডাকযোগে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এরপর তিনি পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। প্রতিটি পরোয়ানা আসল না নকল তা কিন্তু যাচাই-বাছাই করা মুশকিলের কাজ। এটা প্রায় অসম্ভব।’

পুলিশ সদর দফতরের উপ-মহাপরিদর্শকের ভাষ্য, ‘ভুয়া পরোয়ানায় কেউ গ্রেফতার হলেও তাকে আদালতের মাধ্যমে ছাড় পেতে হয়। এর সঙ্গে একটি চক্র জড়িত। তবে কারও সন্দেহ হলে ও জানালে তা যাচাই-বাছাই করতে পুলিশ সহযোগিতা করবে।’

আইনজীবী হাসনাত কাইয়ূম অবশ্য পুলিশ সদর দফতরের উপ-মহাপরিদর্শকের কথা মানতে রাজি নন। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই পুলিশের যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ রয়েছে। যারা এগুলো তৈরি করেন তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসাও পুলিশের কর্তব্য ও দায়িত্ব। একজন নির্দোষ মানুষ কেন বিনা অপরাধে কারাভোগ করবে? এটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক।’
সূত্র- বাংলা ট্রিবিউন

সম্পাদনা- ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম