অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সেলিম মিয়া
অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সেলিম মিয়া

ভবঘুরে ও নিরাশ্রয়দের পুনর্বাসনে নির্বিকার সরকার, আইন থাকলেও উদ্যোগ নেই

মোহাম্মদ সেলিম মিয়া: ব্যস্ত শহরে বাতিলের দলে থাকা ভাসমান মানুষ, নিরাশ্রয় ও ভবঘুরেদের নিয়ে ভাবার সময় নেই কারও। পথ চলতে ঢাকা শহরে রাস্তা-ঘাট অলিগলিতে প্রায়ই দেখা যায় কাউকে ভিক্ষার থালা হাতে, কেউ বিক্রি করছে ফুল, কেউ পানি, কেউ বই। কোন কোন ছিন্নমূল বাচ্চাদের ছোট্ট পিঠ বেঁকে যাচ্ছে পরিত্যক্ত জিনিসপত্রের বস্তার ভারে। এছাড়া মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি, ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তিদের উপস্থিতি মাঝেমধ্যে পথচারীদের বিরক্তও করছে। অথচ তাদের পুনর্বাসনে নৈতিক ও আইনগত দায়িত্ব সরকারের কারণ সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন, যাতে নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়:

(ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা;

(খ) কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার;

(গ) যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার; এবং

(ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্যলাভের অধিকার৷

সংবিধানের মূলনীতি বাস্তবায়নে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, মর্যাদার সুরক্ষা, সম্পত্তির অধিকার ও পুনর্বাসন এবং সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য সরকার মানসিক স্বাস্থ্য আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করে। এছাড়া ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার ২০১১ সালে ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন পাশ করে। উক্ত আইন দুটি কিতাবেই আছে কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ নেই।

মানসিক স্বাস্থ্য আইন, ২০১৮ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, অভিভাবক বা আত্মীয়বিহীন বা ঠিকানাবিহীন মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট এলাকার এখতিয়ার- সম্পন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি নিকটতম সরকারি মানসিক হাসপাতাল প্রধানের নিকট হস্তান্তর করবে।

এছাড়া কোনো ব্যক্তি মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত বলে ধারণা করার কারণ থাকলে এবং মানসিক অসুস্থতার কারণে উক্ত ব্যক্তিকে বিপজ্জনক বলে মনে করার কারণ থাকলে স্থানীয় অধিক্ষেত্রের পুলিশ অফিসার তাকে স্বীয় জিম্মায় গ্রহণ করে নিকটতম মানসিক হাসপাতালে প্রেরণ করবে।

উক্ত উপায়ে হস্তান্তরিত মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট মানসিক হাসপাতাল অনতিবিলম্বে উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদানপূর্বক প্রমাণক কাগজপত্রের অনুলিপি সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় অধিক্ষেত্রের থানাকে সরবরাহ করবে।

অতঃপর অভিভাবক বা আত্মীয়বিহীন বা ঠিকানাবিহীন মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তির সুস্থতার পর সংশ্লিষ্ট মানসিক হাসপাতাল তার সুস্থতার ছাড়পত্রসহ উক্ত ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট জেলার অথবা নিকটতম সমাজসেবা প্রতিষ্ঠানে অথবা পুনর্বাসন কেন্দ্রে স্থানান্তর করবে।

আইনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সরকার মানসিক স্বাস্থ্য সেবাসংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা, সম্প্রসারণ, উন্নয়ন, নিয়ন্ত্রণ এবং সমন্বয় করার দায়িত্ব পালন করবে এবং মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তির স্বাস্থ্য, সম্পত্তি, মর্যাদা, শিক্ষা ও অন্যন্য অধিকারের বিষয়াবলি নিশ্চিত করতে হবে।

এছাড়া ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন, ২০১১ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদ-মর্যাদার নীচে নয় এমন কর্মকর্তা অথবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা, কোন ব্যক্তিকে ভবঘুরে বলে গণ্য করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে মর্মে নিশ্চিত হলে, তিনি উক্ত ব্যক্তিকে যে কোন স্থান হতে যে কোন সময় আটক করতে পারবেন। এরূপ আটককৃত ব্যক্তিকে ২৪ (চব্বিশ) ঘন্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করতে হবে।

এরূপ আটককৃত ব্যক্তিকে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থিত করা হলে, তিনি আটক করার কারণ, তারিখ, সময়, ঘটনার বিবরণ, বয়স, শারীরিক ও মানসিক অবস্থা সংক্রান্ত তথ্যাবলী নথিতে লিপিবদ্ধ করে এতদ্‌বিষয়ক রেজিস্টারে সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি সংরক্ষণ করবেন এবং উক্ত উপায়ে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট যদি যুক্তিসঙ্গত কারণে এরূপ প্রতীয়মান হয় যে, আটক কোন ব্যক্তি সম্পর্কে অধিকতর অনুসন্ধান বা তথ্য প্রয়োজন, তাহলে কারণ লিপিবদ্ধ করে, তিনি উক্ত ব্যক্তিকে, অন্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, প্রধান ব্যবস্থাপকের তত্ত্বাবধানে নিকটস্থ অভ্যর্থনা কেন্দ্রে সাময়িক হেফাজতে রেখে তার সম্পর্কে অনধিক ৭ (সাত) দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধানপূর্বক তদ্‌কর্তৃক চাহিত বা নির্দিষ্টকৃত তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য নিকটস্থ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, প্রবেশন কর্মকর্তা বা অন্য কোন উপযুক্ত ব্যক্তিকে নির্দেশ প্রদান করতে পারবেন।

পরবর্তীতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আটককৃত ব্যক্তি-

(ক) ভবঘুরে নয়, তাহলে কারণ লিপিবদ্ধ করে তিনি উক্ত ব্যক্তিকে বিনাশর্তে বা, ক্ষেত্রমত, প্রয়োজনীয় মুচলেকা গ্রহণপূর্বক, তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তিদানের আদেশ প্রদান করবেন; অথবা

(খ) একজন ভবঘুরে, তাহলে তিনি, কারণ লিপিবদ্ধ করে উক্ত ব্যক্তিকে ভবঘুরে ঘোষণাপূর্বক এই আইনের অন্যান্য বিধান সাপেক্ষে, যে কোন আশ্রয় কেন্দ্রে অনধিক ২ (দুই) বৎসরের জন্য আটক রাখার নিমিত্ত অভ্যর্থনা কেন্দ্রে প্রেরণের আদেশ প্রদান করবেন।

উক্ত বিধানাবলি ছাড়াও কোন নিরাশ্রয় ব্যক্তি স্বেচ্ছায় বা তার পক্ষে কোন স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ, উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান বা বিশিষ্ট কোন ব্যক্তি সরকারী আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় লাভের বা প্রদানের জন্য বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট বরাবরে সরাসরি আবেদন করতে পারবেন। প্রাপ্ত আবেদন যথাযথ বলে বিবেচিত হলে, প্রয়োজনে ব্যক্তিগত শুনানি গ্রহণপূর্বক, তদ্‌কর্তৃক নির্দিষ্টকৃত সময়ের জন্য সংশ্লিষ্ট নিরাশ্রয় ব্যক্তিকে আশ্রয় কেন্দ্রে প্রেরণের আদেশ প্রদান করতে পারবেন।

আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থানরত ভবঘুরে ব্যক্তির পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সরকার, নির্ধারিত পদ্ধতিতে, পরিকল্পনা প্রণয়নপূর্বক তা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

সরকার উক্ত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য বেসরকারী আশ্রয় কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষের নিকট হতে, প্রয়োজনে সহায়তা চাইতে পারবে এবং উক্তরূপ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত কর্তৃপক্ষ সরকারকে সকল প্রকার সহায়তা প্রদান করবে। সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে বেসরকারী আশ্রয় কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হলে সরকার তার অনুমতি বাতিলসহ সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।

এছাড়া উক্ত আইনে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করা। মানুষকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত করার ক্ষেত্রে কতিপয় আইনের প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। অন্য কোন ব্যক্তি দ্বারা প্রভাবিত বা প্ররোচিত হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি কাজে নিয়োজিত এমন কোন ভবঘুরেকে আটক করা হলে তার পাশাপাশি যে ব্যক্তির প্ররোচনা বা প্রভাবে সে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত আছে তা সন্দেহাতীতভাবে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উক্ত আটক ব্যক্তি প্রমাণ করতে পারলে প্ররোচনাকারী বা প্রভাববিস্তারকারী উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি (Penal Code, 1860), নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ (Dhaka Metropolitan Police Ordinance, 1976) সহ এতদ্‌সংক্রান্ত অন্যান্য আইনের বিধানাবলী প্রযোজ্য এবং প্রয়োগযোগ্য হবে।

প্রণয়নের ১০ বছর অতিবাহিত হলেও উক্ত আইন প্রয়োগে কোনো সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না। সরকার মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে কিছুটা প্রয়োগের চেষ্টা করলেও তার কোনো সুফল মেলেনি। ফলে সরকারের ২০১১ সালে প্রণীত ‘ভবঘুরে পুনর্বাসন আইন’ টি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হলেও বর্তমানে অকার্যকর একটি আইনে পরিণত হয়েছে। ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণের কথা আইনে থাকলেও তাদের পুনর্বাসনের বিষয়টি আইন ও বিধিমালাতে স্পষ্ট করা হয়নি।

বিধিমালাতে বলা আছে, আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানরত ভবঘুরে বা নিরাশ্রয় ব্যক্তিদের পুনর্বাসনকল্পে সরকার যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়নপূর্বক তা বাস্তবায়ন করবে কিন্তু অনধিক ২ বছর মেয়াদে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানরত ভবঘুরে বা নিরাশ্রয় ব্যক্তিদের কিভাবে পুনর্বাসন হবে তা স্পষ্ট নয় এবং সরকারের যথাযথ পরিকল্পনাও চোখে পড়ছে না। উল্লেখ্য, পুনর্বাসন পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবঘুরে বা নিরাশ্রয় ব্যক্তিদের যথাযথভাবে পুনর্বাসন করা হচ্ছে কি না তা প্রধান ব্যবস্থাপক এবং মহাপরিচালক নিজস্ব পদ্ধতিতে নিয়মিত তদারক করার কথা।

বলা যায় আইন কার্যকরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাব এবং বিধিতে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া স্পষ্ট না হওয়ার কারণেই আইনটির সুফল মিলছে না। উল্টো দিন দিন বাড়ছে পেশাদার ভিক্ষুকের সংখ্যা। করোনা মহামারীতে এক্ষেত্রে আরও নতুন মাত্রা যোগ করেছে। নগরবাসী এখন ভিক্ষুকদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। অথচ সরকার নাকি কোনো ভিক্ষুকই খুঁজে পাচ্ছে না। কর্তৃপক্ষীয় এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই অসাধু ব্যক্তিরা ভিক্ষাবৃত্তিতে আরও উৎসাহ বাড়াচ্ছে।

দুঃখজনক হলেও একথা সত্য যে, আমাদের দেশের জনপ্রতিনিধিরা যথাযথ ভূমিকা ও দায়িত্ব পালন করেন না। তারা জনপ্রতিনিধি কিন্তু একমাত্র ভোটের সময় ছাড়া তারা জনগণের কাছে যান না। এখন সেটারও প্রয়োজন হয় না। দেশের সুষম উন্নয়ন, ন্যায্যতা আর সাম্যের জন্য জনগণের কাছে যাওয়া, তাদের কাছে জবাবদিহিতা করা জরুরি। এই জবাবদিহিতার সংস্কৃতি যতদিন চালু না হবে এদেশে নিরাশ্রয় মানুষের সংখ্যা বাড়বে বৈ কমবে না।

উক্ত আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার, ভাসমান ও নিরাশ্রয় লোকদের প্রতি মানবিক হবেন এই আশা করছি।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।