সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান বলেছেন, বাংলায় রায় দেওয়া সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে আবেদনও বাংলায় লেখা শুরু করতে হবে। তাহলে বাংলায় রায় দেওয়াটা সহজ হবে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির শহীদ সফিউর রহমান মিলনায়তনে রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা রক্ষা কমিটির’ উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমিরেটাস অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন, বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আবু ইয়াহিয়া দুলাল। সভায় বিচারপতি মো. নুরুজ্জামানসহ বক্তারা সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন না হওয়াকে হীণমন্যতাকেই দায়ী করেছেন।
বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান বলেন, বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য এ জাতি রক্ত দিয়েছে। আজকের এই বাংলা ভাষাটা হাজার বছরের ফসল। অথচ আমরা ৮ই ফাল্গুনকে বাদ দিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে বরণ করে নিয়েছি। এই অনুষ্ঠানের যে দাওয়াতপত্র, তাতে বাংলা তারিখটা লেখেননি, লিখেছেন ৯ ফেব্রুয়ারি। এটা দুঃখজনক।
উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলনের ব্যাপারে এই বিচারপতি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের উকিলদের মধ্যে নজরুল সাহেব আর ইয়াহিয়া সাহেব- এই দুই সাহেব ছাড়া আমি অন্য কোনো সাহেব খুঁজে পাইনি। সব সাহেবই ইংরেজিতে লেখেন।
তিনি বলেন, বাংলায় রায় দেয়া সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে- পিটিশন, আর্জি- এগুলো বাংলায় লেখা শুরু করতে হবে। তাহলে বাংলায় রায় দেয়াটা সহজ হবে। আজকের এই বাংলা ভাষাটা হাজার বছরের ফসল। তাই সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন করতে হলেও ধীরে ধীরে এগোতে হবে।
বিচারপতি আশরাফুল কামাল বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর এবং ভাষা সংগ্রামের প্রায় ৬৮ বছর পর এসে রাষ্ট্রভাষা বাংলা রক্ষার জন্য কমিটি করতে হচ্ছে। এতেই বোঝা যায়, বাংলা ভাষার অবস্থা কতটা খারাপ।
তিনি বলেন, আমরা আজও আমাদের মাতৃভাষাকে সম্মান করতে পারি না। এটা আমাদের হীনমন্যতা। ব্রিটিশরা চলে গেছে প্রায় ২০০ বছর আগে, অথচ এখনো আমরা তাদের ভাষাকে আকড়ে ধরে আছি। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য, লজ্জা ও বেদনার আর কিছু হতে পারে না।
তিনি আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলনের জন্য আপনাদের রক্ত দিতে হবে না। শুধু বাংলায় আবেদন লিখলেই হবে। এটা হলেই ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ফটাং ফটাং করে দু-একটা ইংরেজি শব্দ বলতে পারলেই আমরা ভাবি ছেলে শিক্ষিত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, তখনই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, যখন দেখি কোনো বিচারপতি, মন্ত্রী-এমপি বা সাংবিধানিক পদধারী কারো পক্ষ থেকে পাঠানো বিয়ের কার্ড শুধুই ইংরেজি থাকে। বাংলার প্রতি আমাদের এত হীনমন্যতা কেন?
তিনি বলেন, কোনো রাশিয়ান, জাপানিজ বা চীনাকে দেখবেন না অন্যদের ভাষায় কথা বলতে। অথচ আমাদের ভাষা কত সমৃদ্ধ। আমাদের এজন্য প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি। তিনি বলেন, অংক, বাংলা সবই ইংরেজিতে পড়াচ্ছি। ছেলে-মেয়েদের মাথা খেয়ে ফেলছি। আমি ইংরেজি, আরবি বা অন্য কোনো ভাষার বিপক্ষে নই। তবে শিশুর প্রথম অক্ষরজ্ঞান শেখাতে হবে তার মাতৃভাষায়। মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়া শিশুর মানবাধিকার।
অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার কথা বলা আছে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে আইন হয়েছে। কিন্তু তারপরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। বরং দেশে ইংরেজি ভার্সন শুরু হয়ে গেছে। এমনকি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের মাঝেও বাংলার প্রতি অনীহা চলে এসেছে।
মন্ত্রী-এমপিদের ছেলে মেয়ে, সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো হচ্ছে। তবে বিচলিত হতে হয়, তখনই যখন তারা বিদেশে নাগরিকত্ব নিয়ে বিদেশেই থেকে যান। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, জাতীয় সংসদের সাড়ে ৩০০ এমপির মধ্যে হয়তো ৩০০ জনের ছেলে-মেয়েই বিভিন্ন দেশের নাগরিক হয়ে গেছেন। অনেক সচিব, উপসচিব, পুলিশ, র্যাব, আর্মির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ছেলেমেদেরও একই অবস্থা। তিনি বলেন, বাংলাকে প্রথম ভাষা মনে করতে হবে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।