মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান: ছোটবেলা থেকেই অনেকের মতই নতুন বইয়ের প্রতি আমার দুর্নিবার আকর্ষণ। নতুন বইয়ের গন্ধ, পাতায় পাতায় ছড়ানো রোমাঞ্চ, তথ্য আর ইতিহাস ভালো লাগার অসীম সীমানায় নিয়ে যায় আমাকে। স্নেহের ছোটভাই সাইফুল ইসলাম পলাশ (বিজ্ঞ যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ) এর লেখা “প্রবেশন ও প্যারোল আইন” বইটির প্রতি আমার একরকম পক্ষপাতমূলক আগ্রহ ছিল। কারণ এই বইটির জন্মলগ্ন থেকেই আমি সাক্ষী ছিলাম। বাংলা ভাষায় এই টপিকের উপর মৌলিক ও বিশ্লেষনধর্মী বই এর আগে আমি হাতে পাইনি। তাই হাতে পেতেই মন দিয়ে বইটি পড়েছি।
প্রথম দিকের অধ্যায়গুলো আমাকে ছাত্র জীবনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার জন্য আমরা যেভাবে প্রস্ততি গ্রহণ করি, সেভাবেই প্রবেশন ও প্যারোলের ঐতিহাসিক পটভূমি, বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে এর চর্চা, তত্ত্ব, তথ্য উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তসহ সুনিপুণ হাতে সন্নিবেশিত হয়েছে। ফলে আইনের যে কোন পর্যায়ের ছাত্রের জন্য এই বই এক অনবদ্য হ্যান্ডবুক হিসেবে কাজে লাগবে।
এর পরেই আসল চমক ছিল বইটিতে। প্রবেশন আইনটি বহু পুরাতন হলেও এর ব্যবহারিক প্রয়োগ বাংলাদেশের আদালতগুলোতে ব্যাপকভাবে ইদানিং শুরু হয়েছে। মহামান্য উচ্চ আদালতের প্রদত্ত আব্দুল খালেক বনাম হাজেরা বেগম মামলার রায়ের মাধ্যমেই মূলতঃ আইনটি সঞ্জীবনী সুধা লাভ করে। এর ধারাবাহিকতায় মতি মাতবর কেইস, নুর মোহাম্মদ কেইস এর মাধ্যমে আরোও সমৃদ্ধ হয় আইনটি। লেখক মহামূল্যবান রায়গুলোর রেফারেন্সসহ নিজের অভিজ্ঞতা আর মেধার অনন্য মিশেলে বইটিকে এক আইকনিক পান্ডুলিপিতে পরিণত করেছে। আমাদের আদালতগুলোতে কিভাবে এই আইনের প্রয়োগ হবে, বিচারক, আইনজীবী, প্রবেশন কর্মকর্তা, পুলিশসহ সংশ্লিস্টদের কার কি দ্বায়িত্ব তা লেখক নিজ দায়িত্বেই আমাদের সরল কথায় জানিয়েছেন।
তাছাড়া যারা প্রথম প্রবেশন বা প্যারোল নিয়ে কাজ করবেন তাদের জন্য বইটি হবে পথনির্দেশিকা। কেননা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রবেশন ও প্যারোল অর্ডার কেমন হতে পারে লেখক তার একটা ডামি এখানে সন্নিবেশ করেছেন। তিনি নিজেই বিচারক জীবনে প্রবেশন আইনের বহু প্রয়োগ করার ফলে তার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান প্রতি পাতায় পাতায় মুক্তো দানার মতো ছড়িয়েছেন। প্রতি পৃষ্ঠায় প্রদত্ত পাদটিকার সংযোজন এই বইকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। শেষের দিকে প্রবেশন প্যারোল সংক্রান্ত বিভিন্ন ফর্ম এর সংযোজন ভালোলাগার আবহটা আরোও প্রলম্বিত করেছে। সর্বপরি ছদ্মনামে যে তিনটি জীবনের গল্প তিনি বইতে সংযোজন করেছেন তা যে কাউকেই কল্পলোকের উঠোনে দাঁড় করাবে। একবাক্যে বলবেন এই চিরচেনা গল্প আমারই গ্রামের, আমারই সমাজের। চমৎকার মলাটের ৩৯২ পৃষ্ঠার এই বই এর শুরুতেই মাননীয় বিচারপতি এম.ইনায়েতুর রহিম স্যারের লেখা মুখবন্ধটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছি।
লেখকের প্রথম প্রকাশনার প্রথম এডিশন হলেও কয়েকটি বানানের ভুল ছাড়া আমার কাছে খুব উঁচুমানের একটি মৌলিক বই বলে মনে হয়েছে। শুভ হোক বিচারক লেখকের পথচলা।
তোমার আকাশ গড়বে তুমি
হোকনা সে পথ বন্ধুর,
মেঘ সরে গেলে দেখবে তখন
সাফল্যে মোড়া রোদ্দুর।
লেখক: বিচারক (জেলা জজ), নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, রাজশাহী