অ্যাডভোকেট প্রিয়াংকা মজুমদার

কপিরাইট আইনের সুফল ও আইনী প্রতিকার

প্রিয়াংকা মজুমদার: বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির আরেক প্রকার হলো কপিরাইট।  আপনি যখন নিজে কোন সাহিত্য , সংগীত রচনা, পেইন্টিং, ফটোগ্রাফি কিংবা আর্টিস্টিক কাজ করবেন তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই কাজের কপিরাইট ওনার আপনি হয়ে যাবেন। কপিরাইট সাধারণত কন্টেন্ট ক্রিয়েটর বা উদ্ভাবকদের সুরক্ষার কাজ করে৷ কেন কন্টেন্ট ক্রিয়েটর বা  উদ্ভাবকদের কপিরাইট সুরক্ষার প্রয়োজন তার একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই।
ধরুন, একজন লেখক যিনি তার জীবনের একটা বিরাট অংশ বই লেখায় কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি চাইবেন তার বই বাজারে প্রচুর বিক্রি হোক, তার জনপ্রিয়তা হোক এবং তিনি সেই বই থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করবেন। সেই লেখক নিশ্চয়ই এটি চাইবেন না তার বইয়ের কন্টেন্ট কেউ নকল করে নিজের নামে চালিয়ে দিক। এটি যদি হয়ে থাকে তাহলে লেখক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তার সুনাম নস্ট হবে, তার সমস্ত পরিশ্রম ব্যার্থ হবে। আর এ সমস্যার সমাধান দিচ্ছে কপিরাইট। এবার জেনে নেই কপিরাইট কি।
কপিরাইট কিঃ
যেকোন সৃষ্টিশীল কাজের জন্য সেই কাজ সৃষ্টিকারীর যে একচ্ছত্র অধিকার জন্মে তাকে কপিরাইট বলে। Copyright  শব্দটিকে ভাঙলে দাঁড়ায় Copy এবং Right অর্থাৎ  Copy করার অধিকার। কপিরাইট মানে কোন কিছুকে কপি করা। নিজের চিন্তা, বুদ্ধি ও মনন থেকে সৃষ্ট যেকোন ধরনের সৃষ্টিকর্ম যেমনঃ সিনেমা, সংগীত, ফটোগ্রাফ, সফটওয়্যার, পেইন্টিং, সাহিত্য  ইত্যাদি কাজের আসল মালিকের অনুমতি ব্যাতিত এসব কাজের কপি করা যাবে না। করলে সেটা হবে কপিরাইট এর লংঘন। কপিরাইটের আওতাধীন সৃষ্টিকর্মগুলো হচ্ছে উপন্যাস, কবিতা, নাটক, ডাটাবেজ, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, সাহিত্য, স্থাপত্য,ভাস্কর্য,  সংগীত, কোরিওগ্রাফি, পেইন্টিং, এবং বিজ্ঞাপন ইত্যাদি। মূল মালিকের অনুমতি ব্যাতিত এসব কাজ হুবহু কপি করা যাবেনা।
কপিরাইট আইনঃ
কপিরাইট আইন সর্বপ্রথম ১৭০৯ সালে ইংল্যান্ডে তৈরি হয়। বাংলাদেশে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের ১৯৬২ সালের কপিরাইট আইন টি ‘বাংলাদেশ কপিরাইট আইন,১৯৭৪’ হিসেবে প্রচলিত ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশে ‘কপিরাইট আইন ২০০০’ প্রচলিত রয়েছে।
কপিরাইট আইনের সুফল
১) কপিরাইট আইন থাকার ফলে শিল্পী ও সৃষ্টিকারীদের সৃষ্টির সাথে ব্যবহারকারীর একটা ভারসাম্য প্রতিস্থাপিত হয়। এ আইন  শিল্পী ও সৃষ্টিকারীদের এমন এক একচ্ছত্র অধিকার দেয় যার ফলে ব্যবহারকারী তাদের অনুমতি ব্যাতিত সেটা কপি করতে পারেনা।
২) সৃষ্টিশীল মানুষের সৃষ্টিকর্ম এবং আইডিয়া কেউ অবৈধভাবে  পুনঃমুদ্রণ, চুরি বা পরিবর্তন হওয়া থেকে এ আইন সুরক্ষা দেয়।
৩) আর্টিস্টিক কাজ এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে কপিরাইট আইন সুরক্ষা দেয়।
৪) শিল্পী ও সৃষ্টিকারীদের কাজ কেউ কপি করতে পারবে না কপিরাইট আইনের মাধ্যমে এই নিশ্চয়তা থাকে বলে তারা নিশ্চিন্তে সংস্কৃতি ও জ্ঞান, বিজ্ঞানের উন্নয়নে কাজ করতে পারেন।
৫) সৃজনশীল কাজের বিকাশ ঘটে ফলে সমাজের উন্নয়ন সাধিত হয়।
৬) শিল্পী ও লেখকবৃন্দ তাদের কাজের মূল্যায়ন পান, সম্মানী নিশ্চিত হয় যা তাদেরকে আরো ভালো কাজে উৎসাহ যোগায়।
৭) আন্তর্জাতিক কপিরাইট আইনের ফলে এক দেশের সৃষ্টিকর্ম আরেকদেশে নিরাপত্তা পায়।
কপিরাইটের মেয়াদঃ
বাংলাদেশ কপিরাইট আইন, ২০০০’ এর ২৪ ধারা অনুযায়ী,  ফটোগ্রাফ ছাড়া অন্যান্য কাজ যেমন  সাহিত্য, নাটক, সংগীত বা শিল্পক্ষেত্রে কপিরাইটের মেয়াদ প্রণেতার জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর ৬০ বছর পর্যন্ত।
২৮ ধারা অনুযায়ী ফটোগ্রাফের ক্ষেত্রে কপিরাইট মেয়াদ যে বছর ফটোগ্রাফ টি প্রকাশিত হয়েছে তার পরবর্তী বছর থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত।
প্রতিকারঃ
কপিরাইট লংঘনের দেওয়ানী ও ফৌজদারি প্রতিকার রয়েছে।ফৌজদারী বিচার হবে দায়রা জজ আদালতে। দেওয়ানী আদালতে ক্ষতিপূরণ ও নিষেধাজ্ঞার প্রতিকার চাওয়া যাবে।
চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে কপিরাইট লংঘনের শাস্তি সর্বোচ্চ পাঁচ বছর মেয়াদের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা জরিমানা। চলচ্চিত্র ছাড়া অন্য কাজের কপিরাইট লংঘনের শাস্তি হিসেবে কপিরাইট ভঙ্গকারীর অনুর্ধ্ব চার বছরের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ২ লক্ষ টাকা ও সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে। (ধারা- ৮২)
যেসব কাজ করলে কপিরাইট লংঘন হবে নাঃ
গবেষণার জন্য ব্যক্তিগত অধ্যয়ন,  বিচারিক কার্যধারার রিপোর্টের উদ্দেশ্যে সাহিত্য, নাটক, সংগীত, ও শিল্পকর্ম পুনরুৎপাদন, শিক্ষক বা ছাত্র কতৃক শিক্ষাদান প্রক্রিয়া, কোন অপেশাদার ক্লাব বা সমিতি অথবা কোন ধর্মীয়,  দাতব্য, বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপকারে উপস্থাপন করা হয় এমন কোন সাহিত্য, নাটক বা সংগীতের পুনরুৎপাদন ইত্যাদি। (ধারা-৭২)
সবশেষে বলবো,  বর্তমান বাজারে বড় বড় লেখকদের বই থেকে শুরু করে দেশী-বিদেশী চলচ্চিত্র, গান ও কম্পিউটার সফটওয়্যার সবটাই কপিবাজ বা পাইরেসির দখলে।  আমরা অনেকেই বুঝি না কোনটি আসল। একটু স্মরণ করে দেখবেন, যখন সিডি প্লেয়ারের সোনালী দিন ছিল তখন বাংলাদেশের শিল্পীরা প্রায়ই ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলতেন নকল সিডি না কিনতে। আসল সিডির যায়গায় নকল সিডি কেনা হলে শিল্পী রা যোগ্য সম্মানী থেকে বঞ্চিত হতেন। যদি ও এখন সিডির বাজার নেই তবে বইয়ের ক্ষেত্রে ও তাই হয়। প্রকৃত লেখক রয়্যালিটি থেকে বঞ্চিত হন, পাঠক বঞ্চিত হন প্রকৃত জ্ঞান থেকে৷ এর ফলে সরকার হারায় তার রাজস্ব। তাই পাইরেসির বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
লেখক- আইনজীবী, জজ কোর্ট, ফেনী।