অ্যাডভোকেট সাব্বির এ মুকীম

চেকের মামলায় চুক্তি-সংক্রান্ত প্রমাণের দায়িত্ব অভিযুক্তের

সাব্বির এ মুকীম: ফৌজদারি মামলায় সাধারণ নীতি হলো ঘটনা প্রমাণের দায়িত্ব অভিযুক্তের নয়, ঘটনা প্রমাণের দায়িত্ব ফরিয়াদীর। কিন্তু এনআই অ্যাক্ট ১৮৮১ এর আওতায় চেক এর মামলার ক্ষেত্রে একটু ব্যাতিক্রম নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে। নীতিটি আইনে আগেই ছিলো কিন্তু মহামান্য আপিল বিভাগের বহুল প্রচারিত মোঃ আবুল কাহার শাহিন বনাম ইমরান রশিদ গং মামলায় বিম্মৃত প্রায় এই ব্যাতিক্রমটি পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। আর সেই নীতিরই প্রয়োগ করে বিগত ২২/০৬/২০২০ ইং তারিখে মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপিত জাফর আহমেদ এর একক বেঞ্চ আপিলেট ডিভিশনের সেই সিদ্ধান্তের আলোকে মোঃ এরশাদ আলী ওরফে মোঃ এরশাদ উল্লাহ বনাম রাষ্ট্র গং নামীয় ২০২০ ইং সনের ১৫৩৫নং এবং ১৫৩৬ নং ফৌজদারি আপিল দুটিতে রায় প্রদান করেন। হাইকোর্ট ডিভিশনের সেই রায়েই চমৎকারভাবে এনআই অ্যাক্ট এর ব্যাতিক্রমী ফৌজদারি নীতিটি উল্লেখ করেন, এভাবে “Section 118 of the N. I. Act is an example of a reverse onus clause”(সুপ্রীম কোর্টের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত আলোচ্য রায়ের পিডিএফ কপির ১৪ পাতা হতে উদ্ধৃত}

এই Reverse Onus মানে কী? “Onus of Burden of Proof lies on complainant” এই নীতির উল্টোটা মানে “Burden of proof lies on Accused” নীতিই Reverse Onus নীতি।

এনআই অ্যাক্টে চেকের মামলায় একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হলো কনসিডারেশন, যা আইনের ৪৩ ধারায় বলা আছে। যেখানেই কনসিডারেশন, সেখানেই ধরে নিতে হবে চুক্তি আছে। আর এখানেই Reverse Onus নীতির অবতারণ শুরু হয়। আলোচ্য আইনেরর ১১৮ ধারায় ধরেই নেয়া হয় চেক দেয়া হয়েছে মানেই কনসিডারেশন বিনিময় হয়েছে এবং কনসিডারেশন বিনিময় হয়েছে মানেই চুক্তি ছিলো। সাধারণ চুক্তি সংক্রান্ত বিরোধের ক্ষেত্রে কোনো চেক প্রাসংগিক হলে ” Onus of Burden of Proof lies on complainant” নীতি মোতাবেক ফরিয়াদীর ই দায়িত্ব থাকে এটা প্রমান করা যে, চেক আদান প্রদানে, চুক্তি ছিলো এবং সে চুক্তির কনসিডারেশন- চুক্তি মোতাবেক ই বিনিময় হয়েছে। কিন্তু এনআই এক্ট এ যেহেতু Reverse Onus নীতি কে প্রযেজ্য করা হয়েছে তাই ফরিয়াদী নয় বরং অভিযুক্তকেই চেকের মামলায় প্রমান করতে হবে যে চেক বিনিময়ে প্রেক্ষিতে কোনো চুক্তিই হয় নাই, কোনো চুক্তির অস্তিত্ব নাই অথবা চুক্তি যদিও বা থেকেও থাকে তবে সে চুক্তির কনসিডারেশন চুক্তি মোতাবেক বিনিময় হয় নাই।

আবারও লেখলাম, চেকের মামলায় Reverse Onus নীতিপ্রয়োগের ফলে অভিযুক্তরই দায়িত্ব:-

(১) চেক বিনিময়ে কোনো চুক্তি ছিলো্ না

অথবা (২) ফরিয়াদীর সাথে কোনো ধরণের চুক্তিই হয় নাই,

অথবা (৩) যদিও বা চুক্তি হয়ে থাকে, তবে ফরিয়াদী চুক্তির মোতাবেক কনসিডারেশন দেয় নাই।

যখনই অভিযুক্ত এই তিনটি উপাদানের যেকোনো একটি প্রমান করে এবং তাও প্রত্যক্ষ প্রমাণ ই কেবল নয়, আপিল বিভাগের রায় মোতাবেক এমনকী শুধু পরোক্ষ প্রমাণ বা Circumstantial evidence দিয়েও যদি প্রমাণ করে তবে কেবল এবং কেবল মাত্র তখনই প্রমাণের দায় চিরাচরিত নীতি মোতাবেক ফরিয়াদী উপর বর্তাবে। প্রমাণ নয় বরং প্রকৃতপক্ষে অভিযুক্তের প্রমাণ খন্ডন করে ফরিয়াদীকে পাল্টা প্রমাণ করে দেখাতে হবে কেবল শুধু চুক্তি ই যে ছিলো তা ই নয়, একই সাথে কনসিডারেশনও পালন করা হয়েছে।

এখানে একটি প্রণিধানযোগ্য বিষয় হলো, চুক্তি আইন অনুসারেই চুক্তি মানেই চুক্তিপত্র বা লিখিত চুক্তিনামা থাকতে হবে এমন নয়। চুক্তি মৌখিকও হতে পারে। এমনকী “Legitimate Expectation” নীতির প্রয়োগে পরোক্ষ চুক্তি ও হতে পারে। পরোক্ষ চুক্তি কি ধরণের, তার জন্য একটা উদাহরণ দেয়া যায়। ধরা যাক, জাকিরের বাসায় দবির পত্রিকা দেয়। জাকিরের বন্ধু ছবির জাকিরের নীচ তলাতেই থাকে। একদিন জাকিরের বাসায় দবিরের সাথে দেখা হওয়ায় ছবির বলে যে- “তুমি তো ভালো পেপারওয়ালা, ঠিক সকালে পেপার দাও আবার নিয়মিতও পেপার দাও। আমারে যে পেপারওয়ালা পেপার দেয় সে কোনো দিন দুপুরের আগে পেপার দিতে পারে না আর প্রায়শই মিস করে।” তখন দবির ছবিরকে বলে, “স্যার আপনি কোন পেপার পড়েন?” ছবির উত্তর দেয়।

এইটুকুই কথোপকথন হয় দবির আর ছবিরের মধ্যে। পরের মাস থেকে দবির নিজ উদ্যোগে ছবিরের বাসায় পেপার দেয়া শুরু করে। দবির নিয়মিত সময়মতো পেপার সরবরাহ করায় কয়েকদিন পরেই ছবির তার পুরোনো পেপারওয়ালাকে পেপার দিতে নিষেধ করে দেয়। এখানে দবির আর ছবিরের মধ্যে কোনো ধরণের মৌখিক বা লিখিত চুক্তি না থাকলেও তাদের পারস্পরিক ব্যবহারে আদান প্রদান এই চুক্তির প্রমাণ হয়। এই উদাহরণে উপস্থিত উপাদান গুলোকেই আলোচ্য দুটি রায়ে Inference of preponderance of probabilities হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

তাই চেকের মামলা করতে হলে চুক্তিপত্র বা কন্ট্রাক্ট ডিড বাধ্যতামূলক- এমন ধরণের কথা ঐদুটি রায়ের কোথাও বলা হয়নি, লেখা হয়নি, এমনকী এমন ধরণের বিধান প্রণয়ন করে নূন্যতম ইংগিত ও দেয়া হয়নি। চেকের মামলা করতে হলে চুক্তিপত্র বা কন্ট্রাক্ট ডিড বাধ্যতামূলক মর্মে প্রচারিত তথ্যটি তাই সম্পূর্ণ ভুল এবং কাল্পনিক এবং এক কথায় রায়ের ভুল পাঠ, রায়ের অশুদ্ধ পাঠ।

এবার আসা যাক আলোচ্য মামলায় কি হয়েছে?
অভিযুক্তের কোম্পানী (নাকী নিগম-বাংলায়??) ফরিয়াদী কোম্পানী হতে বাকীতে রড সিমেন্ট নিতো। মূল্য পরিশোধের জন্য অভিযুক্তের কোম্পানি দুটি চেক দেয় ফরিয়াদী কোম্পানী কে যা নগদায়ন করতে গেলে একটি চেক স্টপ পেমেন্টের কারনে এবং অপর চেকটি অপর্যাপ্ত তহবিল জনিত কারণে ডিজঅনার হয়। অভিযুক্তের সাজা হয় বিচার শেষে। বিচারিক আদলতের রায়ের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করে এবং হাইকোর্ট অভিযুক্ত কে Reverse Onus নীতিপ্রয়োগ করে খালাস প্রদান করে। অভিযুক্ত উপরে প্রদ্ত্ত তিনটি উপাদানের প্রথম উপাদানটি প্রমান করে , তাও কেবল সাফাই স্বাক্ষ্য দিয়ে। কোনো লিখিত চুক্তি নামা দরকার হয় নাই।

কীভাবে অভিযুক্ত Reverse Onus নীতির প্রয়োগ করালো?
অভিযুক্ত সাফাই স্বাক্ষ্যতে তার জেরায় আলোচ্য চেক নিজের চেক, চেকে স্বাক্ষর তার স্বাক্ষর, ফরিয়াদী অভিযুক্তের এজেন্টের মাধ্যমেই চেকটি পেয়েছিলো এবং ফরিয়াদীর ডিজঅনার সংক্রান্ত ডিমান্ড নোটিশ এর প্রাপ্তি ও স্বীকার করে। এ পারফেক্ট কেস ফর কনভিকশন ইন প্রেসেন্ট ট্রেন্ড।

কিন্তু সমস্য দেখা দেয় পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যে। অভিযুক্ত দাবী করে যে ফরিয়াদী ব্যবসার প্রস্তাব করলেও অভিযুক্ত কোনো লিখিত চুক্তি না থাকায় সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলো। অভিযুক্ত ব্যবসার প্রয়োজনে বিদেশ যাওয়ার দরকার পড়লে ব্যবসার সুবিধার্থে কিছু চেক অগ্রীম স্বাক্ষর করে তার এজেন্টের কাছে রেখে যেতো। সেই এজেন্ট ই ফরিয়াদী কে আলোচ্য চেক দিয়েছে। অভিযুক্তের বিনা অনুমতিতে সেই চেক দেয়ায় সেই এজেন্ট এর বিরুদ্ধে অভিযুক্ত মামলা করেছে, সে মামলায় ঐ এজেন্ট জেল হাজতে আছে। অভিযুক্তের এসব সাফাই সাক্ষ্য থেকে বিজ্ঞ আদালত সিদ্ধান্তে পৌছেন যে,

Applying the test of ‘preponderance of probability’/probable defense’, this Court is of the view that the defense has successfully rebutted the statutory presumption of consideration. Thus the onus to prove, standard ‘beyond reasonable doubt’, that the cheques were drawn for consideration, shifted to the prosecution, but it failed to discharge the onus and the foundation of the prosecution case (business transactions and passing of consideration) has fallen apart. Hence, the inevitable conclusion is that in spite of facts that the cheques in question were signed by the accused and the complainant company was the payee, those were drawn without consideration” (সুপ্রীম কোর্টের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত আলোচ্য রায়ের পিডিএফ কপির ১৭ পাতা হতে উদ্ধৃত}

অর্থাৎ অভিযুক্ত যখন দাবী করলো এবং পারিপার্শ্বিক প্রমাণ দেখালো যে কনসিডারেশন ছিলো না কারণ চুক্তি ই ছিলো না, ফরিয়াদী তখন প্রমাণ দেখাতে পারে নাই অভিযুক্তর সাথে তার চুক্তি ছিলো, কনসিডারেশনও সে দিয়েছে।

তবে এজেন্ট এর কারণে অভিযুক্ত প্রিন্সিপাল-এজেন্ট জনিত ভাইকেরিয়াস লায়াবিলিটিতে দায়বদ্ধ কীনা সে সিদ্বান্ত বিজ্ঞ আদালত অন্য কোথাও দেবেন তবে এটুকু নিশ্চিত এনআই এক্টের ৪৩ ধারা, ১১৮ ধার এবং ১৩৮ ধারায় সম্মিলিত পাঠে প্রাপ্ত দায় হতে অভিযুক্ত দায়মুক্ত।

এখান থেকে যে খবটা পাওয়া গেলো তা হলে, ফরিয়াদীর ঘাঁড়ে চুক্তি প্রমাণের দায় কেবল এবং কেবল মাত্র তখনই বর্তাবে যখন অভিযুক্ত দেখাতে পারবে হয় চুক্তি ছিলো না অথবা থাকলেও কনসিডারেশন দেয়া হয় নাই। কিন্তু এই খবরে এটা প্রকাশ পায় না যে চুক্তি প্রমাণের জন্য লিখিত চুক্তিপত্র লাগবেই বাধ্যতামূলকভাবে। আগেই বলা আছে চুক্তি হতে পারে মৌখিক অথবা হতে পারে লিখিত অথবা হতে পারে পরোক্ষও। ১১৮ ধারা মতে চেকের মামলায় ধরেই নেয়া হয় যেহেতেু চেক আছে তাই চুক্তি এবং কনসিডারেশন দুইটাই আছে। তাই চেকের মামলায় চুক্তিপত্র বাধ্যতামূলক নয়।

সাব্বির এ মুকীম: আইনজীবী; কুমিল্লা জজ কোর্ট। ই-মেইল: samukim1@gmail.com