বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া (ফাইল ছবি)
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া (ফাইল ছবি)

খালেদা জিয়ার জামিন প্রশ্নে শুনানিতে যা হলো

 

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জামিন প্রশ্নে আপিলের শুনানি আগামীকাল বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করেছেন আদালত।

আজ মঙ্গলবার (৮ মে) দুপুর সোয়া ১টার দিকে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

এর আগে সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে আপিল শুনানিতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশিদ আলম খান। এ সময় তিনি খালেদা জিয়ার সাজা বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আপিল শুনানিতে বক্তব্য দেন।

এরপর শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে অংশ নেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আসামিপক্ষে অংশ নেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী।

যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘হাইকোর্ট কম সাজার বিষয়টি উল্লেখ করে জামিন দিয়েছেন, কিন্তু দণ্ড দেওয়ার পর জামিনের জন্য কম সাজার বিষয়টি বিবেচনায় আসবে না। তিনি মাত্র তিন মাস হলো বন্দি রয়েছেন। বন্দির সময়টা যদি দুই বা আড়াই বছর হয়, তবে জামিনের বিষয়টি বিবেচনায় থাকতে পারে।’

বয়স ও অসুস্থতা নিয়ে খুরশিদ আলম বলেন, ‘সাজাপ্রাপ্ত হলে জামিনের জন্য বয়সটা বিবেচনায় আসবে না। আর অসুস্থতার বিষয়টি জেলকোড অনুযায়ী কারা কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’

খালেদা জিয়ার সাজা বাড়াতে দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘মামলার প্রধান আসামি খালেদা জিয়া। কিন্তু একই মামলায় তাঁকে কম সাজা আর বাকিদের বেশি সাজার বৈষম্য করা হয়েছে। হয় সবাইকে পাঁচ বছর অথবা সবাইকে ১০ বছর সাজা দেওয়া উচিত।’

আসামিরা বিশ্বাস ভঙ্গ করে টাকা আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে টাকা উত্তোলন করেন। এ মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়ার মতো যুক্তি রয়েছে। প্রধান আসামিকে (খালেদা জিয়া) নারী ও অসুস্থ, বয়স বিবেচনায় দেওয়া হলো পাঁচ বছর, অথচ অন্য আসামিদের দেওয়া হয় ১০ বছর। এটা হতে পারে না। অথচ নিম্ন আদালতে কোনো মেডিকেল সার্টিফিকেট দেখানো হয়নি।’

খুরশিদ আলম বলেন, ‘বরং প্রধান আসামি হিসেবে খালেদা জিয়ার সাজা আরো বেশি হওয়ার কথা। নারী ও অসুস্থতা বিবেচনায় উনার শাস্তি কমানোর সুযোগ নেই।’ তিনি বলেন, ‘হাইকোর্ট বলেছে, চার মাসের জামিন দিলাম, এর মধ্যে আপিল তৈরি করতে হবে। আমার প্রশ্ন হলো, আপিল এর মধ্যে প্রায় তৈরি হয়ে যাচ্ছে। তাই জামিন দেওয়ার সুযোগ নেই। বরং আপিল শুনানি করে একসঙ্গে রায় ঘোষণা করা হোক।’

খালেদা জিয়ার সাজা বৃদ্ধি করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘পৃথক দুটি মামলায় দুই ব্যক্তির সাজা হয়। পরে হাইকোর্ট একজনকে জামিন দিয়েছে। আপনারা খারিজ করেন। আবার অপরজনকে হাইকোর্ট জামিন দেয়নি, কিন্তু আপনারা জামিন দিয়েছেন। এখন আমরা কোনটা ভাবব।’ এভাবে কয়েকটি মামলার রেফারেন্স তুলে ধরে খালেদা জিয়াকে জামিন না দেওয়ার যুক্তি তুলে ধরেন। পরে বেলা ১১টার দিকে তিনি শুনানি শেষ করেন।

এরপর শুনানি শুরু করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। দুপুর পৌনে ১২টার সময় রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি শুরু করেন তিনি। শুনানির শুরুতে তিনি এ মামলার বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজার নথিগুলো আদালতে উপস্থাপন করেন। এরপর তিনি বলেন, বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিলের পেপারবুক এরই মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। আমরা চাইলে এ মামলার আপিলের শুনানি শুরু করতে পারি। মূল আসামি যেহেতু খালাস পাননি; এ মুহূর্তে তাঁকে জামিন দেওয়া যায় না। তাই আপিল নিষ্পত্তি করা হোক। এ সময় তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট লি মিয়ং বাককে ২৪ বছরের কারাদণ্ড এবং ব্রাজিলের লুলা ডি সিলভার ১২ বছর সাজা হয়। তাঁকেও জামিন দেওয়া হয়নি।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘মাই লর্ড, মেডিকেল রিপোর্টে বলা হয়; খালেদা জিয়ার পায়ের হাঁটুতে ব্যথা। তিনি হাঁটতে পারেন না। উনার ঘাড়ে ব্যথা। এত কষ্ট করে হাঁটার দরকার কী? উনি তো কারাগারে রেস্টেই আছেন!’

এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলে উঠেন; ‘উনার এসব কথা বলার দরকার কী? উনি রাষ্ট্রের একজন প্রধান আইন কর্মকর্তা। উনি কি এসব বলতে পারেন?’

তখন আদালতে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। পেছন থেকে আইনজীবীরা শেইম, শেইম বলা শুরু করেন। এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘উনাকে বলতে দিন।’ এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল আবার বলা শুরু করেন। এ সময় তিনি এ মামলার সাজার বিভিন্ন নথি পড়া শুরু করেন। একপর্যায়ে বলেন, ‘কারাগারের ডাক্তার উনাকে চেকআপ করলেন। পরে নাপা ওষুধ সেবনের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু উনার ব্যক্তিগত ডাক্তাররা দেখা করলেন, আবার বাইরে এসে সংবাদ সম্মেলন করেন। এটা কীভাবে সম্ভব। তারা তো ডাক্তার, ট্রিটমেন্ট করবে। সংবাদ সম্মেলন করতে পারেন না। উনারা পরামর্শ দিলেন ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তির জন্য। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ উনাকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নিয়ে পরীক্ষা করিয়েছেন। তাই কারাগারে উনার সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কেননা, উনার সাথে একজন সেবিকাও দেওয়া হয়েছে।’

এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘এটি দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সে এগুলো বলতে পারে না। এমন একটি মামলায় তিনি দাঁড়াতে পারেন না।’ তখন আইনজীবীরা চিৎকার করা শুরু করে বলতে থাকেন ‘ইয়েস, ইয়েস।’

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, তাঁকে সাবমিট রাখতে দিন।

এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল আবার মামলার নথি পড়া শুরু করেন। এ সময় খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘এখন তো জামিনের শুনানি চলছে, আপিলের না।’

এ সময় আইনজীবীরা হৈচৈ শুরু করলে বিচারকক্ষের পরিবেশ কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘হোক না। শেষ হয়ে গেছে। শেষ করতে দিন। আমরা এভাবে শুনতে পারব না।’ একপর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এ মামলায় আপিলের নথি রেডি। আমরা চাইলে আগামীকাল থেকে শুনানি শুরু করতে পারি।’

এরপর খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী শুনানি শুরু করেন। তিনি এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। তাদের আইনজীবী রয়েছে। আপনি এখানে শুনানি করতে পারেন না। আপনি কি রাষ্ট্রের নাকি দুদকের আইনজীবী?’

এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল ও এ জে মোহাম্মদ আলীর মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। এ পর্যায়ে আদালত উভয়পক্ষকে শান্ত করেন। এরপর এ জে মোহাম্মদ আলী শুনানি শুরু করেন। তিনি দুদকের মামলায় ১০ বছর দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পরও আপিল বিভাগ জামিন দিয়েছেন এ ধরনের দুটি মামলার নজির আদালতে উপস্থাপন করেন। একপর্যায়ে আদালত শুনানি দুপুর সোয়া ১টার সময় মামলার কার্যক্রম আগামীকাল পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেন।

আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী, খন্দকার মাহবুব হোসেন, জয়নুল আবেদীন, মাহবুবউদ্দিন খোকন, বদরুদ্দোজা বাদল, কায়সার কামাল।

এ সময় আইনজীবী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সাংবাদিক, বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের উপস্থিতিতে আদালত কক্ষ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

গত ১৯ মার্চ প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বিভাগ খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেওয়া চার মাসের জামিন ৮ মে পর্যন্ত স্থগিত করেন। একই সঙ্গে জামিনের বিরুদ্ধে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করে।

গত ১২ মার্চ খালেদা জিয়াকে চার মাসের জামিন দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের দেওয়া চার মাসের জামিন স্থগিত চেয়ে পরের দিন রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদক আপিল করে। পরে ১৪ মার্চ আপিল বিভাগ জামিনের স্থগিতাদেশ দেন। পরদিন ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান জামিনের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল দায়ের করেন।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ পাঁচ আসামিকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড এবং আসামিদের দুই কোটি ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। রায় ঘোষণার পর পুরান ঢাকার পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারকে বিশেষ কারাগার ঘোষণা দিয়ে খালেদা জিয়াকে সেখানে রাখা হয়।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলা করে দুদক।

২০১০ সালের ৫ আগস্ট খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন দুদকের উপপরিচালক হারুন-আর রশিদ। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায়।

মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন—মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান। এনটিভি