আবদুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বান্দরবান

ডিসি/জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারকাজের এসিআর প্রদানের ক্ষমতা দায়রা জজদের দেওয়া উচিৎ

আবদুল্লাহ আল মামুন:

ধরুন, কাল থেকে বাংলাদেশের চিকিৎসকগণ দাবী তুললেন আমরা অনেক ডাক্তারী করলাম। অনেক অব্যবস্থাপনা দেখলাম। এই সবের সমাধান হতে পারে আমাদেরকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া। আমাদেরকে ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেয়া হোক। আমাদের চিকিৎসক, নার্স, প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক আক্রান্ত হলে আমরা বিচার করবো। আমরা আমাদের সমস্যার তড়িৎ সমাধান করবো। আমাদের ক্ষমতা চাই। আমরা ম্যাজিস্ট্রেট হতে চাই। দিয়ে দিন ম্যাজিস্ট্রেসির ক্ষমতা।

ধরুন, পুলিশ প্রশাসন দাবী তুললেন আমরা এত কষ্ট করে আসামী ধরি। আসামীর গুলি খাই। জনগনের জানমালের নিরাপত্তা দিই। অথচ দ্যাখেন। আসামী কোর্ট থেকে জামিন পেয়ে বের হয়ে আসে। বিচারে খালাস পেয়ে যায়। অথচ জেনুইন অপরাধী। আমাদেরকে ম্যাজিস্ট্রেসির ক্ষমতা দেয়া হোক। আমরাই ধরবো। আমরাই বিচার করবো। কোন অপরাধী পার পাবে না। নিরীহ জনগণ বিচার পাবে। শান্তিতে ঘুমাবে। আমাদের কনভিকশন রেট হবে ১০০%, প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার মতো কনভিকশন রেট কম হবে না। এত কঠিন কঠিন আসামী আইনের ফাঁক-ফোকর গলে বের হয়ে যাবে তা হবে না। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে। জনগনের আস্থা, বিশ্বাস পুলিশের উপর আরো বাড়বে। পাবলিক কনফিডেন্স বাড়ানোর জন্য এর বিকল্প নেই। দিয়ে দিন ম্যাজিস্ট্রেসির ক্ষমতা।

ধরুন, প্রশাসন সার্ভিস বললেন আমরা অনেক প্রশাসন চালিয়েছি। এবার আমরা চিকিৎসা করবো। আমরা ডাক্তার হবো। চিকিৎসা খাতের যত অব্যবস্থাপনা দুর্নীতি সব দূর করবো। জনগণের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করবো। একজন রোগীও বিনা চিকিৎসায় বা অপচিকিৎসায় মারা যাবে না। হাসপাতাল থেকে ফিরে যাবে না। সরকারী, বেসরকারি সব হাসপাতালে আমরা স্বচ্ছতা৷ নিয়মানুবর্তিতা প্রতিষ্ঠা করবো। আমরা কর্মস্থলে থাকবো। সরকার যেখানে পাঠাবে, সেখানে চলে যাবো। আমাদের উপস্থিতি হবে ১০০ ভাগ। যাবতীয় ক্রয়ে আমরা সততা বজায় রাখবো। মেডিকেল সার্টিফিকেট বিক্রয় করবো না। আদালতকে বিভ্রান্ত করবো না। আমাদের সেবা হবে বিশ্বমানের। বিদেশ থেকে আমাদের দেশে চিকিৎসা করাতে আসবে। এই খাতে বিশাল অর্থ আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বানিয়ে দিন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ডাক্তার।

একই রকম ভাবে ইঞ্জিনিয়ার, ফরেন ক্যাডারসহ ২৮ টা ক্যাডারের সবাই নিজ নিজ কাজ ফেলে কেউ ডাক্তার হতে চাইতে পারে, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ পুলিশ হতে চাইতে পারে, আবার কেউ বিচারক হতে চাইতে পারে। ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তারের কাজ করছেন বা প্রশাসন পুলিশের কাজ করছেন বা পুলিশসহ ২৮ ক্যাডারের কেউ বিচারের কাজ করছেন এই বিষয়গুলো অস্বাভাবিক। হাস্যকর মনে হবে আপনার কাছে। অসাংবিধানিকতো বটেই। কারণ এই জন্য তাকে নিয়োজিত করা হয়নি। একজন ডাক্তার না হয়ে যদি ডাক্তারী করেন তবে গরুর ইনজেকশন মানুষকে মেরে দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। তখন ডাক্তার আসার আগে আসলেই রোগীর মারা যাওয়া উচিত। কারণ যেভাবেই হোক রোগীর মৃত্যু অবধারিত।

পুলিশ না হয়ে কেউ যদি পুলিশিং করতে চায় তবে অপরাধীর সাথে সাথে নির্দোষ ব্যক্তির মৃত্যুও অবধারিত। আইনজীবী না হয়ে যদি কেউ ওকালতি করতে যায় তবে সে টাউট। আসামীর ফাঁসি নিশ্চিত। টাউটেরও সাজা নিশ্চিত। প্রশাসনের কেউ না হয়ে যদি প্রশাসনগিরি করতে যায় তবে জনগনের, সরকারের উন্নয়নের অবস্থা শোচনীয় হবে। জনগন কাঙ্ক্ষিত সেবা পাবে না। ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে কেউ যদি ইঞ্জিনিয়ারিং করতে যায়, রাস্তা, বিল্ডিং বানাতে যায় তবে সেই রাস্তা আর বিল্ডিয়ের কি অবস্থা হবে তা চিন্তা করাই বাহুল্য।

মোদ্দা কথা হলো – যার যা কাজ তাই করা উচিত। যে অফিসারকে তৈরি করা হয়েছে পুলিশ হিসেবে, তিনি পুলিশের কাজ করবেন। যাকে ইঞ্জিনিয়ার বানানো হয়েছে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং এর কাজ করবেন। যাকে প্রশাসনের জন্য তৈরি করা হয়েছে তিনি প্রশাসন চালাবেন। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারের উন্নয়ন কাজ এগিয়ে নেবেন। ডাক্তার হাসিমুখে চিকিৎসা সেবা প্রদান করবেন। আইনজীবীগণ বিচার প্রার্থীদের পক্ষে আদালতে ন্যায়বিচারের জন্য লড়বেন। কোর্টের অফিসার হিসেবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবেন। বিভিন্ন ক্যাডারে যারা আছেন তারা নিজ নিজ কাজ করবেন। আরেকজনের কাজ করতে যাবেন না। ততটুকুই সম্পৃক্ততা থাকবে যতটুকু প্রয়োজন। এটাই কর্মের সুন্দর, সুষম বন্টন। নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলেই দেশ এবং দশের উন্নতি হবে। আত্মতৃপ্তি থাকবে যে আমাকে যে কাজ করার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে আমি তা পালন করছি। আমার জীবন গেলেও আমার নীতি থেকে বিচ্যুত হবো না। এটাই একজন সরকারী কর্মচারী, কর্মকর্তার ন্যায়বোধ হওয়া উচিত।

আপনি জানলে অবাক হবেন দন্দবিধির (CrPC) ১০ ধারায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কথা বলা হয়েছে। সরকার মেট্রোপলিটন এরিয়ায় পুলিশকেও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ করতে পারেন। কোন আইনে কোন বাধা নেই। সিভিল সার্ভিসের বাকী ২৬ টা ক্যাডার সার্ভিসের কথা না বলায় তারা মনক্ষুন্ন হতে পারেন বৈকি!!

ইংরেজি ডেপুটি কমিশনারের (ডিসি) বাংলা জেলা প্রশাসক হয় কিনা সেটা ভাষাতাত্ত্বিকদের বিষয়। চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পদের বাংলা যদি কেউ “মুখ্য বিচারিক হাকিম” বলে তবে আমজনতার না বুঝাই স্বাভাবিক। বিচারকগণ আগেই দেওয়ানী এবং ফৌজদারী মামলার বিচার করতেন। বিখ্যাত মাজদার হোসেন মামলার রায়ের অনুবলে ২০০৭ সালে ম্যাজিস্ট্রেসি বিচার বিভাগকে অর্পণ করা হয়। কিন্তু,অব্যাহত দাবীর মুখে ২০০৯ সালেই ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন করে ১০৪টা আইনকে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিডিউলে ঢুকিয়ে মোবাইল কোর্ট বের করা হয়। প্রথমে সম্ভবত ১৫/২০ টা আইন ছিলো। এখন কলেবর বাড়তে বাড়তে অনেক বেড়েছে। ভুল আইনের ভুল বিচারের স্বীকার হয়েছে মানুষ। ডাক্তার হওয়া ছাড়া ডাক্তারী করলে যা হয় আর কি?? আমার মাথায় আসে না যে প্রশাসনের এত সব কাজ ফেলে তারা বিচার কিভাবে, কেন করবেন?

আমরা যখন ২০০৮ সালে ডিসি অফিস থেকে পাওয়া নথি বিচার করতে গিয়েছি তখন দেখেছি শত শত হাজার হাজার নথি। একই স্টেজে মামলা বছরের পর পর বছর পড়ে আছে। সাক্ষী হাজিরা দিয়েই যাচ্ছে। বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট নথির আদেশ নামা অনুযায়ী ” প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত”। সুতরাং, সাক্ষী সাক্ষ্য না দিয়েই ফেরত গিয়েছেন। দিনের পর দিন বছরের পর বছর মামলা রায়ের জন্য থেকেছে। এই প্রশাসনিক ব্যস্ততা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে চলেছে। আমরা দ্রুততম সময়ে ঐ মামলাগুলোর বিচার নিষ্পন্ন করেছি। হাজারটা ব্যস্ততার মাঝে বিচার কখন করবে যেখানে প্রশাসনিক কাজ অগ্রাধিকার এবং বিচার কাজ গৌণ!! ব্যক্তিগত ভাবে আমি প্রশাসনের কয়েকজন অফিসারকে জানি যারা তাদের নিজেদের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চান। তাদের বক্তব্য হলো- বিচার বিভাগকেই বিচারের কাজ দেওয়া উচিত। বিচার করার মতো ফুসরত তাদের নেই। আর বিচারক বিচার করবে এটাই স্বাভাবিক। তারা মনে করেন প্রশাসন পরিচালনায় এই বিচারের দায়িত্ব উটকো ঝানেলার এবং দায়িত্বের সৃষ্টি করে যার ফলে প্রশাসনিক কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ায় তারা মনে করেন অন্যের কাজ করার কোন মানেই হয় না। আমি তাদের মতামতকে সম্মান জানাই।

তারপরও এই অব্যাহত চাওয়া অবিরতভাবে বছর বছর চলছে। মহামান্য হাইকোর্ট এর বিচারপতি মইনুল ইসলাম স্যার ভ্রাম্যমান আদালত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দ্বারা পরিচালনা অবৈধ, অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন। বলেছেন বিচারক দ্বারা বিচার করতে হবে। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারবেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নয়। বর্তমানে বিষয়টি আপীল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে এবং এই সময়ে সময় বৃদ্ধি করে করে ভ্রাম্যমাণ আদালত চলছে। ভ্রাম্যমান আদালতের ধারনা এসেছে ভারত এবং পাকিস্তানে থেকে। তবে পার্থক্য হলো তা বিচারক দ্বারা পরিচালিত। প্রশাসন দ্বারা নয়। বিচার করা কোন প্রশাসনিক কাজ নয়। এই বিষয়গুলো মাজদার হোসেন মামলা এবং ভ্রাম্যমান আদালত সংক্রান্ত রায়ে বলা হয়েছে। মাজদার হোসেন মামলার আগে ভারতে প্রায় একই বিষয় নিয়ে All India Judges Association মামলা করা হয়েছিলো। মাজদার হোসেন মামলায়ও তা প্রতিফলিত হয়েছে। ব্যতিক্রম আমাদের দেশ। ভারত, পাকিস্তানের ভ্রাম্যমাণ আদালত সম্পর্কে আরো জানতে চাইলে ইন্টারনেটে দেখুন।

প্রতিটা সার্ভিসের নির্ধারিত যোগ্যতা রয়েছে। তাই, চাইলেই কেউ ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে না। এটা বিশেষায়িত পদ। বিশেষায়িত বিষয়ে পড়াশোনা করে শুধু নির্দিষ্ট যোগ্যতা অর্জন করারাই তা পারেন।তেমনি বিচারক হতে হলেও আইন বিষয়ে পড়ালেখা করে নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন করে প্রিলিমিনারি, লিখিত এবং ভাইভা বোর্ড অতিক্রম করে বিচারক হতে হয়। এই পদ্ধতিতে না এসে,নিয়োজিত না হয়ে কেউ কি আদালতে বিচার করতে পারেন? বাংলাদেশের যে কোন বিষয় পড়াশোনা করে যে কেউ প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করতে পারেন। কিন্তু বিচারক হতে পারবেন না। তেমনি নির্ধারিত বিষয়ে পড়াশোনা না করলে ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার হওয়াও সম্ভব নয়। বিচারকরাও কি চাইতে পারেন তারা অন্য সার্ভিসের কাজ করবেন? এটা কি সম্ভব??কিন্তু বলা হয়ে থাকে সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ। বিচারকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় কৌতুক হলো – “বিচার করতে চাইলে ২৫/২৬ সেট বাদী-বিবাদী আছে এমন বাটোয়ারা মামলা দিয়ে দেয়া হোক। এরপর বিচার হোক”।

মামলা তৈরির আঁতুড় ঘর হলো ভূমি অফিস। এটা ভূমি মন্ত্রনালয়ের অধীন। নিজেদের অফিসার না থাকায় ৩/৪ বছর প্রশাসন সার্ভিসে কাজ করা অফিসারগণ সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে প্রেষণে কাজ করেন। আইন জানা একজন মানুষ যদি এই অফিসে বসেন তবে শত শত সম্ভাব্য মামলার নিষ্পত্তি ওখানেই হয়ে যাবে। বিরোধ অংকুরেই বিনষ্ট হবে। রাষ্ট্রের টাকা, বিচার প্রার্থীর, আদালতের সময় বাঁচবে। একজন সহকারী জজ যদি ভূমি অফিসে বসেন তাহলে কেমন হয়?

একজন ডিসি একটি জেলার কর্ণধার। তিনি কি পরিমান ব্যস্ত থাকেন তা একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে বুঝা সম্ভব নয়। তারা প্রতিবছর সম্মেলন করবেন। অনেক দাবী দাওয়া থাকে। মিডিয়া ফলাও করে সেটা প্রচার করে। এবারও তারা অন্যান্য বছরের মত আমলে গ্রহনের ক্ষমতা চাইবেন। চাইতে চাইতে এক সময় হয়তো দাবী পাকাপোক্ত হবে। হয়তো কখনো দিয়ে দেওয়াও হতে পারে। এই ধাপগুলো, সিঁড়িগুলো CRPC তে এর আগের বেশ কিছু সংশোধনীর মাধ্যমে তৈরি করাই আছে। তা বাস্তবায়নের জন্য অব্যাহত দাবী করা হচ্ছে মাত্র।

বিচারের এই ক্ষমতা প্রশাসনকে দিলে বিচার বিভাগের কোন ক্ষতি বৃদ্ধি আছে? না, নেই। কারণ বিচারকের সামনে যা দেওয়া হবে তাই তিনি বিচার করবেন। কি দেওয়া হয়েছে বা কি দেওয়া হয়নি সেটা দেখা বিচারকের কাজ নয়। তার কাজ আইনের কালো অক্ষর অনুযায়ী ন্যায় বিচার করা। প্রশাসন চাইছে আমলে নেওয়ার ক্ষমতা। অর্থাৎ একটা মামলার তারা অভিযোগ শুনবে, আমলে নেবে, পুলিশকে নির্দেশ দেবে, আসামীদের জামিন দেবে বা জেলে পাঠাবে। পুলিশ আসামী ধরে তাদের কাছে পাঠাবে। রিমান্ড চাইবে। তারা চার্জশিট গ্রহন করবেন। নারাজী শুনবেন। সমন, ওয়ারেন্ট দেবেন।অনেক দিন অভ্যেস না থাকায় প্রথমে একটু সমস্যা হতে পারে। মামলা বিচারের জন্য প্রস্তুত হলে এর পর দায়রা জজ,জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দের কাছে পাঠাবে।দায়রা জজ, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা এরপর বিচার করবেন। আবার তারা গাউন পরে আদালতে বিচার করবেন। এটা হতেই পারে। তবে ব্যর্থ হবে সংবিধান যা এই দেশের মূল চালিকাশক্তি যাতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরন আছে। বিচারকেরাই বিচার করবেন সেটা আছে। ব্যর্থ হবে মাজদার হোসেন মামলা। বিচার প্রার্থীদের বিচারিক আদালত এবং বিচারক দ্বারা বিচার প্রাপ্তির সাংবিধানিক অধিকারও নষ্ট হবে। সংবিধান এবং মাজদার হোসেন মামলার রায় লংঘন করে তাদের এই প্রাপ্তির সম্ভাবনা শুন্য। সাবেক আইন মন্ত্রী( শফিক স্যার) একবার এই ধরনের সম্মেলনে খুব কড়া ভাষায় বলেছিলেন -বিচারকেরাই বিচার করবে। স্বাভাবিকভাবেই এই মন্তব্য পছন্দনীয় ছিলো না।

CrPc অনুযায়ী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর আপীলেট অথরিটি হলেন দায়রা জজ। দায়রা জজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর আদালত পরিদর্শন করতে পারেন। যে কোন নথি কল ফর করতে পারেন যে কোন আদালত থেকে। সুপ্রীম কোর্টে রিপোর্ট পাঠাতে পারেন। বাংলাদেশের সকল আদালতের মাস শেষে মামলার বিবরণ সুপ্রীম কোর্টে যায়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর আদালত থেকে প্রতিবেদন জেলা জজ কোর্ট, সুপ্রীম কোর্টে যায় কিনা তা জানি না। ভ্রাম্যমাণ আদালত যে বিচার নিষ্পত্তি করে তার প্রতিবেদন সুপ্রীম কোর্টে পাঠায় কিনা জানি না। আইন কি আছে? CRRO, 2009 এর ভলিয়ুম ১,২ খুলে দেখতে পারেন। তারা আদালত হলে মিডিয়ার বদলে এই প্রতিবেদন সুপ্রীম কোর্টে পাঠাতে বাধ্য। কিছুদিন আগে একটা খবর দেখলাম পুলিশ সুপারের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন দেওয়ার ক্ষমতা চান ডেপুটি কমিশনাররা। ভালো প্রস্তাব। এর কারণ হলো আইন শৃংখলা রক্ষায় নাকি সমস্যা হচ্ছে!!!

আইন শৃংখলা রক্ষা করে পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর সদস্য। আইন শৃংখলার অবনতি হলে একটি জেলায় দায়ী হবেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ (এসপি) বা ঐ রেঞ্জের ডিআইজি। শুধুমাত্র আইন শৃংখলা রক্ষা কমিটির সভাপতি হয়ে শুধু নির্দেশনা প্রদান করে কিভাবে আইন শৃংখলা রক্ষা সম্ভব তা বোধগম্য নয়। এই বিষয়ে যা করার পুলিশ তার উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী করবে। আইন শৃংখলা কমিটির এই বিষয় ২০০৭ সালের আগে যেভাবে ছিলো সেভাবেই রয়ে গিয়েছে। জেলা প্রশাসক/জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ সুপার বা সিভিল সার্জন বা চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট একটি জেলার অনেক কোর অফিসারদের মধ্যে অন্যতম। আইন শৃংখলা কমিটির অনেক সভায় অনেক সময় পুলিশ সুপার উপস্থিত না থাকলে মনঃক্ষুন্ন হন। ২০০৭ সালে ম্যাজিস্ট্রেসি পৃথক হওয়ার কারনে পুলিশ রেগুলেশন অব বেংগল এর অনেক রেগুলেশন অকার্যকর হয়ে গিয়েছে। পি আর বি এর যে জায়গায় “জেলা ম্যাজিস্ট্রেট’ শব্দ আছে সেখানে CRPC,1898 অনুযায়ী চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পড়াই উত্তম। কোন ধরনের ফাংশন না থাকা স্বত্ত্বেও পুলিশ সুপারের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন দিতে চাওয়ার এই দাবী কেন করা হয় তা সাধারণ জনগণ মাত্রই বুঝেন। আশার কথা হলো এই বিষয়ে পুলিশ প্রশাসন এবং পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশন অত্যন্ত সোচ্চার। এই বার পুলিশ সুপারের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন দিতে চাওয়ার এই দাবী মনে হয় কোন জেলার জেলা প্রশাসক প্রেরন করেননি। তাই মনে হয় মিডিয়ার খবরে বা দাবী দাওয়ায় নেই। তবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটগনের এই বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন দিতে চাওয়ার বিষয়ে জেলা ও দায়রা জজগনের একটি আইনগত দাবী থাকা সম্ভব।

জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগনের বিচারিক কাজ মূল্যায়নে একটু ঘাটতি রয়েছে। সময় সময়ে মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিগন জেলা জজ আদালত, চীফ জুডিসিয়াল বা চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত পরিদর্শন করেন। বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পরে কখনো শোনা যায়নি যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর আদালত পরিদর্শন করা হয়েছে। কেন? তারা আদালত হলে এই দায়ভারের বাইরে কেন? অচিরেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর আদালতগুলোও পরিদর্শন করা উচিত। তারা ১৪৫,১০৭,১১৭ ধারার মামলাগুলোতে কি করে তা দেখা উচিত। তাদের আদালতগুলোতে কি পরিমাণ মামলা জট আছে সেটাও দেখা উচিত। তাদের মামলা জট নিষ্পত্তিতে করনীয় নির্ধারণ করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কেন মামলা জট হচ্ছে তাও দেখা উচিত। ৫ বছরের বেশি বিচারাধীন রয়েছে এমন মামলার হিসেব আদালতগুলো আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়, সুপ্রীম কোর্টে কয়েক মাস পর পর প্রেরন করে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতেও এই ধরনের পুরোনো মামলা থাকলে তার জন্য ব্যবস্থা নেয়া উচিত। গাফিলতি থাকলে শাস্তি দেয়া উচিত। সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট এর বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনে এটা তার অদক্ষতা, অযোগ্যতা,অসদাচারণ বলে উল্লেখ করা উচিত। আদালত জনগনের আস্থায় চলে। তারাও জনগনের আস্থায় ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করেন। কিন্তু শুধু এটুকুই যথেষ্ট নয়।

একজন বিচারকের বিচারক কাজের মূল্যায়ন জনগন ছাড়াও উর্ধতন বিচারক করেন। জেলা ও দায়রা জজ আপীলেট বা রিভিশনাল অথরিটি হিসেবে বিচারকের বিচারক,প্রশাসনিক কাজের মূল্যায়ন করেন। সেই অনুবেদন সুপ্রিম কোর্টে প্রেরন করা হয়। গোপনীয় অনুবেদন একজন বিচারকের সামগ্রিক মূল্যায়ন। বিচারকগনের এই মূল্যায়ন হলেও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এই মূল্যায়নের বাইরে রয়েছেন যা আইনগতভাবে থাকা উচিত নয়। তারা মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বা জেলা জজ কারো অধীনেই নেই। তারা একটি ফাঁকা জায়গায় রয়েছেন যার কোন দায়বদ্ধতা নেই।

বিচারকগনের পদোন্নতি বা বদলী প্রভৃতিতে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শের প্রয়োজন হলেও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগনের এই প্রয়োজন নেই। তারা বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চান দায়বদ্ধতার বাইরে থেকে।এমনকি তারা বিভিন্ন পর্যায়ে থাকার সময় যে ভ্রাম্যমান পরিচালনা করেন এবং এক সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হন, তার কোন পর্যায়ে পোষ্টিং,পদোন্নতি হওয়ার সময় আইন সংক্রান্ত জ্ঞান তার আদেশ,রায় দেখে বিবেচনা করা হয় কিনা জানি না। অথচ এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা যেহেতু জনগণের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার প্রদান করেন এবং আইনকে ওইভাবেই প্রয়োগ করেন, আমি মনে করি অবশ্যই তাদের বিচারিক কাজের মূল্যায়ন থাকা উচিত।

প্রচলিত আইন অনুযায়ীই তারা “ম্যাজিস্ট্রেট” শব্দ এবং “ভ্রাম্যমাণ আদালত” ব্যবহার করায় কেউ মানুক বা না মানুক তারা অবশ্যই আইন অনুযায়ী বিচারক সম্প্রদায়ের আওতাভুক্ত। তারা অবশ্যই বিচারক বলে মনে করি। তারা এটা দাবীও করেন। আমলে গ্রহন সহ এই দাবী দাওয়া এটাই প্রমান করে যে তারা বিচারিক স্বত্ত্বা ধারন করেন। তাদের এখনো এজলাস ও আছে এবং তাতে তারা নিয়মিত বসেন!! তাহলে আদালত হিসেবে তাদের দায়বদ্ধতা কেন থাকবে না!! গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগন বিচারক হওয়ায় বা বিচারিক ক্ষমতা দাবী করায় বা বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করায় “বিচারিক কাজ” সংক্রান্তে তাদের মূল্যায়ন কে করবেন? যৌক্তিক প্রশ্ন নিঃসন্দেহে।

একটি জেলায় জেলা ও দায়রা জজ হলেন সবচেয়ে সিনিয়র কর্মকর্তা। জেলা ও দায়রা জজ পদে ৫ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করা বিচারক “সিনিয়র সচিব”এর পদ মর্যাদার। ৫ বছরের কম সময় ধরে জেলা ও দায়রা জজ পদে কাজ করা বিচারক “সচিব”এর পদ মর্যাদা সম্পন্ন। সুতরাং, বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করার ক্ষমতা সম্পন্ন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা তার অধঃস্তন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগনের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন নিঃসন্দেহে জেলা ও দায়রা জজ কর্তৃক প্রদান করা উচিত।তিনিই এর উপযুক্ত। জেলায় সব আদালত তার অধঃস্তন এবং জেলা জজ পদটি একটি সাংবিধানিক পদ। এই আওতার বিষয়টি নিশ্চিত করা হলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগনের বিচারিক কাজের মূল্যায়ন হবে বলে আশা করা যায়।

জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তার অধঃস্তন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের আপীল নিজে শোনেন বা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর নিকট প্রেরণ করেন। এরপর ঐ আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন শুনেন দায়রা জজ। আবার স্বয়ং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোন বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করলে ভ্রাম্যমাণ আদালত অনুযায়ী তার আপীলেট অথরিটি হলেন সরাসরি দায়রা জজ। জেলা ও দায়রা জজ হলেন সকল বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটগনের আপীলেট, রিভিশনাল অথরিটি। জেলা ও দায়রা জজ মহোদয়ের পক্ষেই মূল্যায়ন করা সম্ভব তার অধঃস্তন ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারকের বিচার করার আইনী জ্ঞান পরিপক্কতা, সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা, আইন অনুধাবন ও প্রয়োগ করার নূন্যতম জ্ঞান, যোগ্যতা রয়েছে কিনা? একজন বিচারকের বছর শেষে গোপনীয় প্রতিবেদন প্রদান করেন মাননীয় জেলা ও দায়রা জজ যা মহামান্য সুপ্রীম কোর্টে প্রেরণ করা হয়। উক্ত প্রতিবেদনে বিচারকের বিচারিক, প্রশাসনিক কাজের মূল্যায়ন থাকে। এর উপর নির্ভর করে বিচারকের পদোন্নতি প্রভৃতি। ডেপুটি কমিশনার/জেলা ম্যাজিস্ট্রেটগনের ও বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন রয়েছে।যেহেতু মাননীয় দায়রা জজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের আপীলেট অথরিটি এবং তারা বিচারিক কাজ ভালোবাসেন,সেহেতু তাদের বিচারিক কাজের মূল্যায়ন থাকা উচিত। কারন, জেলা ও দায়রা জজ সকল বিচারককে গোপনীয় প্রতিবেদনের মাধ্যমে মূল্যায়ন করেন। জেলা ও দায়রা জজ আপীলেট বা রিভিশনাল এখতিয়ার প্রয়োগ করেন বিধায় তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এরও বিচারিক কাজের মূল্যায়ন করার ক্ষমতা ধারন করেন। এই ক্ষমতা অচিরেই অর্পণ করা হোক। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং তার অধীনে কর্মরত সকল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করেন এমন সকল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে এই গোপনীয় অনুবেদন আবশ্যিক ভাবে গ্রহন করতে হবে। তাদের এই অনুবেদন আশা করা যায় বিভিন্ন প্রমোশনের সময় মূল্যায়িত হবে।এটা ছাড়া কোন প্রকার দায়বদ্ধতাহীন ক্ষমতা ভয়ংকর হতে পারে।

বিদ্যমান আইন অনুযায়ীই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এই দায়বদ্ধতা গ্রহণ করতে বাধ্য এবং এটা সময়ের দাবী। এই দায়বদ্ধতার মধ্যে আনা গেলে তারা ক্ষমতা প্রাপ্তি,দাবী এবং প্রয়োগে আরো সতর্ক হবেন বলে আশা করা যায় যার সুফল সবশেষে জনগনই ভোগ করবেন। জনগনের স্বার্থেই এই দায়বদ্ধতার প্রচলন করতে হবে। আমরা আশা করবো এই আইনগত দাবীও উচ্চারিত এবং বাস্তবায়িত হবে অচিরেই। আশার কথা হলো- ডেপুটি কমিশনার/জেলা ম্যাজিস্ট্রেটগনের এই সম্মেলনের একটি সেশনে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয় উপস্থিত থাকবেন। তিনি তাদের দাবী দাওয়া সম্পর্কে অবগত হবেন। আমরা আশা করবো পরবর্তী বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতির উপস্থিতিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটগন বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগনের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন প্রদান সংক্রান্ত এই দাবী উত্থাপিত হবে এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় সচিব মহোদয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে উপস্থিত থেকে এই আইনগত বিষয় উপলব্ধি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবেন।

লেখক : অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বান্দরবান পার্বত্য জেলা