সাঈদ আহসান খালিদ
সাঈদ আহসান খালিদ; সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

‘চাঞ্চল্যকর মামলা’ ও মিডিয়া ট্রায়াল

সাঈদ আহসান খালিদ :
বাংলাদেশের জনগণের বৃহত্তর অংশের আইন ও বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পর্কিত জ্ঞান ও ধারণা হয় বাংলা সিনেমার মেলোড্রামাটিক বিচার দৃশ্য দ্বারা প্রভাবিত, নয়তো নিজের জীবনের কোন পর্যায়ে বাদি হিসেবে মামলা করে বা বিবাদি হিসেবে মামলা খেয়ে লব্ধ অভিজ্ঞতা জারিত।
প্রথম ক্ষেত্রে প্রাপ্ত ধারণা মূলত বিচারিক প্রক্রিয়ার অসঠিক ও বিকৃত চিত্রায়ন নির্ভর, আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা সার্বজনীন ও অবজেক্টিভ নয়, এটি প্রধানত সাবজেক্টিভ এবং আইন ও বিচারিক প্রক্রিয়ার ব্যক্তিগত ও খণ্ডিত রূপের প্রকাশ।
ফলে, আইন ও বিচার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও পেশাগত অভিজ্ঞতা লাভ না করা জনগণের বড় অংশ যখন ‘আলোচিত’ কোন মামলার বিষয়ে পাবলিক প্ল্যাটফর্মে মতামত দেওয়ার সুযোগ পান, সেই মতামতও উপরোক্ত নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে হয়ে উঠে হয় অসত্য, ব্যক্তিগত রাগ-বিরাগ-অনুরাগপ্রসূত, খন্ডিত, নতুবা অনেকাংশে বিকৃত।
এটি সম্ভব হয় মূলত এদেশে বিচারিক প্রক্রিয়ার ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ করার সুযোগ ও প্রবণতার কারণে। এই ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ এখানে জুডিসিয়াল ট্রায়ালের সমান্তরাল চলে, বিশেষত ‘আলোচিত’ ও ‘চাঞ্চল্যকর’ মামলার ক্ষেত্রে বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতি পদক্ষেপ যখন মিডিয়ার পাদপ্রদীপের আলোয় আলোকিত হতে থাকে। মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে জুডিসিয়াল ট্রায়ালের আগেই জনপরিসরে দোষ-নির্দোষ নির্ধারিত হয়ে যায়।
ফলে, মানুষ যখন দুই ট্রায়ালের ফলাফলের মধ্যে কন্ট্রাডিকশন দেখতে পায়, সে হতাশ হয়, ক্ষুদ্ধ হয় এবং লব্ধ ধারণা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিচারিক প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। মিন্নির ফাঁসিতে খুশি হয়, পরি মনির জামিনে বেজার।
কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবেঃ
প্রথমত, বিচার কোন নাটক বা সিনেমা নয়। পপুলিস্ট ভিউ বা মিডিয়া ভিউ দিয়ে লিগ্যাল ভিউ-কে পর্যবেক্ষণ করার প্রক্রিয়াটিই একটি গুরুতর গলদ এবং এটি বিপদজনক।
দ্বিতীয়ত, আইন ও বিচার কোন একক ব্যক্তির কাজ নয়, এটি একটি সামষ্টিক প্রক্রিয়ার ফলাফল যেখানে অনেকগুলো পক্ষ যেমন- বাদি, বিবাদী, উভয়পক্ষের আইনজীবী, তদন্তকারী পুলিশ, সাক্ষী, মেডিকেল এভিডেন্স প্রদানকারী চিকিৎসক, বিচার প্রশাসন ও স্বয়ং বিচারক গভীরভাবে বিজড়িত থাকে। এই প্রক্রিয়া বিনি সুতোর মালার মতো এবং পারষ্পরিক নির্ভরশীল। কোন একটি পক্ষের অবহেলায় বা অতি প্রতিক্রিয়ায় পুরো বিচার প্রক্রিয়াটি খারাপভাবে প্রভাবিত হতে পারে।
তৃতীয়ত, আইনের দৃষ্টিতে ‘আলোচিত’, ‘সেনসেশনাল’ বা ‘চাঞ্চল্যকর’ মামলা বলে কিছু নেই। বিচার প্রক্রিয়ায় সব মামলাই সমান যদি না আইন বিশেষভাবে কোন নির্দিষ্ট অপরাধকে বিশেষ আইনে বিচারের অন্তর্ভুক্ত করে থাকে। যেমন, স্পেশাল ল’জ এন্ড ট্রাইব্যুনালস। কিন্তু, সেটিও একটি জেনেরিক বিষয় যেমন, নির্দিষ্টভাবে নারী ও শিশুর ওপর সংঘটিত অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত সব মামলাই আবার আইনের চোখে সমান, একজন যৌনকর্মী আর সমাজের অভিজাত নারী-র ন্যায়বিচারের সুযোগ পাওয়ার সেখানে সমান অধিকার। অর্থাৎ, কোন নির্দিষ্ট শ্রেণির নারীর মামলাকে ‘আলোচিত’ বা ‘চাঞ্চল্যকর’ হিসেবে শ্রেণিবিভক্ত করার আইনগত অবকাশ নেই।
এই ‘আলোচিত’ ও ‘চাঞ্চল্যকর’ টার্মের উৎপত্তি ও বহুল ব্যবহার হয়ে থাকে মিডিয়া ট্রায়ালে।
চতুর্থত, বিচার প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সমস্ত পক্ষই মানুষ; রোবট নয়। মিডিয়া ট্রায়ালের সেনসেশন থেকে অনেকেই যে নিজেদের বিযুক্ত করতে পারে না, আইনগত বিষয়ে নৈর্ব্যক্তিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয় না- এই সীমাবদ্ধতা অস্বীকারের জো নেই। এটি আমাদের কাঙ্ক্ষিত নয় কিন্তু এটি ঘটে। একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা, পাবলিক প্রসিকিউশন বা মেডিকেল এভিডেন্স সরবরাহকারী চিকিৎসক বায়াসড হতে পারেন, কম্প্রোমাইজড হতে পারেন, এবং পেশাগত দায়িত্বে অবহেলা করতে পারেন। আইনে সেসবের শাস্তি ও প্রতিকারবিধানের ব্যবস্থা আছে।
পঞ্চমত, কোন বিচারকও ‘বিচারিক বিচ্যুতি’র ঊর্ধ্বে নন। বিচারিক প্রক্রিয়ায় আইনগত ত্রুটি ঘটতে পারে, বিচারক ব্যক্তিগতভাবে বায়াসড হতে পারেন, দুর্নীতিবাজ হতে পারেন, পেশাগত দায়িত্বে অবহেলা করার দোষে দোষীও হতে পারেন।
এমনকি, মিডিয়া ট্রায়ালের চাঞ্চল্যে বিচারক নিজেও চঞ্চল হয়ে ওঠে ‘অতি-বিচারিক সক্রিয়তা’ কিংবা ‘অস্বাভাবিক নিষ্ক্রিয়তা’ প্রদর্শন করতে পারেন। সবই বেআইনি। এবং প্রতিটির জন্যই আইনগত প্রতিকারের বিধান রয়েছে।
আইনগত ত্রুটি হলে, এখতিয়ার বহির্ভূত ক্ষমতা চর্চা করলে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের উচ্চতর আদালতে আপিল, রিভিউ, রিভিশনের আইনগত সুযোগ আছে, বিচারকের পেশাগত অসদাচরণ ও দূর্নীতির জন্য প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থাগ্রহণের ব্যবস্থা বিদ্যমান আছে।
মিডিয়া ট্রায়ালে সবাই অংশগ্রহণ করলেও বিচারক আত্মপক্ষ সমর্থনে অংশ নিতে পারেন না। জুডিসিয়াল ট্রায়ালকে মিডিয়া ট্রায়ালের কাঠগড়ায় তোলার মাধ্যমে পপুলিস্ট ভিউ হয়তো শক্তিশালী হয়, জনতার জয় হয় কিন্তু চূড়ান্তভাবে এটির মাধ্যমে ন্যায়বিচার পরাহত এবং বিচারব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধ হোক।

লেখক- সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

s.ahsankhalid@yahoo.com