মোঃ রায়হান আলী

ধর্ষণ বর্বরতার কারণ, আইন, সাজা ও সমাধানের উপায়!

মোঃ রায়হান আলী: প্রতিনিয়তই এখন খবরের কাগজ খুললেই করোনার আপডেটের পরেই ধর্ষণের শিরোনামটাই সবার চোখে পড়ে। কিংবা ধর্ষণের বর্বরতার বিস্তর শিরোনাম রঙ্গিন মোটা মোটা ছাপা অক্ষর কারোই চোখ এড়াবার নয়। অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে চোখ বোলালেও ধর্ষনের প্রতিকী ছবিযুক্ত এ বর্বরতার নানাবিধ খবর ভেসে বেড়ায় নেট দুনিয়ায়। এ বর্বরতার অভিশাপ আদি যুগ ধরেই বিভিন্ন ভাবে চলে আসছে। হয়ত বা আদিকালের গণমাধ্যমের এনালগ সিস্টেমের ফলে এমন বর্বরতার বহিঃপ্রকাশ এখনকার মত এত দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়তে পারতো না। বর্তমানে আধুনিক যুগের সব কিছুর আধুনিকায়নের ফলে অতি দ্রুতই সব খবরা খবর পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে নিমিষেই আদান-প্রদান সম্ভবপর হচ্ছে। একটা সময় টিভি, ভিসিআর চালানো হতো বিদ্যুতের অভাবে চার্জিত ব্যাটারী দিয়ে। দিন দিন সব কিছুর আধুনিকায়নে গণমাধ্যম তথা টিভি চ্যানেলগুলোরও আধুনিকায়ন হয়েছে। সাথে সাথে ডিশ এ্যান্টেনাসহ ফেসবুক, হোয়াটস এ্যাপ, ইমো, ভাইবার, ইউটিউবের মত সব ধরনের আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করে যাচ্ছে বর্তমানের মানুষজন। তথ্য প্রযুক্তিগত ব্যবহার অনেক সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধাও রয়েছে। মোট কথা এটাকে যে যেভাবে ব্যবহার করে সে সেভাবেই সুবিধা পায়। আধুনিক মানুষজন নেট দুনিয়ার সব কিছু হাতের নাগালে পেয়ে আধুনিক যুব সমাজসহ নানা বয়সীরাও নেটের অপব্যবহার করে নানা অপসংস্কৃতির রিহার্সাল করছে। বর্তমানে অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট ইয়াবার সেবনে বাড়ছে ধর্ষণ অপরাধ। চলমান করোনাকালীন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে লকডাউনের মধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে সম্ভব না হয়ে বেড়েছে অনিয়মিত গর্ভধারণসহ নানা যৌন অপরাধ এসব তথ্য প্রতিবেদন আকারে খবরের কাগজগুলোতে এসেছিল। সম্প্রতি ঘটে ধর্ষণের ঘটে যাওয়া পৈচাশিক ঘটনা সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারি চাঁদ কলেজ (এম সি কলেজ) এ এক নব বিবাহিতা দম্পতি কলেজের দৃষ্টিনন্দন ছাত্রাবাস এলাকায় বেড়াতে গেলে অভিযুক্ত নমরুদের দল স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। অত্যান্ত স্বাভাবিক কারনেই ওই জঘন্য বর্বরতার ঘটনা গোটা জাতিকে ঘৃণিত করেছে তথা ক্রোধের কারণ ঘটিয়েছে। এমন ঘটনা যে শুধু সিলেটের এমসি কলেজে ঘটেছে তা নয়, এর কয়েকদিন পরে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে ঘটল এক গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে তার শরীরে ওপর অমানবিক নির্যাতন। নির্যাতনের ভিডিও ধারণও করে অপরাধীরা। যদিও ঘটনাটি ঘটার ৩২ দিন পর গণমাধ্যমে ভেসে এসেছিল ভিডিও। ধর্ষণকারীরা আজ অপসংস্কৃতির ভয়াল থাবার রসানলে পড়ে প্রকৃত মানুষরুপী হৃদয়টাকে বিকিয়ে দিয়ে পশুর মত আচরণ করছে সমাজে। প্রতিদিনের ধর্ষনের সংবাদে যেন অনেকে আসক্ত হয়ে সুযোগ বুঝেই অপরাধ করে যাচ্ছে। এমন পৈচাশিক অপরাধের শাস্তির কথা একবারও চিন্তা করছে না। যেখানে গণমাধ্যমগুলোতে বিজ্ঞাপনে, নাটক, টেলিফিল্ম, ছায়াছবি, শিল্পকলা একাডেমি, চারুকলা, ললিতকলা, মিডিয়ায় নারীকে ভোগ-বিলাসের সামগ্রী কিংবা ভোগ্যপণ্য, কামনার প্রতিমা রূপে উপস্থাপন করা হচ্ছে-সেখানে ধর্ষনের অপরাধ কমে ভাল কিছু আশা করা কঠিন।

বিখ্যাত নিউরোলোজিস্ট সাইকিয়াট্রিস্ট ফ্রয়েডের মতে, মানুষ মূলত তিনটি সত্ত্বার সমন্বয়ে গঠিত। ইড, ইগো এবং সুপার ইগো। ‘ইড’ মানুষকে জৈবিক সত্ত্বার দিকে নিয়ে যায়। মানব মনের স্বভাবজাত চাহিদা পুরণে ‘ইড’ বার বার উৎসাহিত করে তোলে। সহজ করে বললে, মানুষের মন যা চায় তাই পূরণে এই ‘ইড’ কাজ করে। আর ‘ইড’ মানুষ এবং পশুর মাঝে সমানভাবে বিরাজমান। ইড-এর কোনও মানবিক দিক বা বিকাশ নেই। এর পুরোটায় মানুষ কিংবা পশুর লোভ-লালসা আর কাম চিন্তায় ভরপুর। ‘ইড’ মানুষের ভিতরের এক প্রকার সুপ্ত পশু যার প্ররোচনায় মানুষ যেকোনো অসামাজিক, অনৈতিক, অপরাধ থেকে শুরু করে খুন-ধর্ষণের মতন বর্বর কর্মকাণ্ড করতেও দ্বিধাবোধ করে না।

‘ইড’ আর ‘সুপার ইগো’র মাঝখানে বসবাস ‘ইগো’। ‘ইগো’র কাজ হচ্ছে ‘ইড’ এর কাজগুলোকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বাস্তবায়ন করা, সে দিকে মানুষকে প্ররোচিত করা। আর ‘সুপার ইগো’ হচ্ছে মানুষের বিবেক। ‘ইড’ যখন জৈবিক কামনা বাসনা পুরণ করতে উদ্দীপ্ত করে তোলে, তখন ‘সুপার ইগো’ একে বাধা দেয়। ‘সুপার ইগো’ মানুষকে সব সময় মানবিক হতে সহায়তা করে, ভাল কাজ করতে উদ্দীপ্ত করে। যদিও সুপার ইগোর প্রতি অবিচল থাকা নির্ভর করে ব্যক্তির নৈতিক, পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং সামাজিক শিক্ষা এবং মূল্যবোধের উপর।

ধর্ষনের অপরাধের জন্য বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রকার শাস্তির বিধান আছে। যেমন- ধর্ষণের অপরাধে প্রকাশ্যে শিরচ্ছেদ, গুলি করে হত্যা, ঢিল মেরে মেরে হত্যা, ফাঁসি দিয়ে হত্যার দণ্ড নিশ্চিত করা দেশগুলোতে আজও ধর্ষণ বন্ধ করা যায়নি বা আশানুরূপ ফলাফল অর্জন সম্ভব হয়নি।

♦এবার দেখে নেওয়া যাক বাংলাদেশে পৈচাশিক নারকীয় ধর্ষনের সাজা কি? দন্ড বিধি আইনের ৩৭৬ ধারায় নারী ধর্ষণের শাস্তি বর্ননা করা হয়েছে। দেখে নেয়া যাক বিস্তারিত-

কোন ব্যক্তি যদি ধর্ষণের অপরাধ করে, তবে সে ব্যক্তি যাবজীবন কারাদণ্ডে, অথবা দশ বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে, এবং তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবে, যদি না ধর্ষিত স্ত্রীলোকটি তার নিজ স্ত্রী হয় ও বারো বৎসরের কম বয়স্কা না হয়; যদি তদ্রুপ হয়, তবে সে ব্যক্তি দুই বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থ দণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে। (যদিও বর্তমানে ধর্ষনের অপরাধ সীমাহীনভাবে বেড়ে যাওয়ায় সরকার এ অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করার চিন্তা ভাবনা করছে)

♦নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের শাস্তি:

  • ধারা ৯(১): কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করবেন। এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডও তাকে দেয়া যেতে পারে।
  • ধারা ৯(২): ধর্ষণের ফলে বা ধর্ষণের পড়ে অন্য কোন কাজের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষণকারী মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করবেন। এছাড়াও তাকে এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
  • ধারা ৯(৩): একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে এবং ধর্ষণের কারণে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে তাহলে ধর্ষকরা প্রত্যেকেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়াও তাদেরকে অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
  • ধারা ৯(৪): যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে
    (ক) ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
    (খ) যদি ধর্ষণের চেষ্টা করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।

♦ধর্ষণ অপরাধ রাতারাতি বন্ধ করা সম্ভব নয় বরং বিভিন্ন গৃহীত পদক্ষেপের মাধ্যমে এ অপরাধ প্রবনতা কমতে পারে। তা নিম্নরুপঃ-

(ক) পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি: পৈচাশিক ও নারকীয় এ ধর্ষণ অপরাধের পিছনে থাকে পুরুষের পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের অভাব। একজন মানুষ শৈশব থেকেই পরিবার থেকে কৃষ্টি-কালচার শিখে বড় হয়। তাই এ অপরাধ দমনে প্রতিটা পরিবার তথা সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধ বৃদ্ধি করতে হবে। সেই সাথে ছেলে-মেয়েদের ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টি করাতে হবে পারিবারিক ভাবে।

(খ) ধর্ষণ অপরাধের বর্তমান আইনে বাংলাদেশের ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় প্রথমে মামলা দায়ের হলে উহা সঠিক তদন্ত করে আদালতে পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল হয়। আদালতে উক্ত পুলিশ প্রতিবেদন শুনানিতে নিয়ে গ্রহণ করে অভিযোগ গঠন করে অভিযোগের ধরন অনুযায়ী। তারপর সাক্ষী-সাবুদ এর জেরা-জবানবন্দি হয়। পলাতক থাকলে আসামীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি বিধির (Section 339B, CrPC) বিধান ও হত্যা মামলার ক্ষেত্রে LR Manual এর বিধান মতে পলাতক আসামীর জন্য রাষ্ট্র সরকারী খরচে আইনজীবী নিয়োগ করে থাকেন, যাকে State Defence বলা হয়।

রাষ্ট্রীয় খরচে মামলা পরিচালনায় অপরাধ প্রমাণিত হলে পলাতক আসামী পরবর্তীতে গ্রেপ্তার কিংবা আটক বা আদালকে Surrender করলে সাধারণত আইনগত কোনো প্রতিকার লাভে হকদার হন না। কারণ আইনের ভাষ্য পলাতক আসামী কোনো আইনি প্রতিকার পেতে হকদার নয়।

মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত হলে Crpc এর ৩৪২ ধারায় আসামীর বিরুদ্ধে প্রমাণিত অংশের সাক্ষীর বক্তব্য পাঠ করে শুনাতে হয়। তারপর আসামী তার পক্ষে সাফাই সাক্ষী না দিলে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে (Sec. 265J, CrPC) রায়ের দিন ঘোষণা করেন ও আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতিতভাবে প্রমাণিত হলে আসামীর সাজা বা কারাদণ্ড প্রদান করা হয় (Sec. 265K, Cr.PC)। এত সব নিয়ম মেনে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়।

এই ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ায় আসামীরা আইনের ফাঁক-ফোকর ও সাক্ষীদের হুমকি কিংবা ম্যানেজ করে নানা কৌশলে হয়তবা খালাসও পায়। তাই দ্রুত অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করতে ধর্ষনের সাজা সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড রেখে,বর্তমান আইন সংশোধন করে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠণ করে দ্রুততার সাথে রায় প্রদান করলে হয়তবা এ অপরাধের রাশ টেনে ধরা সম্ভব হতে পারে।

মোঃ রায়হান আলী: শিক্ষানবিশ আইনজীবী, খুলনা।