সাব্বির এ মুকীম
সাব্বির এ মুকীম

‘এক্ট অব গড’: জাহাজের বদলে জাহাজ নয়

সাব্বির এ মুকীম: অস্ট্রেলিয়ান উকিল স্টিভ মেয়ার্স তাঁর মাছ ধরার ট্রলার কালবৈশাখী ঝড়ে পড়ে ডুবে যাওয়ায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে ইশ্বরের বিরুদ্ধে মামলা ঠুঁকে দিয়েছিলেন। ২০০১ সালের সিনেমাটির নাম “দ্য ম্যান হু স্যুড গড”। উকিল সাহেব মামলা করেছিলেন কারণ ইন্সুরেন্স কোম্পানী “এক্ট অব গড” গ্রাউন্ডে উকিল সাহেবের বীমা দাবী পরিশোধ করতে অস্বীকার করে। সে সিনেমার বলিউড রিমেক হলো পরেশ রাওয়াল অভিনীত “ওএমজি (ও মাই গড), ২০১২”।

এইচআরসি শিপিং লিমিটেড বনাম এমভি এক্সপ্রেস মানসুলু গং মামলায় গ্রেপ্তারকৃত জাহাজের পক্ষে গ্রেপ্তারের আদেশ রদ রহিতে প্রার্থণা সম্বলিত দরখাস্তের শুনানীতে দরখাস্ত সমর্থনে সেই “এক্ট অব গড” যুক্তি উপস্থাপন করা হলে তা গ্রহণ করে ৫৮ ডিএলআর (২০০৬) হাইকোর্ট ডিভিশন এর ১৮৫ পৃষ্ঠা হতে ছাপা হওয়া বিচারপতি শামীম হোসাইন এর তৎকালীন এডমিরালটি আদালত রায়ের ১৭ অনুচ্ছেদে বলেছিলেন,

“An ‘Act of God’ was always a common law exception. It was a metaphorical phrase (like ‘fate’) with a religious origin used to describe those events which involved no human agency and which it was not realistically possible for a human to guard against.”

বঙ্গানুবাদ সারমর্ম হলো কমন ল’ এর অন্যতম ব্যতিক্রম নীতি হলো এই “এক্ট অব গড” নীতি যা ধর্মীয় উৎস হতে আনা হয়েছে মানুষের নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরের ঘটনা ব্যাখ্যা করার আশায়।

আলোচ্য বাদী ও বিবাদী উভয় প্রতিষ্ঠান জাহাজে করে অর্থের বিনিময়ে কন্টেইনার বহন করে। তারা ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৪ সালে নিজেদের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কলম্বো বন্দরের মধ্যে একসাথে কন্টেইনার পরিবহন সংক্রান্ত এক চুক্তি করে। চুক্তি মোতাবেক বাদীর নিয়ন্ত্রণাধীন এমভি বঙ্গ বিজয় ও এমভি বঙ্গ বণিক নামে দু’টি জাহাজ এবং বিবাদীর নিয়ন্ত্রণাধীন এমভি জামি ও এমভি এক্সপ্রেস রিসলভ নামে দু’টি জাহাজ কন্টেইনার পরিবহনে নিয়োজিত হয়।

বাদী বা বিবাদী পক্ষ যেকোনো কন্টেইনার চট্টগ্রাম-কলম্বোর মধ্যে বহন করে দেয়ার জন্য গ্রহণ করলে এই ৪টি জাহাজের যেটি সে কন্টেইনারের কাছাকাছি থাকবে সে জাহাজের মাধ্যমে পরিবহন করা হবে।

২১ শে ডিসেম্বর, ২০০৪ তারিখে বাদী কতৃক গৃহীত ৫৩টি কন্টেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে বিবাদীর প্রদত্ত এমভি জামিতে বোঝাই করে কলম্বোর উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়। ২৭ শে ডিসেম্বর বাদীকে জানানো হয় কলম্বো বন্দরে এমভি জামি বার্থ করার সময় ২৬ ডিসেম্বরে এক সুনামী আঘাত করে। সুনামীর ধাক্কায় এমভি জামি হতে বাদীর গৃহীত সবগুলো কন্টেইনার সাগরে চিরতরে ভেসে যায়। এমভি জামি এর মাস্টার সেদিনই কলম্বো বন্দরে নোট অব প্রটেস্ট প্রদান করেন।

বাদী হারিয়ে যাওয়া কন্টেইনারের জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে বিবাদীর বিরুদ্ধে আলোচ্য এডমিরালটি মামলাটি করেন। বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থানরত বিবাদীর নিয়ন্ত্রণাধীন এমভি এক্সপ্রেস মানসুলু এবং এমভি এক্সপ্রেস রিসলভ গ্রেপ্তারের আদেশ হয়। উল্লেখ্য এমভি এক্সপ্রেস রিসলভ বাদী ও বিবাদীর চুক্তিভুক্ত জাহাজ হলেও এমভি এক্সপ্রেস মানসুলু ছিলো চুক্তির বাইরের জাহাজ। এমন প্রেক্ষিতে বিবাদী তাদের সেই দু’টি জাহাজ গ্রেপ্তারের আদেশ রদ রহিত চেয়ে আলোচ্য দরখাস্ত করে।

বিবাদী পক্ষের যুক্তি ছিল-
(১) গ্রেপ্তারকৃত জাহাজ দু’টি বিবাদী ভাঁড়ায় নিয়ন্ত্রণ করে। বিবাদীর নিয়ন্ত্রনাধীন হলেও এমভি এক্সপ্রেস মানসুলু এবং এমভি এক্সপ্রেস রিসলভ এর মালিক হলো যথাক্রমে মানসুলু পিটিই লি:, সিংগাপুর এবং সিসপেন্স (প্রা) লি:, শ্রীলংকা যাদের সাথে বাদীর কোনো চুক্তি নাই।
(২) নালিশী ক্ষতি আসলে “এক্ট অব গড” জনিত।

বাদীর পাল্টা যুক্তি ছিল-
(১) আলোচ্য ঘটনায় এমভি জামি জাহাজের মালিক চুক্তি ভঙ্গ করেছে, মাস্টার অবহেলা করেছে।
(২) গ্রেপ্তারকৃত জাহাজ দু’টির মালিক মামলার ৫নং বিবাদী এবং ৫নং বিবাদীরই সির্স্টার কনসার্ন, তাই জাহাজ দু’টি মামলার সিকিউরিটি হিসাবে নেয়ার যোগ্য।

বিজ্ঞ আদালত রায়ের ৮ম অনুচ্ছেদে আলোচ্য দরখাস্তে বিচারে ২টি বিচার্য্য বিষয় নির্ধারণ করেন। যথা:-
(এ) গ্রেপ্তারকৃত জাহাজ দু’টির প্রকৃত মালিকানা এবং আদৌ সে মালিকেরা এডমিরালটি আদালত আইন ২০০০ এর এখতিয়ারে পড়ে কি-না?
(বি) নালিশী ক্ষয়ক্ষতির জন্য এমভি জামি এর দায়।

এডমিরালটি আদালত আইনের ৪ধারায় এডমিালটি আদালতের এখতিয়ারের বিবরণ দেয়া হয়ে ছিল। তদকাল পর্যন্ত জাহাজের মালিকানা সংক্রান্তে বাংলাদেশী কোনো সিদ্ধান্ত না থাকায় বিজ্ঞ আদালত খুঁজে দেখান যে এডমিরালটি আদালত আইনের ৪ ধারাটি ইংলিশ এডমিনিষ্ট্রেশন অব জাষ্টিস এক্ট ১৯৫৬ এর ৩(৩) অনুচ্ছেদের রিপ্রোডাকশান।

বৃটিশ আইনের এই ধারা নিয়ে বৃটিশ আদালতের সে ইন্টমেরিয়েলস মামলায় ১৯৬৯ সালে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়, যার মর্ম হলো ভাড়ার জাহাজকে ভাড়াটিয়ার ইনরেম দায়ে দায়বদ্ধ করা যায় না। বাংলাদেশী বিজ্ঞ আদালত সে বৃটিশ নজির গ্রহণ করেন। বিজ্ঞ আদালত “কোন জাহাজ গ্রেপ্তার করা যাবে” প্রশ্নের উত্তরে লয়েড ল’ রিপোর্ট ২নং বালামের ১৫৩ পৃষ্ঠা হতে ছাপা দ্য মেরিটাইম ট্রেডার মামলায় বিখ্যাত বৃটিশ এডমিরালটি জাজ স্যার ব্যারি শিন প্রদত্ত উত্তর গ্রহণ করেন। বিচারপতি শিন এর সে উত্তরের সার বস্তু হলো কেবল যে জাহাজের বিরুদ্ধে নালিশ করা হয়, কেবল সেই জাহাজ অথবা সে জাহাজের মালিকানধীন অন্য কোনো জাহাজই গ্রেপ্তার করা যাবে। কিন্তু অভিযুক্ত জাহাজের মালিকের ভাড়া করা জাহাজকে সে জন্য গ্রেপ্তার করা যাবে না। বিজ্ঞ আদালত এ ছাড়াও “মালিকানা” প্রশ্ন নির্ধারণে [১৯৮৮] ১ ডব্লিউএলআর এর ১০৯১ পৃষ্ঠা হতে ছাপা হওয়া ইভো এগনিক মামলায় প্রদত্ত সিদ্ধান্ত যাতে বলা হয় জাহাজের মালিক বলতে শুধুমাত্র “নিবন্ধিত মালিক” কেই বোঝায় এইমত গ্রহণ করেন।

সেই মোতাবেক আলোচ্য রায়ে বিজ্ঞ আদালত বিচার্য (এ) ইস্যু বিবাদী পক্ষে মর্মে নিষ্পত্তি করেন। বিচার্য (বি) ইস্যু নিষ্পত্তিতে বিজ্ঞ আদালত বাদী ও বিবাদীর মধ্যকার পূর্বোল্লিখিত ২০০৪ সালের চুক্তির ১৯নং শর্ত এবং ২৩ নং শর্ত বিবেচনায় নেন। ২৩ নং শর্তে এডমিরালটি আদালত এর জন্য প্রাসঙ্গিক হেগ রুলস (সংশোধিত ২৩-০২-১৯৬৮ ইং, ব্রাসেলস প্রটোকল বা ভিসবি এমন্ডমেন্ট) কেসে চুক্তির জন্য প্রযোজ্য করা হয়ে ছিল।

ইন্টারন্যাশাল কনভেনশন ফর দ্য ইউনিফিকেশন অব সার্টেন রুলস অব ল’ রিলেটিং টু বিল অব ল্যাডিং এন্ড প্রটোকল অব সিগনেচার ১৯২৪ ই হেগ রুলস নামে সুপরিচিত। ১৯২৩ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস এ ম্যারিটাইম আইন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সে অধিবেশনে বৃটিশ ব্যবসায়ী ও জাহাজ মালিক সহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের প্রতিনিধিগণ কিছু বিধানের বিষয়ে একমত হন। সে সব বিধানই হেগ রুলস পরিচিতি পায়। বৃটেনে হেগ রুলসকে ক্যারিজ অব গুডস এট সি এক্ট ১৯২৪ হিসেবে আইনে পরিণত করা হয় যার উপমহাদেশীয় সংস্করণ হলো ক্যারিজ অব গুডস এট সি এক্ট ১৯২৫। ১৯২৫ এর আইনের তপসিলে হেগ রুলস লিপি করে ২ ধারার শর্তাধীনে হেগ রুলসকে আইন হিসেবে গণ্য করা হয়। হেগ রুলস এবং তার ভিসবি সংশোধনীতে “এক্ট অব গড” এর ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে।

আলোচ্য রায়ে বিজ্ঞ আদালত ১ সিপিডি এর ৪২৩ পৃষ্ঠা হতে ছাপা হওয়া ন্যগেন্ট বনাম স্মিথ (১৮৭৬) মামলার রায়ে প্রদত্ত “এক্ট অব গড” এর সংজ্ঞা গ্রহণ করে এই বিবরণের সূচনায় উদ্ধৃতকৃত ১৭ অনুচ্ছেদের মন্তব্যটি করেন।

তৎপর আলোচ্য নালিশ এর প্রাসঙ্গিক কলম্বো এডমিরালটি আদালতের ২০০৫ সনের ১১নং রেম নালিশে প্রদত্ত ২৬শে ডিসেম্বর, ২০০৪ সালে সুনামী ও এমভি জামি এর উপর প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে বিজ্ঞ আদলত এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে আলোচ্য ঘটনাটি “এক্ট অব গড”, এমভি জামি এর মাস্টারের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ আনার কোনো সুযোগ নেই। বিজ্ঞ আদালত বিচার্য (বি) নং ইস্যু ও বিবাদীর পক্ষে মর্মে সিদ্ধান্ত দিয়ে নিষ্পত্তি করেন। অর্থাৎ “এক্ট অব গড” এর বেলায় জাহাজের বদলে জাহাজ নয়।

রায়ে বিজ্ঞ আদালত সিদ্ধান্ত দেন আলোচ্য মামলায় এমভি এক্সপ্রেস মানসুলু এবং এমভি এক্সপ্রেস রিসলভকে কোনোভাবেই গ্রেপ্তার করা যায় না। বিবাদীর দরখাস্ত মঞ্জুর করে বিজ্ঞ আদলত জাহাজ দু’টি মুক্তির আদেশ দেন।

সাব্বির এ মুকীম: অ্যাডভোকেট; জজ কোর্ট, কুমিল্লা। ই-মেইল: samukim1@gmail.com