মো. জিয়াউর রহমান: চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মাগুরা।

নারীর সম্মতি ছাড়া শারীরিক সম্পর্কই ধর্ষণ

মো. জিয়াউর রহমান: ‘All Is Well’ সব কিছু ঠিক আছে! একটা জার্মান মুভি। এ মুভিতে ধুমধারাক্কা মারধর নেই, রগরগে রোমান্স নেই, সাসপেন্স নেই। সাদামাটা ভাবে ছবির গল্প এগিয়ে চলে। ছবির নায়িকা একরাতে তার পরিচিত ব্যক্তির দ্বারা ইচ্ছে না থাকা স্বত্বেও ধর্ষিত হয়। মেয়েটা এর জন্য প্রতিবাদ করেনি, পুলিশকে জানায়নি, মামলা করেনি। সব কিছু স্বাভাবিক- এমন ভাবেই তার জীবন চলতে থাকে। বাইরে ‘সব কিছু ঠিক আছে’ এই ক্যামোফ্লাজ নিয়ে চললেও ভেতরে ভেতরে আসলে মেয়েটি ক্ষয়ে যাচ্ছিল। বাস্তবে সে ছিল ট্রমাটাইজ। মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও মেনে নেওয়ার প্রচেষ্টায় সে মানসিক ভাবে অসুস্থ জীবন যাপন করতে থাকে।

ছবির এই কাহিনী বিদেশী পটভূমিতে লেখা হলেও অদ্ভুত ভাবে আমাদের সমাজের সাথে মিলে যায়। মেনে নিয়ে চলার শিক্ষা আমরা ছোট বেলা হতে মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেই। স্কুলে যাওয়ার পথে কোন মেয়ে যদি ইভটিজিং এর শিকার হয়, বাসায় মা বাবা বা ভাইবোন বা কোন শিক্ষককে বলতে সে ভয় পায়। আর বললেই কি হয়! সাহস করে বললেও ফলাফল একই, মেয়েটাকেই মেনে নিয়ে চলতে বলা হয়। সে তো খবর দেখে বুঝতে পারে, ইভটিজিং এর প্রতিবাদ করলে তার মুখ এসিডে ঝলছে যেতে পারে, সে নিজে ধর্ষিতা হতে পারে, এমন কি খুনের শিকার হতে পারে। সুতরাং সে এই চাপিয়ে দেওয়া সামাজিক অনাচার মেনে নেয় বা তাকে মেনে নিতে হয়। এই মেনে নেওয়া তার স্বাভাবিক বিকাশে বাঁধা হয়ে থাকে। তার ব্যক্তিত্ব পরাধীনতার শৃংখলে বন্দীত্ব বরণ করে।

অপরাধপ্রবণ আমাদের এই সমাজে ধর্ষণ ছিল এবং বহাল তবিয়তে আছে। কেউ ধর্ষণের শিকার হলে এ অন্ধ সমাজ ধর্ষকের বিচার করতে পারুক, না পারুক- ধর্ষিতার বিচার কিন্তু শতভাগ নিশ্চিত করে। ধর্ষিতার কপালে ঘটনার সাথে সাথে কলঙ্কের টিপ পরিয়ে দেওয়া হয়। ধর্ষিতা অপরাধের শিকার মাত্র, তাতে তার দোষ নেই- এটা আমরা ভাবতে শিখিনি। ধর্ষিতা পড়তে যেতে পারে না, সবাই তার দিকে অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তার ভাল কোন চাকরি হয় না, বিয়ে হয় না, কত কী! তাই কেউ ধর্ষিতা হলে ধর্ষক শুধু তার সম্ভ্রমই হরণ করে না, সাথে সাথে তার বেঁচে থাকার অধিকারও কেড়ে নেয়। এ কারণে মাঝে মাঝে পত্রিকার পাতায় দেখি, নিরুপায় ধর্ষিতা আত্মহত্যা করেছে।

আমাদের বিচার ব্যবস্থা ফুটবল খেলার মত। যে পক্ষ গোল করবে, সে জিতবে। বিচারক রেফরির মত, নিজে খেলে না, বাঁশি বাজিয়ে কোন পক্ষকে জয়ী ঘোষণা করে। এই অ্যাডভারসিয়াল সিস্টেম (Adversarial System) এ বিচারে চূড়ান্ত দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত আসামীকে নির্দোষ ভাবা হয়। আর প্রমাণের ভার নালিশকারী/রাষ্ট্রপক্ষের উপর। বিচারের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বেশীরভাগ ক্ষেত্রে হতাশাগ্রাস করায় একপর্যায়ে আদালতের বাইরে আপোষ হয়ে যায়। আপোষ ছাড়াও সাক্ষীর অভাব এত অধিক পরিমান খালাসের কারণ মনে হয়। আরেকটি কারণ বোধ করি, মিথ্যা মামলা। মিথ্যা মামলার জঞ্জালে সত্য মামলাগুলোও এক সময় হারিয়ে যায়। একটা পরিসংখ্যান অনুযায়ী নারী ও নির্যাতন সংক্রান্ত মামলায় শতকরা ৫% শাস্তি হয় অর্থাৎ ১০০ টা মামলায় ৫ টা মামলায় অপরাধী দোষী সাব্যস্ত হয়।

‘Unbelievable’ ছবিটা আমেরিকার কলোরাডো রাজ্যের সত্য ঘটনা অবলম্বনে। একজন তরুণী (তার নাম ম্যারি) শেষ রাতে যখন গভীর ঘুমে, তখন মুখোশ পরা কেউ একজন তার গৃহে প্রবেশ করে অস্ত্রের মুখে রেইপ করে। ঘটনার পর সে ৯১১ এ ফোন করে। প্রথমে পেট্রোল পুলিশ আসে। তারা মেয়েটার কথা শোনে। তারপর ডিটেকটিভ টিম আসে, তারা আবার শুরু হতে শুনতে চায়। তাদেরকে সে একই ঘটনা বলে। পুলিশ Crime Scene হতে বিভিন্ন কিছু সংগ্রহ করে। ম্যারিয়ার মেডিকেল টেস্ট হয়। সেখানেও তার কাছ হতে ডাক্তার ঘটনা জানতে চায়। তদন্ত চলাকালে পালক মা পুলিশকে বলে, মেয়েটা ছোট বেলা হতে আচরণে কিছুটা অস্বাভাবিক। এদিকে সংগৃহীত আলামত হতে কোন প্রমান মেলে না। পুলিশ মেয়েটাকে ডেকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করে। ছোট মেয়ে, আর চাপ নিতে পারে না। সে বলে বসে, সে রেইপই হয়নি, তার অভিযোগ make out. মিডিয়া জেনে যায়। কমিউনিটি তাকে অবিশ্বাস করতে থাকে। ধর্ষিত হয়ে মেয়েটা প্রমানের অভাবে সবার কাছে নিগৃহীত হতে থাকে। মেয়েটির বিরুদ্ধে যখন False Accusation এর চার্জ আনা হচ্ছে তখন দেখা যায়, শহরের অন্যত্রও ২/৩ টি একই প্যাটার্ন এর Rape Incident হয়েছে- সব ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত মুখে মাস্ক ও হাতে গাল্ভস পরা ছিল।

ম্যারির অভিযোগ সত্য থাকলেও কেউ তাকে বিশ্বাস করেনি, বরং তাকেই আইনী ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। এই একই গল্পের পুনরাবৃত্তি তো আমাদের এখানেও হরহামেশাই ঘটে। কোন মেয়ে ধর্ষিত হলে তাকে ঘটনার পুনঃপুনঃ বিবরন দিতে হয় পুলিশের কাছে, ডাক্তারের কাছে, ম্যাজিস্ট্রেট এর কাছে। ডাক্তারী পরীক্ষার নামে আরেকটি রোমহষর্ক পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে ভিকটিম কে যেতে হয়। কোর্টে যখন মামলা শুরু হয়, দিনের পর দিন কোর্টের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে বিচার চাওয়ার ইচ্ছেটা একসময় মরে যায়। সবার সামনে লয়ারের জেরায় তাকে আবারও কঠিন পরিস্থিতি face করতে হয়। এ ধরনের মামলায় camera trial হওয়ার বিধান থাকলেও কম ক্ষেত্রে তা পালিত হয়।

আইনী ত্রুটির কারণেই ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত ও ধর্ষিতাকে জাপানী সুমো কুস্তির চরিত্রের মত বিবেচনা করা হয়। আইনজীবী, বিচারক, চিকিৎসক সবাই খোঁজে ভিকটিমের শরীরে Violence Marks আছে কি না? অর্থাৎ জোড়াজুড়ি করলে শরীরে কামড়ের, আঁচড়ের বা কালশিটে কোন না কোন দাগ থাকবে। Resist না করলেই আত্মসমর্পণ বা সম্মতি ছিল দাবী করা হয়।

এই তো কয়েকমাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী কুর্মিটোলা এলাকায় এক ভবঘুরে যুবক কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এমন প্রশ্নই উত্থাপিত হয়েছিল। ডিএনএ সহ সব প্রমানাদি থাকা স্বত্বেও নেটিজেনরা বিশ্বাস করতে চায়নি ঐ যুবক এমন কান্ড ঘটিয়েছে। কেননা ভগ্নস্বাস্থ্য নেশাখোর যুবকটিকে তাদের কাছে যোগ্য কুস্তিগীর মনে হয়নি। এ সমাজের প্রতিকূল সব পরিস্থিতি কে জয় করে কেউ যদি কোর্টে ধর্ষণের অভিযোগে সাক্ষ্য দেয়, উচ্চ আদালত সেই সাক্ষীকে বিশ্বাস করার কথা বললেও বিচারে এমনটা কমই গ্রহণ করা হয়। বরং কোর্টে ভিকটিমের চরিত্র নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলে। আইনই এমন ভিকটিমের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার ক্ষমতা দিয়েছে। একজন মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের সম্মান (Dignity) রক্ষার অধিকার আছে, গোপনীয়তার অধিকার আছে। এই অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক এই অবমাননাকর আইনী ধারার আশু পরিসমাপ্তি দরকার।

ভারতে নির্ভয়া ঘটনার পর ওরা ওদের আইনের খোলনলচে পাল্টে ফেলেছে। এখনকার আইন মতে, কোন ধর্ষণ মামলা হলে আসামি ঘটনা ঘটিয়েছে বলে কোর্ট presume করতে পারবে। আরেকটি মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা হলো, ভিকটিমের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। ভারতে অপরাধ প্রমাণ হোক বা না হোক, ভিকটিম ক্ষতিপূরণ পায়। নির্ভয়ার জীবনের বিনিময়ে এই আইনী পরিবর্তনে সুফল ভারতীয় নারীরা এখন ভোগ করছে।

আমাদের সমাজ ও আইন একসাথে গলাগলি ধরে নারীকে সন্দেহের চোখে দেখছে। নারী ছেলেবন্ধুর সাথে আড্ডা দেয়, সোজা কথা, সে খারাপ। নারী ছেলেবন্ধুর সাথে রেস্টুরেন্টে গেছে, সরল অংক, সে খারাপ। কি শিক্ষিত, কি অশিক্ষিত নির্বিশেষে বেশীরভাগ অংশ এমন ভাবেই ভাবছে। ভারতীয় ‘Pink’ মুভিটি বিচার সংশ্লিষ্ট সব লয়ার, জাজদের দেখা উচিত। মুভিটির মূল বিষয় Consent. বন্ধুদের সাথে কোথাও বেড়াতে গেলে, খেতে গেলে সে মেয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের লাইসেন্স দিয়েছে এমনটা ভীষণ ভুল। নারী হেসে কথা বললে, একসাথে গল্প করলে তার সাথে সেক্স করার পারমিশন দেয়া হয়ে যায় না। সমাজে নারীকে সম্মানের চোখে না দেখাই এমন স্থুল ভাবনার কারন।
আমাদের দেশেও এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর ছেলের বিরুদ্ধে বার্থডে পার্টতে এক তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। মনে পড়ে, তখন সেই ছেলে ও তার বাবাও মেয়েটির বিরুদ্ধে এমন দাবীই করেছিল। আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে, Consent বা সম্মতি মানে স্বাধীন সম্মতি, কোনরুপ ভয়, জোর বা জবরদস্তিতে নয়। আর সম্মতি শুধু স্বাধীন নয়, স্বতঃস্ফূর্তও হতে হবে। No means NO. মাঝে কোন দ্ব্যর্থবোধকতা বা অস্পষ্টতা নেই। নারীর প্রতি পাশবিকতা সংক্রান্ত আমাদের আইনেও ভারতীয়দের মতই পরিবর্তন জরুরী। চরিত্র ফুলের মত হলেও সে ধর্ষণের বিচার পেতে পারে, চরিত্র কালির মত হলেও সেও বিচার পেতে পারে। তাই চরিত্র নয়, বিচার্ষ বিষয় হলো consent বা সম্মতি। কোন পতিতাও যদি সম্মতি না দেয়, তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক চোখ বুজে রেইপ। আবার সম্মতি দিলেই হবে না, সম্মতি দেওয়ার যোগ্যতাও থাকতে হবে। কেউ মাদক নিয়ে নিজের মানসিক ও শারীরিক নিয়ন্ত্রণহীন থাকা অবস্থায় প্রদত্ত সম্মতি নিশ্চয়ই সম্মতি নয়। আমাদের আইনে ১৬ বছরের নিচের কোন মেয়ের সম্মতিও আইনের দৃষ্টিতে সম্মতি নয়। একইভাবে ভয়, ভীতি, লোভ, প্রতারণার কারণে দেয়া সম্মতিও সম্মতি নয়। সোজা ভাবে যদি বলি, তাহলে বলা যায়, নারীর সম্মতির অনুপস্থিতিতে যে কোন শারীরিক সম্পর্কই রেইপ।

রেইপ হত্যার চেয়ে ছোট কোন অপরাধ নয়। হত্যাতে Right to life কেড়ে নেওয়া হয়, রেইপ এ তার চেয়ে বেশী Right to life, liberty & security, Right to dignity, Right to privacy হরণ করা হয়। একটা রেইপ একজন নারীর মানবিক স্বত্বা বা অস্তিত্ব কে অস্বীকার করে। রেইপ নারীর জীবনে নেমে আসা এমন একটি ঘটনা যা কোনভাবে Compensate করা যায় না। এমন বর্বরতা যারা করে, তাদেরকে দ্রুত শাস্তি আরোপে রাষ্ট্র কে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, আর তার আগে এই পক্ষপাতী সমাজকে শোধরাতে হবে। নইলে অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে আমরা হয়তো উন্নত হবো, কিন্তু পবিত্র সংবিধান ঘোষিত সামাজিক ন্যায়বিচার আমাদের আরাধ্যই থাকবে।

মো. জিয়াউর রহমান: চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মাগুরা।