বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী

‘ফরগিভ মাই ফল্ট, বাট ডোন্ট ফরগেট মি’

এস এম আসিকুজজামান:

টানা ১৫ বছর হাইকোর্টে বিচারকার্য পরিচালনার পর অবসরে গেলেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। আমার চোখে তিনি এই সময়ের একজন সেরা বিচারপতি। বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে তার মেধা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা ছিল মুগ্ধ করার মত। তিনি কোন বিচার্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থে রাগ-অনুরাগ ও বিরাগের ঊর্ধ্বে থেকে বিচক্ষণতার সাথে ‘জুডিশিয়াল মাইন্ড’ অ্যাপ্লাই করতেন। সংবিধান আর আইনের প্রাসঙ্গিকতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। তার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে সব সময় ‘আদালতের ডেকোরাম’ মেইন্টেন করা হত। অনেক তরুণ আইনজীবীই তার কোর্টে একটু ভয়ে ভয়ে যেতেন। তবে তিনি তরুণ আইনজীবীদের সাবমিশন ও আর্গুমেন্ট গুরুত্বের সাথে শুনতেন। এমনকি তরুণ আইনজীবীদের আবেদনে ‘মেরিট’ থাকলে তিনি তাদের ‘ইন্সপায়ার’ করতেন। সেই সাথে তরুণ আইনজীবীদের তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘ভাল করে আইন পড়ে, জেনে তারপর আসুন।’

আদালত কক্ষে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর আরেকটি দিক ছিল চোখে পড়ার মত। তিনি যখন কোন রায় বা আদেশ ঘোষণা করতেন তখন তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে স্পষ্ট উচ্চারণে বলতেন এবং একটু পর পর রায় বা আদেশ লিখতে থাকা বেঞ্চ অফিসারকে বলতেন “এই লিখছো? লেখো”। এছাড়া জটিল উচ্চারণের কোন শব্দ রায় বা আদেশে বললে তিনি নিজেই সে শব্দের বানান বেঞ্চ অফিসারকে বলে দিতেন।

আর ভিন্ন মতের প্রতি কতটা সাবলীলভাবে দায়ীত্বশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো যায় তা বিভিন্ন ‘ডিসেন্ডিং অর্ডারে’র ক্ষেত্রে দেখিয়েছেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। যখনই তার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের অপর বিচারপতি কোন রায় বা আদেশের ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করতেন। তখন সেই আদেশ বা রায় ঘোষণার সময় বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলতেন, ”আমি যে আদেশ দিচ্ছি তার সাথে আমার ‘ব্রাদার’ ভিন্ন মত পোষণ করে এই আদেশ দিয়েছেন”

সুপ্রিম কোর্টে সাংবাদিকতার সুবাদে এতটুকু জেনেছি যে, বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর জন্য গর্ব করার মত একটা অর্জন হচ্ছে তার নীতি-নৈতিকতা। দুর্নীতির ‘দ’ শব্দটাও এই বিচারপতিকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি বলে আইনজীবী ও আদালত সংশ্লিষ্ট অনেকেরই অভিমত। আর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার ঐতিহাসিক রায় সহ তাৎপর্যপূর্ণ অনেক আদেশ ও রায় প্রদানকারী এই বিচারপতি বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর কর্মময় জীবনের শেষ দিনে (বুধবার, ৮ জানুয়ারি) তাঁর আদালত কক্ষে গিয়ে তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানান আইনজীবীরা। এসময় ন্যায় বিচারক বলে অনেকেই তাকে অভিহিত করেন। বিদায়ের আগে আমাদের বিচার বিভাগ ও আইনের শাসন নিয়ে কথা বলেন তিনি। সব শেষে উপস্থিত আইনজীবীদের উদ্দেশ্য বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন…. ‘ফরগিভ মাই ফল্ট, বাট ডোন্ট ফরগেট মি’

লেখক- সাংবাদিক