মো. শের-ই-আলম, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক

করোনাকালীন শ্রমিক ছাঁটাইকরণ : শ্রম আইন পর্যালোচনা

মো. শের-ই-আলম :

শ্রমিক ছাঁটাই নিঃসন্দেহে অমানবিক তবে আইনবিরোধী কি? করোনা মহামারীর এই ক্রান্তিলগ্নে সারা পৃথিবীতেই বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নিয়মিতভাবে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের খবর আসছে। শুধু এপ্রিল মাসেই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে চাকুরীচ্যুত হয়েছেন ৩ লাখ ৯৭ হাজার মানুষ (দৈনিক বনিকবার্তা-১০ জুন)। বাংলাদেশেও এর ঢেউ যেন আছড়ে পড়ছে। বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক গত ৪ জুন থেকে পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেন যা দেশের ৪৫ লক্ষ (শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট-২০১৯ অনুযায়ী) পোশাক শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের মাঝে অসন্তোষ তৈরী করে।

সর্ববৃহৎ এই খাতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ৩৪.১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার৷ (শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট-২০১৯ অনুযায়ী)। শ্রমিক ছাঁটাইয়ে মালিকপক্ষের যুক্তি হলো ‘অর্ডার হ্রাসের কারণে এবং শ্রম আইন অনুযায়ী এই ঘোষণা’। এই অসন্তুষ্টির বিষয়টি মাথায় রেখে শ্রমিক ছাঁটাই এবং কারখানা লে-অফ (সাময়িক বন্ধ) না করতে পোশাক শিল্প মালিকদের চিঠি দিয়েছে শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই)। যদিও ঈদের আগেই ৬৭টি কারখানায় প্রায় ১৭ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছিল (দৈনিক প্রথম আলো, ৮ জুন)। করোনার এই পরিস্থিতিতে সরকার শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের জন্য ৫০০০ কোটি টাকা সহজ সুদে (শতকরা ২ ভাগ) ঋণ দিলেও তা সাময়িক সমাধান ছিল বলে ভাবছে মালিকপক্ষ।

এবার আসি আইনের প্রসঙ্গে। শ্রমিক ছাঁটাই মালিকের আইনগত অধিকার কি? উত্তর হলো হ্যাঁ। কেননা ৩৫৪ ধারা সংবলিত বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এ বিষয়টির বৈধতা দেয়া হয়েছে।
ছাঁটাই হলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত শ্রমিকের চাকুরীচ্যুতি-ধারা ২(১১)। এই আইন অনুযায়ী ছাঁটাই দু’ভাবে হতে পারে। সরাসরি এবং ‘লে-অফ’কে (মালিক কর্তৃক শক্তি, কাঁচামাল কিংবা যন্ত্রের অভাবে সাময়িক কর্মবিরতি) ছাঁটাইয়ে রূপান্তর করে। শ্রমিক অসদাচরণ বা অপরাধ করলে মালিক কর্তৃক বরখাস্তে (Dismissal) বা শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতার কারণে চাকুরীচ্যুতি (Discharge) এর চেয়ে ছাটাইকরণে মালিককে কম ঝামেলা পোহাতে হয়। কেননা ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে বিধান Dismissal ও Discharge এর চেয়ে কম জটিলতর।

কোন শ্রমিককে সরাসরি ছাঁটাই করতে হলে শ্রমিককে ১ মাসের নোটিশ (যদি শ্রমিকের চাকুরির মেয়াদ ১ বছরের বেশি হয়) সহ যত বছর চাকুরী করেছে তত মাসের মজুরি দিতে হবে। যেমন চাকুরী মেয়াদ ৫ বছর হলে ৫ মাস। আর নোটিশ না দিলে আরো এক মাসের মজুরী যোগ হবে। ৩০ ধারা অনুযায়ী ছাঁটাইয়ের সকল প্রাপ্য ৩০ দিনের মধ্য শ্রমিককে বুঝিয়ে দিতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো, কনিষ্ঠ শ্রমিকদের আগে ছাঁটাই করতে হবে। ৫ জনের মধ্যে ২ জনকে চাকুরীচ্যুত করতে হলে শেষ নিযুক্ত ২ জনকে আগে ছাঁটাই করতে হবে৷

বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ এর বিধি ২৭ অনুযায়ী নোটিশে প্রতিষ্ঠানের নাম; শ্রমিকের নাম, পদবি ও কার্ড নম্বর; ছাঁটাইয়ের কারণ ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ থাকতে হবে।
এবার আসি লে-অফ প্রসঙ্গে। ১৬ ধারা অনু্যায়ী প্রথম ৪৫ দিন লে অফ করলে একজন শ্রমিক মোট মূল বেতন+মহার্ঘভাতা+এড হক মজুরীর (যদি থাকে) অর্ধেক পাবে কিন্তু আবাসিক ভাতা পুরোপুরি পাবে। যেমন, কোন শ্রমিকের মূল বেতন ৪০০০ টাকা, মহার্ঘভাতা ৪০০ এবং আবাসিক ভাড়া ২০০০ হলে প্রথম ৪৫ দিনের জন্য পাবে (২০০০+২০০+২০০০) মোট ৪২০০ টাকা। আর ৪৫ দিনের বেশি লে অফ করতে হলে প্রতি ১৫ দিনের জন্য মোট মূল বেতন+মহার্ঘভাতা+এড হক মজুরীর (যদি থাকে) এক চতুর্থাংশ পাবে কিন্তু আবাসিক ভাতা পুরোপুরি পাবে। লে অফ কে মালিকপক্ষ পরবর্তীতে ছাঁটাইয়ে রূপান্তর করতে পারে। আর ছাঁটাইয়ের ক্ষতিপূরণ তো আগেই উল্লেখ করেছি।

তবে ১৮ ধারা অনুযায়ী শ্রমিক মালিকের কিছু দিক নির্দেশনা অমান্য করলে (যেমন, প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন হাজিরা দিতে অমান্য করলে) লেঅফের ক্ষতিপূরণ পাবেনা। আরেকটি বিষয়। ২৮ক ধারা অনুযায়ী, আকষ্মিক প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা মানুষের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত বিপর্যয়ে (এক্ষেত্রে করোনা মহামারীকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে) কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ হলে সেই ক্ষেত্রে মালিক ও শ্রমিকের সম্পর্ক, সরকার বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ এর বিধি ৩২ অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কার্যক্রম (৩) তিন কর্মদিবসের মধ্যে নির্ধারিত ফরম-১০ অনুযায়ী সকল তথ্য জানিয়ে মালিক শ্রমিকদেরকে ছাঁটাই করবে।

ছাঁটাইয়ের পর একজন শ্রমিকের পাওনা সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকলে ৩৩ ধারা অনুযায়ী তিনি অভিযোগপত্র ডাকে বা হাতে হাতে মালিককে প্রদান করবেন। মালিক তার ৩০ দিনের মধ্য সমাধান না করলে শ্রমিক আরো ৩০ দিনের মধ্য শ্রম আদালতে আর্জি দায়ের করতে পারবে। ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে সর্বমোট ৭টি শ্রম আদালতের কার্যক্রম পরিচালিত হয়৷ শ্রম আদালতের মামলা দেওয়ানী মোকদ্দমা বলে গণ্য হবে এবং এর কোর্ট ফি নেই। এই আদালত দেওয়ানী বৈশিষ্ট্যের হবার কারণে সাক্ষ্যগ্রহণ, কমিশন, দলিল হাজির কিংবা সিদ্ধান্ত সবগুলো পদ্ধতিই দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ অনুযায়ী পরিচালিত হবে (ধারা-২১৬)।

২১৮ ধারা অনুয়ায়ী মোকদ্দমা চলাকালীন শ্রমিকের চাকুরীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। শ্রমিক মোকদ্দমাতে জয়ী হলে তার পাওনা ৩২৯ ধারা অনুয়ায়ী সরকারী দাবী হিসেবে গণ্য হবে এবং দেনাদারের সম্পত্তি ক্রোক ও বিক্রি করে আদালত আদায় করতে পারবেন। শ্রম আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ পক্ষ ৩০ দিনের মধ্যে ১৩৫ ধারা অনুযায়ী শ্রম আপিল ট্রাইবুনালে আবেদন করতে পারবে কিছু বিধিনিষেধ সাপেক্ষে। এছাড়াও ২১০ ধারা অনুযায়ী একজন শ্রমিকের CBA এর ভূমিকাতে Conciliation ও Arbitration এর মাধ্যমে শ্রম আদালত পর্যন্ত যাওয়ার সুবিধা রয়েছে। এটি একটি win win অর্থাৎ বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR)। দীর্ঘ বলে বিষয়টি উল্লেখ করা হলোনা।

শ্রমিকের জীবন যাত্রার বিষয়টি আই এল ও কনভেনশন অনুযায়ী পরিচালিত হলেও এবং ছাঁটাই অমানবিক হলেও ছাঁটাই বাংলাদেশ কিংবা পৃথিবীর কোন পুঁজিবাদী রাষ্টেই অবৈধ নয়। কেননা  মানুষের অর্থনৈতিক মানবাধিকারগুলো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো মেনে চলতে বাধ্য নয়।
তাই, প্রত্যাশা হলো চাকুরীচ্যুতি হলেও একজন শ্রমিক যেন তার আইন প্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন।

মো. শের-ই-আলম : সহকারী অধ্যাপক, আইন ও বিচার বিভাগ, মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।