লিভ টুগেদার, ব্যভিচার, মাওলানা মামুনুল হক, জিশান-মাহমুদ

লিভ টুগেদার ও ব্যভিচার; মাওলানা মামুনুল হক এবং দন্ডবিধির ৪৯৭ ধারা

জিশান মাহমুদ :
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার এর অনুচ্ছেদ সমূহ ও তার ব্যাখ্যা অনুযায়ী বাঁচার, জীবিকার, মতামত, ধর্ম, বিবাহ ও সংস্কৃতির অধিকার মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। সংবিধানের কোথাও লিভ টুগেদার করা যাবে না তা বলা হয়নি।

বিয়ে করার আগে পরিক্ষামূলকভাবে সম্পর্কটাকে একটু দেখে নেওয়ার একটি ভালো উপায় হলো লিভ টুগেদার। গাড়ি কিনবার আগে তাকে চালিয়ে দেখে নেওয়ার আইডিয়া ভালো হলেও, বিয়ের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করা যায় না। লিভ টুগেদার আসলে “ভূয়া বিয়েসুলভ” এবং সত্যিকার কিছুর মতো এটি নয়।

যদিও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ আরব আমিরাত লিভ টুগেদারকে বৈধতা দিয়েছে। এর অর্থ হল-এক সময়কার কট্টর ইসলামি অনুশাসনের দেশটিতে এখন থেকে অবিবাহিত নারী-পুরুষ একসঙ্গে থাকতে পারবেন। আইনগতভাবে তাদেরকে কোনো ধরনের বাধার মুখে পড়তে হবে না। দেশটির ইসলামিক পারসোনাল ল’-তে পরিবর্তন আনার মধ্য দিয়ে এই সুযোগ দেয়া হয়েছে ২১ বছরের বেশি বয়সী মানুষের জন্য। [সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর, ১০ নভেম্বর ২০২০]

অন্যদিকে, ভারতের সুপ্রীম কোর্ট S. Khushboo vs. Kannaimmal মামলায় লিভ টুগেদারকে বৈধতা দিয়েছে। মামলার রায়ে বলা হয়েছে, “a living relationship comes within the ambit of right to life under Article 21 of the Constitution of India” আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, “live-in relationships are permissible and the act of two major living together cannot be considered illegal and unlawful”.

ঘটনার প্রেক্ষিতে উল্লেখ্য যে, মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী ইসলামী দেশ আরব আমিরাত লিভ টুগেদার বলতে অবিবাহিত নারী-পুরুষ একসঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত বসবাস বুঝিয়েছে। অন্যদিকে, বিয়ে না করেও একত্রে বসবাস করতে পারেন প্রাপ্তবয়স্ক যুগল। কেরালার এক মামলা সম্পর্কে রায় দিতে গিয়ে উপরিউক্ত যুগান্তকারী নির্দেশনা দিয়েছে ভারতের সুপ্রীম কোর্ট। দুটি ঘটনায় অবিবাহিত যুগল বা কাপল এর লিভ টুগেদার বুঝানো হয়েছে।

এবার আসা যাক Adultery প্রসঙ্গে। Adultery বলতে আসলে কি বুঝায়? Adultery এর বাংলা অর্থ হল ব্যভিচার। ইহা একটি বিশেষ্য পদ। শাব্দিক অর্থে স্ত্রী-পুরুষের অবৈধ সংসর্গ বা পরপুরুষ-সহবাস অথবা পরস্ত্রীগমন।

বাংলাদেশ দন্ডবিধি, ১৮৬০ সালের ৪৯৭ ধারায় ব্যাভিচার কে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। ৪৯৭ ধারা মতে, “Whoever has sexual intercourse with a person who is and whom he knows or has reason to believe to be the wife of another man, without the consent or connivance of that man, such sexual intercourse not amounting to the offence of rape, is guilty of the offence of adultery, and shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to five years, or with fine, or with both. In such case the wife shall not be punished as an abettor”. বাংলাদেশের আইনে অন্য পুরুষের স্ত্রী বলে বিশ্বাস করে যৌন মিলন করাকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়। তবে এই অপরাধে নারী অপরাধী হয়না অপরাধী হয় পুরুষ।

এটা স্পষ্ট যে, পরস্ত্রীর সাথে যৌন মিলন করাকেই বাংলাদেশের আইনের প্রেক্ষিতে Adultery বা ব্যভিচার বলা হয়। Adultery বা ব্যভিচার কে ভারতের আদালত অবশ্য Joshep Shine v. UOI মামলায় বৈধতা দিয়েছে। ভারতের আদালতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, “Husband is not a Master of his wife and adultery is not a crime”.

হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হক সাহেব সোনারগাঁও এর রয়েল রিসোর্টের ৫০১ নম্বর রুমে কথিত শহিদুলের সাবেক স্ত্রীর সাথে গোপন অভিসার কে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে Adultery বা ব্যভিচার বলা যায় কি? ব্যভিচারের মামলা করতে হলে কথিত শহিদুলের স্ত্রী বর্তমান থাকা আবশ্যক। তাই বলে কি মাওলানা মামুনুল হক অপরাধী নন? মাওলানা মামুনুল হক একজন সামাজিক অপরাধী। বাংলাদেশের আইনানুযায়ী একজন অবিবাহিত পুরুষ ও অবিবাহিত নারী কিংবা একজন বিবাহিত পুরুষ ও অবিবাহিত নারীর মধ্যকার পারষ্পরিক সম্মতিমূলক যৌন সঙ্গম ও একত্রে বসবাস আইনসম্মত এবং তা ব্যভিচার বলে গণ্য হয় না। ব্যভিচারে লিপ্ত নারী-পুরুষের মধ্যে নারীটির অন্যের “বিবাহিত স্ত্রী” হওয়াটা এই ধারায় একটি শর্ত, ব্যভিচারী পুরুষটির বিবাহিত হওয়াটা শর্ত নয়। ৪৯৭ ধারার এই অংশটি অসম্পূর্ণ এবং ধর্মীয় আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। পরকীয়া ও ব্যভিচার একটি সামাজিক অনাচার, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। দেড়শ বছরের পুরনো এই আইনের সংশোধন এখন সময়ের দাবি।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং উপ-আইন সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ।