রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ‘গ্রাম আদালত সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা সভা

গ্রাম আদালত নিয়ে গণমাধ্যমকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে

গ্রাম আদালতের মাধ্যমে মামলাজট যেমন কমবে, তেমনি প্রান্তিক মানুষের হয়রানিও কমে যাবে। আদালতে মামলা বছরের পর বছর ধরে চললেও এখানে অল্প সময়ে নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। বাদী-বিবাদী উভয়ই উপকৃত হয়। এ আদালতের মাধ্যমে যারা উপকার পেয়েছে তাদের বিষয়টি প্রচার করতে হবে। পাশাপাশি মফস্বল সাংবাদিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের যারা দায়িত্বে থাকবেন তাদেরও এ বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। গণমাধ্যমে গ্রাম আদালতের সাফল্য এবং এর তথ্য প্রচার স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের বিচারিক অধিকার লাভের পাশাপাশি উচ্চ আদালতে মামলার জট কমাতে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখবে।

রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ‘গ্রাম আদালত সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) বক্তারা এ কথা বলেন। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সেমিনারের আয়োজন করে।

মতবিনিময় সভায় আরও বলা হয়, বাংলাদেশ গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ (২য় পর্যায়) প্রকল্প ১ হাজার ৮০টি ইউনিয়নে গ্রাম আদালত ব্যবস্থা কার্যকর করতে কাজ করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক সহায়তায় ও ত্রিপক্ষীয় অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এ প্রকল্প চলছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে দেশের ৮ বিভাগের ২৭টি জেলার ১২৮টি উপজেলায়। উচ্চ আদালত হতে মামলার চাপ কমাতে, একই সঙ্গে জনগণের কাছে স্থানীয় বিচার ব্যবস্থার সুযোগ পৌঁছে দিতে বাংলাদেশ সরকার ২০০৬ সালে গ্রাম আদালত আইন পাস করে, যা পরে ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়। এ আদালতে ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত ১ লাখ ৩৩ হাজার ৬৬৪টি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলাগুলো দায়েরের ৬ সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পত্তি করা হয়। বাস্তবায়নের হার প্রায় ৯৪ শতাংশ।

মতবিনিময় অনুষ্ঠানে মাঠ পর্যায়ে অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করেন, মানিকপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাবিনা ইয়াসমিন ও বাগেরহাটের ভ্যানচালক ইকরামুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে বিশেষ প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম। অন্যদের মধ্যে বক্তৃতা করেন ইউএনডিপি বাংলাদেশ আবাসিক প্রতিনিধি সুদীপ্ত মুখার্জী, বাংলাদেশে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-এর রাষ্ট্রদুত রেনসে তিরিঙ্ক, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। মুক্ত আলোচনায় সাংবাদিকদের মধ্যে অংশ নেন সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, নাদিম কাদের, মানস ঘোষ, সুকান্ত গুপ্ত অলক, প্রভাষ আমিন প্রমুখ।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা স্থানীয় বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থাকে ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে। গ্রাম আদালতে কার্যকরভাবে বিচার নিষ্পত্তি হচ্ছে কি না এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে গণমাধ্যম জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িত অংশীজনদের জবাবদিহিতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। এছাড়াও গ্রাম আদালতের সাফল্যের ওপর প্রচার চালিয়ে গ্রাম আদালতের সেবা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতেও গণমাধ্যম বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে।

উক্ত মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘গ্রাম আদালত ৭,৫০০০ টাকা মূল্যমানের ছোটখাটো বিরোধ নিষ্পত্তি করে থাকলেও অনেক সময়ই গ্রাম্য প্রভাবশালীদের কারণে সাধারণ মানুষ জেলা আদালতে বা থানায় চলে যায়। এর ফলে বিচার প্রাপ্তির জন্য তাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পাশাপাশি নানা ধরনের ভোগান্তির শিকার হতে হয়। গণমাধ্যম কোন মামলাগুলো গ্রাম আদালতে বিচার্য এবং কোনগুলো বিচার্য নয় তা প্রচার করলে সাধারণ জনগণ আরও সচেতন হবে এবং তারা অল্প খরচে কম খরচে বিচার পাবে।’

বাংলাদেশে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-এর রাষ্ট্রদূত রেনসে তিরিঙ্ক বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় বলেন, ‘গ্রাম আদালতের উপকারভোগীদের ২৯% নারী এবং ১৬% নারী প্যানেল সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও এ আদালতের মাধ্যমে সাধারণ জনগণ বিশেষ করে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী নিয়মিত সেবা পাচ্ছে। গণমাধ্যমকে এসব সাফল্যের সংবাদ প্রচার করতে হবে।’

তিনি আরও উল্লেখ করেন, প্রকল্প এলাকায় গ্রাম আদালতের সাফল্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ট্র্যাডিশনাল বিচার ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করা এবং গ্রাম আদালতের উপযোগিতা নিরূপণের জন্য গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ প্রকল্পের কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়েছে।

মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি সুদীপ্ত মুখার্জী বলেন, ‘গ্রাম আদালতের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার নাগরিকদের ন্যায়বিচার লাভের মৌলিক অধিকার লাভের সুযোগ তৈরি করেছে, এর পাশাপাশি স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় লক্ষ্য ১৬ ‘শান্তি, ন্যায়বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানসমূহ’ অর্জনেও সহায়তা করছে।’

তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যম সঠিক ও কার্যকরভাবে গ্রাম আদালতের বিভিন্ন তথ্য প্রচার করার মাধ্যমে সাধারণ জনগণ তাদের বিচারিক অধিকার লাভের বিষয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে সার্বিক জীবনমান পরিবর্তনে সাহায্য করবে।’

প্রকল্প এলাকার ২৭টি জেলার মধ্যে রয়েছে ফরিদপুর, গাজীপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, সিলেট, নওগাঁ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, রংপুর, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা। এ ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ জেলার ২৬ উপজেলার ১২১টি ইউনিয়নে সম্প্রতি প্রকল্পের কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়েছে।

গ্রাম আদালতে বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ অনুয়ায়ী গ্রাম আদালত সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যমানের ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি করতে পারে। নিজ ইউনিয়ন পরিষদেই বসে গ্রাম আদালত। বিচারিক প্যানেলে নিজের প্রতিনিধি নিজেই মনোনয়ন দেয়া যায়। আবেদনকারী এবং প্রতিবাদী নিজেরাই নিজেদের কথা বলতে পারেন। তাই আইনজীবী দরকার হয় না।

চুরি, ঝগড়া- বিবাদ, কলহ বা মারামারি, দাঙ্গা, প্রতারণা, ভয়ভীতি দেখানো বা হুমকি দেয়া, কোন নারীর শালীনতাকে অমর্যাদা বা অপমানের উদ্দেশ্যে কথা বলা, উত্ত্যক্ত করা। গচ্ছিত কোন মূল্যবান সম্পত্তি আত্মসাত করা, পাওনা টাকা আদায়, স্থাবর সম্পত্তি দখল ও পুনরুদ্ধার, অস্থাবর সম্পত্তি উদ্ধার বা তার মূল্য আদায়, কোন অস্থাবর সম্পত্তির জবর দখল বা ক্ষতি করার জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়। গবাদিপশুর অনধিকার প্রবেশের কারণে ক্ষতিপূরণ, গবাদিপশু মেরে ফেলা বা ক্ষতি করা। কৃষি শ্রমিকের পরিশোধযোগ্য মজুরি আদায় ইত্যাদি।

ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আবেদন ফরম সংগ্রহ করে অথবা সাদা কাগজে প্রয়োজনীয় তথ্য উল্লেখপূর্বক যথাযথভাবে পূরণ করতে হবে। পূরণকৃত আবেদনপত্র ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর দাখিল করতে হবে। ফৌজদারি মামলার জন্য ১০টাকা এবং দেওয়ানি মামলার জন্য ২০ টাকা ফি প্রদান করতে হবে। এছাড়া কোন খরচ নেই। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানই গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান। বিচারিক প্যানেলে আবেদনকারী ও প্রতিবাদী উভয়পক্ষ কর্তৃক মনোনীত ২ জন করে মোট ৫ জন থাকেন। ফৌজদারি মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে বিরোধীয় ঘটনা ঘটার ৩০ দিনের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে বিরোধীয় ঘটনার ৬০ দিনের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে। তবে স্থাবর সম্পত্তি বেদখল হওয়ার ১ বছরের মধ্যে এর দখল পুনরুদ্ধারের জন্য মামলা করা যাবে। গ্রাম আদালতের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বিচারিক প্যানেলের ৫ জনই একমত হলে অথবা ৫ জনের মধ্যে ৪ জনই একমত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে এ বিষয়ে আপীল করা যাবে না। সিদ্ধান্তের দিন বিচারিক প্যানেলে যদি ৪ জন থাকে এবং তাদের মধ্যে ৩ জন একমত হন, তা হলে আপীল করা যাবে না। তবে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যদি ৫ জনের মধ্যে ৩ জন একমত এবং ২ জন ভিন্নমত পোষণ করেন, তা হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ৩০ দিনের মধ্যে উপযুক্ত আদালতে আপীল করা যাবে।