সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী বলেন, ‘শিশুরা অপরাধ (ক্রাইম) করার প্রবণতা নিয়ে জন্মায় না। অপরাধী (ক্রিমিনাল) হয়ে জন্মায় না। পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে ক্রাইমে জড়িয়ে যায়। এর জন্য দায়ী কে সেটাও আমাদের চিন্তা করা উচিত।’
পুলিশ সদস্য ও সমাজসেবা কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে আজ শনিবার (৩১ আগস্ট) ‘ডাইভারশন ফ্রম দ্য পুলিশ স্টেশন আন্ডার দ্য চিলড্রেন অ্যাক্ট ২০১৩’ শীর্ষক কর্মশালায় তিনি এ মন্তব্য করেন। সুপ্রিম কোর্ট অডিটোরিয়ামে সুপ্রিম কোর্ট স্পেশাল কমিটি ফর চাইল্ড রাইটস ও ইউনিসেফ যৌথভাবে এ কর্মশালার আয়োজন করে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সুপ্রিম কোর্ট স্পেশাল কমিটি ফর চাইল্ড রাইটস এর চেয়ারপারসন বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী বলেন, যখন আমি নিউজিল্যান্ডে গিয়েছিলাম তাদের শিশু বিচার ব্যবস্থা দেখার জন্য, সেখানে তখন আমাকে বলা হয়েছিল যে, থানা থেকেই উনারা ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ শিশু আসামিকে মামলা থেকে বাদ দিয়ে দেয়। চিন্তা করেন! ১০০ থেকে ৭৫ জন চলে গেলে মাত্র ২৫ জন যাবে কোর্টে। কোর্টে যাওয়ার পরে কোর্ট থেকে আরও ১০ থেকে ১৫ ভাগ ডাইভারশনের মাধ্যমে অব্যাহতি পায়। আজকে এখানে আমরা সবাই উপস্থিত হয়েছি এই ডাইভারশনের ব্যাপারেই আলোচনা করার জন্য।
তিনি পুলিশ সদস্য ও সমাজসেবা কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমাদের সর্বপ্রথম মনে রাখতে হবে, আমরা যাদেরকে নিয়ে কাজ করতে যাচ্ছি বা করছি তারা হচ্ছে আমাদের দেশের শিশু। আপনারা সবাই জানেন শিশুরা নিষ্পাপ হয়, অবুঝ হয়। ঠিক চিন্তাভাবনা করে কোনো কাজ করে না। এ কথাগুলো আমাদের মনে রাখতে হবে।
বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী বলেন, শিশুরা ক্রাইম করার প্রবণতা নিয়ে জন্মায় না। ক্রিমিনাল হয়ে জন্মায় না। পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে ক্রাইমে জড়িয়ে যায়। এর জন্য দায়ী কে সেটাও আমাদের চিন্তা করা উচিত।
‘একটা শিশু খাবার চুরি করে। খাবার চুরি করে কেনো? তার পেটে ক্ষুধা লাগলে পরে খাবার চুরি করে। একটা মোবাইল চুরি করে কেনো? তার বন্ধুর সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার জন্য নয়। মোবাইল চুরি করে সেটা বিক্রি করে যে টাকাটা পাবে সেটা দিয়ে সে তার প্রয়োজনীয় কিছু একটা কিনবে। যে জিনিসটা তার মা-বাবা তাকে দিতে পারেনি। মা-বাবা যোগান দিতে পারেনা বলে শিশুরা খারাপ পথে চলে যায়। মা-বাবা ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারে না বলে শিশুরা খারাপ পথে চলে যায়।’
বিচারপতি ইমান আলীর মতে, মা-বাবা পারে না কেনো সেটাও চিন্তার বিষয়। গরীব মা-বাবা যে টাকা রোজগার করে, সেটা দিয়ে সংসারই চলে না। ফলে শিশুর বিলাসিতা দেখার মতো ক্ষমতা তাদের নেই। জিন্স প্যান্ট কিনে দেওয়ার মতো টাকা তাদের কাছে নেই। সমস্যাটা কোথায়, আরেকটু গভীরে যেতে হবে দেখার জন্য। আমাদের সমাজব্যবস্থা এমন যে, মা-বাবা তাদের সন্তানদের ঠিকমতো দেখাশুনা করার ব্যবস্থা নাই। আমাদের সেই মা-বাবার জন্য কর্মসংস্থান করে দিতে হবে। চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
শিশুদের খারাপ কাজে জড়ানোর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আজকে এটাই মনে রাখতে হবে, শিশুরা খারাপ পথে যায়, খারাপ কাজ করে, চুরি করে, মারামারি করে, নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো একটা কারণ আছে। যার জন্য আমি বলবো যে, আদতে শিশুরা এই খারাপ কাজ বা খারাপ ব্যবহারের জন্য দায়ী নয়। শিশুরা মারামারি করে কারণ তাদের পরিবারের মধ্যে মারামারি হয় বলে এটাকে জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নেয়। যে ঘরে দৈনন্দিন মারামারি হয়, সে ঘরে শিশুরা বড় হচ্ছে মারামারি দেখতে দেখতে। মারামারি তাদের জন্য কিছুই না।
পুলিশ সদস্য ও সমাজসেবা কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমাদের কাজটা হচ্ছে শিশুদেরকে কিভাবে ভালো পথে নিয়ে আসবো, কি করলে ভালো হবে, এগুলো নিয়ে চিন্তা করা।
এছাড়া প্রবেশন অফিসার ও পুলিশ সদস্যদের যোগাযোগ বাড়ানোর ওপরও জোর দেন আপিল বিভাগের এ বিচারপতি।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন- হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার, ঢাকা মহানগর পুলিশের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন, সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (ইনস্টিটিউশন) মো. আবু মাসুদ ও ইউনিসেফ বাংলাদেশের চাইল্ড প্রোটেকশন স্পেশালিস্ট শাবনাজ জাহেরীন প্রমুখ।