আইনপেশার মানোন্নয়নে আইনজীবী সমিতির বক্তব্য চেয়েছে বার কাউন্সিল
বার কাউন্সিল ও আইনজীবী

আইনজীবী তালিকাভুক্তি: জনবল সঙ্কটে ফল প্রকাশে বিলম্ব

আইনজীবীদের সনদ প্রদানকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে এনরোলমেন্টের (তালিকাভুক্ত) জন্য অনুষ্ঠিত লিখিত পরীক্ষা ছয় মাসের অধিক সময় পার হয়েছে। এখনও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল প্রকাশ না হওয়ায় হতাশায় নিমজ্জিত প্রায় ১২ হাজার শিক্ষানবিশ আইন শিক্ষার্থী। তবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জনবল সঙ্কটের কারণে ফল প্রকাশে বিলম্ব হচ্ছে।

২০১৭ সালের ১৪ অক্টোবর লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আইনজীবী তালিকাভুক্ত হতে এমসিকিউ উত্তীর্ণদের দ্বিতীয় ধাপের লিখিত পরীক্ষায় ১১ হাজার ৮৪৬ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। এর আগে ২১ জুলাই নৈর্ব্যক্তিক (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সেই পরীক্ষায় অংশ নেন প্রায় ৩৪ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী। সেখান থেকে ১১ হাজার ৮৪৬ পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হন।

সর্বশেষ ২০১৫ সালে এনরোলমেন্ট পরীক্ষার মাধ্যমে আইনজীবীরা তালিকাভুক্ত হন। এরপর ২০১৭ সালের ২১ জুলাই প্রথমে প্রিলিমিনারি এবং ওই বছরের ১৪ অক্টোবর লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

ফল প্রকাশ দেরি হওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সংশ্লিষ্টরা জানান, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি ছিল। অতিরিক্ত খাতা মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষকের ঘাটতিসহ বার কাউন্সিলের জনবল ঘাটতি রয়েছে। এসব কারণে পরীক্ষার রেজাল্ট দিতে দেরি হচ্ছে।

তারা আরও জানান, পুরোদমে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের খাতার মূল্যায়ন চলছে। সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টসহ বিভিন্ন জেলার শতাধিক বিচারক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করছেন। ইতোমধ্যে অর্ধেকের বেশি খাতার মূল্যায়ন শেষ হয়েছে। মূল্যায়ন শেষে সম্ভব হলে চলতি মাসে ফলাফল প্রকাশ হবে।

প্রসঙ্গত, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বার কাউন্সিলের এনরোলমেন্ট (সনদ) পরীক্ষা দুই বছরের জন্য স্থগিত থাকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, এবারের এনরোলমেন্ট কমিটির সভাপতি ছিলেন আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তিনি বর্তমানে প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে আছেন। প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পাওয়ার পরও এনরোলমেন্ট কমিটি পুনর্গঠন হয়নি। এ কারণে উত্তরপত্রের মূল্যায়ন দেরি হচ্ছে।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুল বাসেত মজুমদার এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরও এনরোলমেন্ট কমিটি পুনর্গঠন করা হয়নি, এটা ঠিক নয়। এনরোলমেন্ট কমিটি পরিচালনার জন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়েছে বিচারপতি নূরুজ্জামানকে।

‘জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট কম’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘পরীক্ষার্থীদের খাতাগুলো মূল্যায়নে পর্যাপ্ত জনবল আমাদের নেই। এ কারণে সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট এবং বিভিন্ন জেলার জজদের কাছে পরীক্ষার খাতা পাঠানো হয়েছে। প্রায় শতাধিক বিচারপতি ও বিচারক মিলে খাতা মূল্যায়ন করছেন। দেখা যাক, এ মাসের শেষের দিকে ফলাফল প্রকাশ করা যায় কি-না!’

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের লিগ্যাল এইড অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সদস্য আইনজীবী অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম (জেড আই) খান পান্না গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রায় ১২ হাজার পরীক্ষার্থীর খাতা দুবার মূল্যায়ন কি চাট্টিখানি কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি পারবে অক্টোবর থেকে এপ্রিলের মধ্যে ১২ হাজার শিক্ষার্থীর রেজাল্ট দিতে? আমার তো মনে হয় পারবে না। জনবল সঙ্কট এবং পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট না থাকা সত্ত্বেও আমরা দ্রুত ফলাফল দেয়ার চেষ্টা করছি।

‘ছয় মাসের পরও ফলাফল প্রকাশ না হওয়া একটু বেশি সময়ক্ষেপণ’ উল্লেখ করে সিনিয়র আইনজীবী ও সাবেক বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দুই বছর পর পরীক্ষা হলো। ফলাফল দিতে ছয় মাসেরও অধিক সময় পার হলো। একটু বেশিই সময় নেয়া হচ্ছে। শুনেছি, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টসহ বিভিন্ন জেলার শতাধিক জেলা জজের কাছে পরীক্ষার খাতা পাঠানো হয়েছে। তারা সবাই তো মামলা পরিচালনায় ব্যস্ত, খাতার মূল্যায়নেও তো দেরি হবেই।’

পরীক্ষার ফল প্রকাশের বিষয়ে প্রসিকিউটর সায়েদুল হক সুমন বলেন, পরপর দুই বছর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় এবার পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি ছিল। এছাড়া বার কাউন্সিলে লোকবল কম। যারা খাতা দেখেন সেই বিচারকের সংখ্যাও কম। তাই একটু দেরি হচ্ছে।

বার কাউন্সিলের সনদ পাওয়ার আশায় এবার লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন কামরুজ্জামান। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তিন বছর পর আইনজীবীর তালিকাভুক্তির জন্য পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো। অনেক আশা করে পরীক্ষা দিলাম, কিন্তু পরীক্ষা দেয়ার ছয় মাস পার হলো, কিন্তু ফল আর প্রকাশ হলো না।’

‘নিজেদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘দিন যত যাচ্ছে শিক্ষানবিশ আইনজীবীর সংখ্যা তত বাড়ছে। প্রতি বছর অল্পসংখ্যক শিক্ষানবিশ আইনজীবী ল’ (আইন) পাশ করে বের হন। ফলে আইনে পড়া শিক্ষার্থীদের জীবন বেকারত্বের অভিশাপের মধ্যে পড়ে আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।’

‘এ পেশায় প্রতিষ্ঠিত হব বলে এক সিনিয়রের সঙ্গে গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছি। আইন পেশায় প্রতিষ্ঠিত হলে অনেক সময় দরকার। চাইলেই প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় না। তার ওপর যদি পরীক্ষার ফল দিতে দেরি হয় তাহলে অকৃতকার্য হলে পরবর্তী পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেও সময় লাগবে’- এভাবে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিক্ষানবিশ আইনজীবী তৌহিদুল হক।

শামসুন্নাহার নামে আরেক শিক্ষানবিশ আইনজীবী বলেন, ‘আইন পড়া শেষ করেছি ২০১৩ সালে। এখন ২০১৮ যাচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৫ সালে আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর দুই বছর পরীক্ষা হয়নি। পরীক্ষা না হওয়ায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে কয়েকগুণ দাঁড়িয়েছে।’

‘প্রিলিমিনারি শেষে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার ছয় মাস পার হয়েছে। কিন্তু ফল প্রকাশ হয়নি। এ কারণে নিজেদের মধ্যেই হতাশা কাজ করছে। এতদিন বসে আছি, নানাজনে নানান কথা বলে। পাস-ফেল যাই হোক, পরবর্তীতে তো একটা সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে’- যোগ করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, বার কাউন্সিলের আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষা তিন ধাপে হয়। প্রথম ধাপে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। প্রিলিমিনারিতে যারা পাস করেন তারা লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। লিখিত পরীক্ষায় যারা পাস করবেন তারা মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন। এরপর আইনজীবী তালিকাভুক্তির চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হবে। জাগোনিউজ