অ্যাডভোকেট কুমার দেবুল দে

সমাজে আইন শৃংখলা বজায় রাখার স্বার্থে পূর্ণাঙ্গভাবে আদালত চালু করা হোক

কুমার দেবুল দে: 

বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাস সংক্রমণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রায় চারমাস ধরে সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট এবং তিন মাস ধরে দেশের সকল অধস্তন আদালতে নিয়মিত বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এমনিতেই মামলা ভারে ন্যুব্জ বিচার ব্যবস্থায় নেমে এসেছে স্থবিরতা। যদিও গত ১১ মে থেকে আদালতে ভার্চ্যুয়াল পদ্ধতিতে কার্যক্রম শুরু হয়, কিন্তু সেটাকে কোনোভাবেই নিয়মিত আদালতের বিকল্প বলা যায় না।

তবে ইতোমধ্যে ‘সীমিত আকারে’ চালু হয়েছে গার্মেন্টস শিল্প। যেখানে সরাসরি কোটি কোটি মানুষ জড়িত, সাথে জড়িত তাদের রুটি রুজিও। চলছে স্বাস্থ্য বিধি মেনে বা স্বাস্থ্য বিধি ফাঁকি দিয়ে। কারন কিছুই না, অর্থনীতি। একইভাবে কোটি মানুষের যোগাযোগের সাথে জড়িত গণপরিবহন, চলছে স্বাস্থ্য বিধি মেনে বা স্বাস্থ্য বিধি ফাঁকি দিয়ে। কারণ কিছুই না, প্রয়োজন। পাশাপাশি চলছে মিল-ফ্যাক্টরি বা অনেক কিছুই। চলছে সরকারি, বেসরকারি অফিস স্বাস্থ্য বিধি মেনে হোক বা না মেনে হোক। আসন্ন কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে হয়তো গরুর হাটও চলবে, তা স্বাস্থ্য বিধি মেনে হোক বা উপেক্ষা করেই হোক।

শুধু চলছে না রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের একটি বিচার বিভাগ। কি যুক্তি থাকতে পারে এর পক্ষে? আমার জানা নেই। আবার আইনজীবীদের নেতৃত্ব দেয়া বার সমিতিগুলোর পক্ষ থেকে নিয়মিত আদালত চালু করার কোন দাবী উত্তোলন না করাও খুবই দুঃখজনক এবং রহস্যজনক। এর একটা কারণ সম্ভবত বিচার ব্যবস্থার সাথে জড়িত উভয়পক্ষ নিজেদের জীবনকে অন্য পেশার মানুষের জীবনের তুলনায় অধিক দামী মনে করা! যা হবে ভয়াবহ অন্যায়। দয়া করে ভার্চ্যুয়াল কোর্ট এর চালু থাকাকে পূর্ণাঙ্গ বিচার বিভাগের পরিপূরক ভাববেন না কেউ। শুধুমাত্র সীমিত পরিসরে সপ্তাহের বিশেষ বিশেষ দিনে কয়েকটা জামিনের দরখাস্ত শুনলে, কয়েকটা নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত বা কয়েকটা রীট পিটিশন শুনলে যেই পরিমাণ কাজ হয়, তা নিয়মিত আদালতের কাজের তুলনায় হিসাব করলে হয়তো ১০০ ভাগের এক ভাগ হতে পারে। এই দেশে নিয়মিত আদালতে যে পরিমাণ কাজ হতো, প্রয়োজনের তুলনায় তাও অপ্রতুল ছিল। আদালত গুলোতে মামলা জট ছিল ভয়াবহ।

তাই ভার্চ্যুয়াল কোর্টকে নিয়মিত আদালতের পরিপূরক ভাবা যাবে না। একটি পাখীকে যদি বিচার বিভাগের সাথে তুলনা করি তবে ভার্চ্যুয়াল আদালত ব্যবস্থা হতে পারে তার কয়েকটি পালক মাত্র।

যদিও এই সময়ে অপরাধ হচ্ছে অহরহ এবং তার প্রেক্ষিতে মামলাও দায়ের হচ্ছে অনেক। থেমে নেই আসামী গ্রেফতারের প্রক্রিয়া, থেমে নেই অপরাধের তদন্ত, থেমে আছে শুধু বিচার (Trial)। অভিযুক্ত আসামী যাদের আদালতের প্রতি আস্থা আছে বা নিজেদেরকে নির্দোষ মনে করেন তাদের না আছে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করার সুযোগ, না আছে উচ্চ আদালতে আত্মসমর্পণ পূর্বক জামিন চাওয়ার সুযোগ। আসামীদের যেমন রয়েছে ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার তেমনি মামলা দায়েরকারী ব্যক্তিরও রয়েছে ফেয়ার ট্রায়াল (ন্যায় বিচার) পাওয়ার অধিকার, বিচারকার্য বন্ধ থাকার ফলে দু’পক্ষই তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আইনজীবীরা বঞ্চিত হচ্ছে এই দুইপক্ষকে আদালতে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থেকে, ফলাফল প্রায় চারমাস ধরে আয় রোজগার বিহীন।

আদালতে যদি বিচার বন্ধ থাকে বা অনির্দিষ্টকালের জন্য বিচারকাজ যদি স্থগিত থাকে তবে অপরাধীদের অপরাধ করার প্রবণতা যেমন বেড়ে যায়, তেমনি বেড়ে যায় আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা। যার ফলাফল হিসেবে দেখা যায় সমাজে আইন শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি। যা কারও জন্য সুখকর নয়। কাজেই শীঘ্রই স্বাস্থ্যবিধি মানার দোহাই দিয়ে হলেও আদালত খুলে দেয়া হোক, মানুষকে বিচার পাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হোক এবং আইনজীবীদের দেয়া হোক কাজের সুযোগ।

লেখক: অ্যাডভোকেট এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক কার্যনির্বাহী সদস্য।