শাস্তি হলেও থামছে না পুলিশের অপরাধ

ট্রাফিক পরিদর্শক শেখ আজম মোটরসাইকেলে যাওয়ার সময় ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মধুখালী রেলগেট এলাকায় দুর্ঘটনায় পড়েন। ছিটকে পড়ে তার মোটরসাইকেলের টুলবক্স ভেঙে বেরিয়ে আসে ৩৯ বোতল ফেনসিডিল! গত মঙ্গলবার এ ঘটনার পর স্থানীয় জনতা পুলিশের ওই কর্মকর্তাকে পুলিশের হাতে দিয়েছেন। পরে মোটরসাইকেলটি তল্লাশি করে ট্যাঙ্কের ভেতর বিশেষ কৌশলে রাখা আরও ৪৩ বোতল ফেনসিডিল পাওয়া যায়।

এর আগে গত শনিবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ডিবি পুলিশ সাইদুর রহমান নামে এক কনস্টেবলকে ৩ হাজার ২০০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে। ওই কনস্টেবল পুলিশের ওয়ারী জোনের সহকারী কমিশনারের (এসি-প্যাট্রোল) গাড়ির চালক।

ওই দুটি ঘটনা পুলিশ সদস্যদের অপরাধের খণ্ডচিত্র হলেও প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠছে। অথচ পুলিশের ঊর্ধ্বতন বিভিন্ন পর্যায় থেকে সদস্যদের অপরাধ ঠেকাতে কড়া হুঁশিয়ারি দেওয়া রয়েছে। অপরাধী পুলিশ সদস্যকে শাস্তির আওতায়ও নেওয়া হচ্ছে। তারপরও থামছে না অপকর্ম। পুরনো অভিযোগ ঘুষ, দুর্নীতির বাইরে গিয়ে মাদক ব্যবসার মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন পুলিশের কনস্টেবল থেকে মাঠ পর্যায়ের অসাধু কর্মকর্তারা। এতে জঙ্গি দমন থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতিসহ পুলিশের নানা সফলতা ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের গত পৌনে ৬ বছরের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, নানা অপরাধে জড়িয়ে বছরে অন্তত ১৩ হাজার সদস্যকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। মাসে গড়ে সাড়ে ১১শ’ সদস্যকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। দৈনিক অন্তত ৩৮ জন পুলিশ সদস্য আইন অমান্য করা থেকে শুরু করে নানা অপরাধে জড়িয়ে শাস্তি পাচ্ছেন। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১২ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৫১১ জন পুলিশ সদস্য চাকরিচ্যুত এবং ৪২ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এরপরও তাদের অপরাধপ্রবণতা কমানো যাচ্ছে না। জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ডিআইজি (মিডিয়া) আবদুল আলিম মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, বাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া মাত্রই তা তদন্ত করে শাস্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে। অপরাধের ধরন অনুযায়ী কোনো কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হচ্ছে। ফৌজদারি মামলাও দেওয়া হচ্ছে।

পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, কোনো সদস্যের ব্যক্তিগত অপরাধের দায় বাহিনী নেবে না। অপরাধ করলে পার পাওয়ার সুযোগ নেই- সেটা শাস্তির পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়।

তবে পুলিশ সদর দপ্তরের শৃঙ্খলা বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা আক্ষেপ করে বলেন, দীর্ঘ তদন্তের পর তারা অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। গুরুতর অপরাধের প্রমাণ পেলে অভিযুক্তরা চাকরিচ্যুত হন। অথচ সেই অভিযুক্তদের অন্তত ৯০ ভাগই আদালতের মাধ্যমে চাকরি ফিরে পান। অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি চাকরি ফিরে পেলে অন্য সদস্যদের অপরাধভীতি কমে আসবে এটাই স্বাভাবিক।

আইন ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশ অপরাধের অলিগলি চেনে। এজন্য সহজে সেটা করতে পারে। সেটা থামাতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কঠোর হতে হবে। শুধু প্রশাসনিক শাস্তি দিয়ে এটা রোধ করা যাবে না, পুলিশের নিয়োগ-বদলিতে বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সচ্ছতা থাকতে হবে। কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা গেলেই পুলিশের অপরাধ কমবে।

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক গণমাধ্যমকে বলেন, একজন সাধারণ মানুষ অপরাধ করলে যে ধরনের শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় পুলিশের কেউ অপরাধ করলেও সেই শাস্তির মুখোমুখি করা উচিত। শুধু প্রশাসনিক শাস্তি দিয়ে অপরাধ থামানো যাবে না।

তিনি বলেন, আইন রক্ষার দায়িত্বে থেকে কেন পুলিশ আইন ভেঙে অপরাধে জড়াচ্ছে সেটা খুঁজতে হবে। পুলিশের নিচের পদগুলোতে নিয়োগ-বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। কারণ বাহিনীতে ঢুকতেই যদি কাউকে অপরাধের শিকার হতে হয় পেশাগত জীবনে সে অপরাধ করবে। বেতনের বাইরেও তার চাহিদা থাকবে। সেই চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে অপরাধে জড়াবে।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক গণমাধ্যমকে বলেন, অপরাধ দমন এবং অপরাধ কার্যক্রম একই সঙ্গে হতে পারে না। পুলিশের অপরাধপ্রবণতা ঠেকাতে নিয়োগ-বদলি প্রক্রিয়ায় আরও সচ্ছতা আনতে হবে। একজন সদস্যকে যদি কোথাও অবৈধ টাকা দিয়ে নিজের নিয়োগ বা বদলি নিশ্চিত করতে হয় তাহলে ওই সদস্য সেই টাকা তুলে নিতে অপরাধে জড়াবেই।

পুলিশ অ্যাক্ট-১৮৬১ অনুযায়ী, কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির বিধান রয়েছে। এর একটি লঘুদ, অন্যটি গুরুদ। গুরুদে র আওতায় চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদাবনতি, পদোন্নতি স্থগিতকরণ ও বেতন বৃদ্ধি স্থগিতকরণ করা হয়। বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়। মামলায় অপরাধ প্রমাণ হলে বরখাস্ত বা চাকরিচ্যুত করা হয়। তবে গুরুদে র বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি ছোট ছোট অনিয়ম বা অপরাধের জন্য দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার, অপারেশনাল ইউনিট থেকে পুলিশ লাইন্স বা রেঞ্জে সংযুক্ত করে লঘুদণ্ড দেওয়া হয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কনস্টেবল থেকে শুরু করে উপপরিদর্শক (এসআই) পর্যন্ত সদস্যরা বেশি অপরাধে জড়াচ্ছেন। তারপর রয়েছেন পরিদর্শক মর্যাদার কর্মকর্তারা। এএসপি থেকে শুরু করে আরও উপরের কর্মকর্তাও অপরাধে জড়িয়ে শাস্তি পাওয়ার নজির রয়েছে। ২০১২ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত পৌনে ৬ বছরে লঘুদণ্ড পেয়েছেন ৭৩ হাজার ৩৩৩ জন সদস্য। তাদের মধ্যে কনস্টেবল থেকে এসআই পর্যন্ত রয়েছেন ৭৩ হাজার ২৯ জন, পুলিশ পরিদর্শক ৭০ জন এবং এএসপি থেকে তার ঊর্ধ্বে কর্মকর্তা রয়েছেন ২৩ জন। একই সময়ে গুরুদণ্ড পেয়েছেন তিন হাজার ৯৯১ জন। শাস্তি পাওয়াদের মধ্যে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ১০ হাজার ৮২১ জনকে শাস্তি দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে শাস্তি পাওয়া পুলিশের সংখ্যা ১৩ হাজার ৫৮৬ জন, ২০১৫ সালে ১১ হাজার ১৬৭ জন, ২০১৪ সালে ১৫ হাজার ২৯৭ জন। ২০১৩ সালে অপরাধ করে শাস্তি পেয়েছেন পুলিশের ১৪ হাজার ৬০ সদস্য এবং ২০১২ সালে এ সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ৮৭৯ জন।

পুলিশের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা গণমাধ্যমকে বলেন, পুরোপুরি অপরাধ থামানো সম্ভব নয়। তবে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এজন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। অভিযুক্ত সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

একের পর এক অভিযোগ

এক সপ্তাহের মধ্যে দুইবার মাদক ব্যবসা করতে গিয়ে দুই পুলিশ সদস্য গ্রেফতার হওয়া ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ সদস্যদের কয়েকটি অপরাধ আলোচনার জন্ম দেয়। সম্প্রতি রাজধানীর ফকিরাপুলে একটি ভবনে অভিযানের নামে একটি রিক্রুন্টিং এজেন্সির মালিকের কাছে সিআইডির এক কর্মকর্তা কোটি টাকা ঘুষ দাবি করে বরখাস্ত হন। গত ১৮ এপ্রিল কাফরুলের কচুক্ষেতের নিউ ওয়েভ ক্লাবে চাঁদাবাজির অভিযোগে ডিবি পুলিশের ১১ পুলিশ সদস্যকে আটক করে মিলিটারি পুলিশ। গত ২৩ অক্টোবর খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার আবদুল্লাহ আরেফের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।

গত ২৫ অক্টোবর টেকনাফের এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ ও মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার পর ১৭ লাখ টাকাসহ গোয়েন্দা পুলিশের সাত সদস্য আটক হন। ১৭ অক্টোবর রাজধানীর খামারবাড়ি এলাকায় জসীম উদ্দিন নামে এক পুলিশ সদস্য ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েন। ওই সময় পালিয়ে যাওয়া অপর দু’জনও ছিলেন পুলিশ সদস্য। ২৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের মইজ্জারটেক এলাকা থেকে এক হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক হন এএসআই আনোয়ার হোসেন। ১৯ ডিসেম্বর বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলায় এক ব্যবসায়ীর টাকা ছিনতাইয়ের সময় গণপিটুনির শিকার হন কনস্টেবল শাহনেওয়াজ।
সূত্র : সমকাল